আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যরা

ফয়সাল আকবর
ফয়সাল আকবর  © ফাইল ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে “যদ্যপি আমার গুরু” দিয়ে আমার ছফা পাঠ শুরু হয়েছিল। এরপরে আমার মনে দাগ কাটা কাটা একটি উপন্যাস-“গাভী বিত্তান্ত”। “গাভী বিত্তান্ত” উপন্যাসে উপাচার্য আবু জুনায়েদের গাভী পালনের শখ, “তরুণী”র প্রতি মায়া-দরদ দেখে কতবার যে নিজে নিজেই হেসেছি-তার ইয়ত্তা নেই। ভাবতাম, আমি মনে হয় সৌভাগ্যবান; অন্তত আমার সময়কার ভাইস-চ্যান্সেলরের গাভী পালার শখ নেই। তবে হ্যাঁ ওনাকে দেখে আমি কিছুটা দ্বন্দ্বেও পড়ে যেতাম; মনে হত, আলবার্ট আইনস্টাইন আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছেন!

গাভী বিত্তান্তের ইতিবৃত্ত বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রচিত বাংলা ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী স্যাটায়ার উপন্যাস গাভী বিত্তান্ত। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আবদুল মান্নান। ছাত্রদের গোলাগুলির মাঝখানে পড়লে ‘বিশেষ যোগ্যতায়’ নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যের গর্ভবতী গাভীটি নিহত হয়। এ ঘটনাকে উপজীব্য ধরে রচিত গাভী বিত্তান্ত উপন্যাস।

রসায়নের অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ আবু জুনায়েদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তি; বিভাগের সুন্দরী শিক্ষিকা দিলরুবা খানমের আকর্ষণে ডোরাকাটা দলের শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া; উপাচার্য পদে আসীন হয়ে আবু জুনায়েরদের চরিত্রের বিবর্তনকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে উপন্যাসের কাহিনী। এরই মধ্যে লেখক নিয়ে এসেছেন, উপাচার্যের মনোবাসনা পূর্ণ করতে ঠিকাদার শেখ তবারক আলীর গাভী উপহার। এই সৌভাগ্যবতী গাভীকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কেই আবু জুনায়েদ তার গোয়ালঘরে ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন। আর সেই গাভীর জন্য নির্মিত গোয়ালঘরকে রঙ্গমঞ্চ বানিয়ে আহমদ ছফা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৈন্যদশা এবং শিক্ষকরাজনীতির নানা কদর্য দিক তুলে ধরেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যরা কেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান স্যারকে আমি বেশ আগে থেকেই চিনি। তাঁর বিভাগের এক শিক্ষার্থী ওনার বিরুদ্ধে নিউজ করায় দুই বছর পর দেখা হওয়ার সাথে সাথেই তিনি সেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। পরে উপাচার্য হওয়ার পর দেখলাম, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ওনার বাসার সোফা পুড়ে যাওয়ায় তাঁ সে কি কান্নাকাটি! দিন কয়েকদিন না যেতেই তিনি বললেন- আন্দোলনকারীরা নাকি জঙ্গীর মতো! এসব আচরণ কতটুকু একজন দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের জন্য মানায় তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিনি তৈরি করেছেন আরও অনেক রেকর্ড। ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই তার কাছ থেকে ‘চিরকুটের মাধ্যমে’ ঢাবিতে ভর্তি হয়ে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন ছাত্রলীগের ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান নেতা। সম্প্রতি যোগ হলো ছোট ভাই ইয়ামিন সাজিদের প্রতিবেদন। যাতে দেখা গেল- আমাদের উপাচার্য মহোদয় ৫০ হাজার টাকার নিচে চেয়ারে বসেন না!

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য ফারজানা ইসলাম উপাচার্যদের গুণাবলীতে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। উন্নয়ন প্রকল্পে তিনি নিজে ছাত্রলীগকে দুই কোটি টাকা দেওয়ার ঘটনা এখন সারা দেশে আলোচিত। হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজে তিনি নাকি ঈদ বখশিশ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতাদের। আর ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা ওই চাঁদার ‘ফেয়ার শেয়ার’ আনতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন। নিজ সন্তান ও স্বামীর ঠিকাদারী ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের এমন ঘটনা নিঃসন্দেহে লজ্জার।

বর্তমান উপাচার্যদের মধ্যে সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। তিনি আলোচানায় তার মুখের ভাষা নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? এক নারী শিক্ষার্থী ফেসবুকে এই প্রশ্ন করায় উপাচার্য তাকে কাজ শিখিয়ে দিয়েছেন। বাপ তুলে গালাগাল করেই ক্ষান্ত হননি, ওই শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারও করেছেন। আরও ২৭ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের নোটিশ দিয়েছেন। নিয়োগে দুর্নীতি, ভর্তি দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারি, কথায় কথায় শিক্ষার্থী বহিষ্কার- সর্বগুণে গুণান্বিত তিনি! এরইমধ্যে গতকাল যোগ করেছেন নিজস্ব বাহিনী দিয়ে নিজ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রহার করা। এমন উপাচার্য দিয়ে জাতি কী করিবে! যিনি ফেসবুক স্টাটাসের কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের বাপ-দাদার গোষ্ঠী উদ্ধার করেন।

এছাড়াও ছাত্রদের কটুক্তি করে সম্প্রতি আন্দোলনের মুখে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এসএম ইমামুল হক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। অফিস না করেই বহাল তবিয়তে আছেন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমুল আহসান কালিমুল্লাহ। মেয়ের জামাই ও সন্তানকে নিয়োগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি পরিবর্তন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য!

যে কথা না বললে নয় ভাইস-চ্যান্সেলর বা উপাচার্য হলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি। যিনি হওয়ার কথা সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রকৃত অভিভাবক। কিন্তু দুর্ভাগ্য! সর্বোচ্চ এই কর্তাব্যক্তি যখন দুর্নীতি, অনিয়ম ও বিতর্কিত কর্মকান্ডের সঙ্গে একীভূত হয়ে যান তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা আর থাকে না। রাজনৈতিক পরিচয়েই নিয়োগ পান বলে যখন তাঁরা ভুলে যান সবার আগে তাঁরা শিক্ষক ছিলেন; তারা যখন দলদাসবৃত্তি ছেড়ে দলীয় ক্যাডার হয়ে যায় তখন পুরো শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের মর্যাদা নেতিয়ে পড়ে। ফলে জাতির কপালে আশার শেষ প্রদীপটাও নিভু নিভু হয়ে যায়। বলা যায়, লেখক আহমদ ছফার “গাভী বিত্তান্তে” বর্ণিত বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজের নগ্নতা, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং দলদাসবৃত্তির চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান উপাচার্যরা! এমন উপাচার্যদের দিয়ে জাতি কী করিবে???

লেখক: ৩৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত এবং লেকচারার, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি


সর্বশেষ সংবাদ