ভিসিরা কেন গাভী বিত্তান্তের জুনায়েদ ভিসির পথে হাঁটছেন?

মো. আবু রায়হান
মো. আবু রায়হান  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠন গুলোর মহড়া মারামারি সংঘাত নিত্য দিনের দৃশ্য। ইদানীং এ বিষয়গুলোকে ছাপিয়ে ভিসি মহোদয়দের লাগামহীন মন্তব্য ও পদক্ষেপ সাধারণ ছাত্রদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।

চলতি বছরের শুরুর দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. এসএম ইমামুল হক ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আয়োজন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের না জানানোর কারণ ভিসিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি শিক্ষার্থীদের রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দেন। এ বাজে মন্তব্যের প্রতিবাদে ভিসির পদত্যাগ, অপসারণ কিংবা মেয়াদকাল পর্যন্ত ছুটির দাবিতে সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ, মশাল মিছিল, কুশপুত্তলিকা দাহ, রক্ত দিয়ে ভিসি বিরোধী নানা শ্লোগান লেখা, আমরণ অনশন, ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছিল শিক্ষার্থীরা।

টানা ৩৫ দিন ধরে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। অবশেষে ভিসিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছিল।

ফেসবুকে মন্তব্যের জেরে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) আইন বিভাগের ছাত্রী ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকে বহিষ্কার করে। জিনিয়ার সাময়িক বহিষ্কারের নোটিশ বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিয়ে একজন ছাত্রের সঙ্গে আপত্তিকর আলোচনা করা, বিশ্ববিদ্যালয়কে হেয় করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া এবং উপাচার্যের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা ইত্যাদি।

জিনিয়াকে বহিষ্কারের পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিন। যদি ওই ছাত্রীর বহিষ্কারাদেশ পরে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু ভিসির লাগামহীন মন্তব্যের কারণে তার চেয়ারে থাকা নিয়ে টানাপড়েন অবস্থা। উপাচার্য ছাত্রীর সঙ্গে ফোনে যে ভাষায় কথা বলেছেন তা ভাইরাল হবার পর ক্যাম্পাস এখন বিস্ফোরক অবস্থানে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখন দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছে।

সকালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ভিসি পন্থী গুণ্ডা ও বহিরাগতদের হামলায় রক্তাক্ত হয় ক্যাম্পাস। বিবেকের দায়ে সহকারী প্রক্টর পদত্যাগ করলেও নির্লজ্জ ভিসি এখনো পদত্যাগ না করে শিক্ষার্থী দমনে ছক কষছেন।

কয়েক দিন আগে ভাইরাল হওয়া অডিওতে উপাচার্যের কথোপকথন শিক্ষক সুলভ ছিল না বলেই মনে হয়েছে। তার প্রতিটি কথা ছিল তির্যক ও স্বৈরাচারী মনোভাবাদর্শী। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এমন কদর্য ভাষায় শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন কি না? তা অবশ্যই ভাবনার বিষয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কি শিরোনামে ফেসবুকে জিনিয়া একটি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এরপর জিনিয়া প্রশাসনের রোষানলে পড়েন। পরবর্তীতে ভিসির সঙ্গে জিনিয়ার কথোপকথন ছিল খুবই হতাশাজনক ও আপত্তিকর। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ কী হওয়া উচিত’ শিরোনামে অকথ্য ভাষায় বকছেন তিনি। এ সময় ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী তোর আব্বার কাছে শুনিস। গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোদিন?’ এসব কটু কথা বলতেও ছাড়েননি উপাচার্য নাসির।

বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত বাক স্বাধীনতার স্থান। সেখানকার শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিত্বের এমন অশোভন আচরণ অগ্রহণযোগ্য ও নিন্দনীয় বটে। প্রকৃতপক্ষে এর গভীরে রয়েছে বর্তমান ভিসির দুর্নীতি ও অপকর্মের কারণ, তা না হলে কথায় কথায় শিক্ষার্থীদের নাস্তানাবুদ ও বহিষ্কারের পথে তিনি হাঁটতেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল বরাদ্দের সঠিক ব্যয় একটি কারণ হতে পারে।

আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসির বিরুদ্ধে উঠেছে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ। আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্তের সেই কাল্পনিক ভিসি মনে হচ্ছে এই ভিসি। যার বিরুদ্ধে অসংখ্য দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

উপাচার্য প্রফেসর ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের বিরুদ্ধে নিয়োগ দুর্নীতি, ভর্তি বাণিজ্য, প্রকল্পের অর্থ তছরুপ আর নারী কেলেঙ্কারির মতো ভয়াবহ অভিযোগ আছে। উপাচার্য উদ্ভিদের পরিচর্যার নামে প্রায় কোটি টাকার গোবর বাণিজ্য করেছেন বলে জানা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা চত্বরের বিপরীত পাশে দীর্ঘদিন ধরেই গোবরের স্তূপ রয়েছে। কোটি টাকার কাছাকাছি গোবর রয়েছে। হায় সেলুকাস গাভী বিত্তান্তে জুনায়েদ ভিসি তার গাভী আর গোয়াল ঘর নিয়ে যেখানে চিন্তিত ছিল। ভিসি জুনায়েদের জীবন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ সবটাই হয়ে পড়েছিল গোয়ালঘরকেন্দ্রিক। এই গোয়ালঘরকে রঙ্গমঞ্চ বানিয়ে আহমদ ছফা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৈন্যদশা এবং শিক্ষক রাজনীতির নোংরা বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছিলেন।

আজকাল বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ভিসিদের অবস্থান চিন্তা চেতনা যেন আহমদ ছফার কাল্পনিক চরিত্র জুনায়েদ ভিসির কর্মকান্ডকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই ২৪ বছর আগে লেখা হলেও এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট এবং ঘটনাবলি এখনকার পাঠকের কাছে খুবই প্রাসঙ্গিক, সমসাময়িক ও ঘটনার পূর্বাভাস বলে মনে হবে।

আজ ভিসি নাসির গোবর বাণিজ্য এবং তার শিক্ষার্থী দমনে ব্যস্ত। উচ্চশিক্ষিত জাতির মেধাবী সন্তানদের যদি এভাবে মস্তিষ্কে পঁচন ধরে জাতি কোথায় যাবে? সকল বিশ্ববিদ্যালয় হোক বাক স্বাধীনতা চর্চার তীর্থস্থান। প্রিয় ক্যাম্পাস হোক দুর্নীতি মুক্ত ও শিক্ষার্থীবান্ধব। পদ পদবীতে থাকা ব্যক্তিত্বরা দায়িত্ব পালনে হোক বেশি সতর্ক ও যত্নবান। সর্বোপরি দেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে দায়িত্ব পালনে হোক উদগ্রীব এটাই জাতির প্রত্যাশা।

[লেখক:  শিক্ষক ও গবেষক]


সর্বশেষ সংবাদ