ভাইরাল হওয়ার নেশায় মানুষ অন্যের গোপন তথ্যে হস্তক্ষেপ করে

আজহারুল ইসলাম
আজহারুল ইসলাম

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হবার নেশা, লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার পাবার নেশা সবচেয়ে বড় নেশা। তাহেরী হুজুরের একটি কথা দিয়ে আজকের লেখাটা শুরু করলাম, ‘চিল্লায়া মার্কেট পাওন যাইব’। যার যোগ্যতা আছে সে এমনেতেই তার ভালো কাজের মাধ্যমে ভাইরাল হবে, চিল্লায়া জোর করে কিছু হয় না।

সাম্প্রতিক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে অনলাইন ও ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিশেষ করে মোবাইল ফোন, ই-মেইল, ফেসবুক ইত্যাদি নতুন ধরনের মিডিয়ার আবির্ভাবের ফলে একদিকে যেমন যোগাযোগের পথ প্রসারিত হয়েছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং নিরাপত্তার অজুহাতে সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন ও নিয়ন্ত্রণ করছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহজলভ্যতার ফলে ভাইরাল হওয়ার লোভে এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির গোপন তথ্য প্রকাশ করে দিচ্ছে, ভাইরাল হওয়ার জন্য একে অপরকে হয়রানী, অপমান থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এখন সহজলভ্য হয়ে গেছে।

ভাইরাল হবার নেশায় মানুষ মানুষের বিপদে সাহায্যে হাত না বাড়িয়ে ঐ গোপন মুহূর্ত বা বিপদ মুহূর্ত ক্যামেরায় তুলে সবার সামনে প্রকাশ করার জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে অপরকে হেয় করে, অপমান করাটা এক প্রকার নেশার মত হয়ে গেছে ফলে যৌথ ভাবে থাকার চেয়ে মানুষ একা থাকায় বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলে হীনমন্যতা ও হতাশা বেড়ে চলেছে মানুষের মাঝে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩নং ধারা অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যক্তির গোপনীয়তার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো আইন নেই। বর্তমানে যেসব আইন রয়েছে এর মধ্যেই গোপনীয়তা সম্পর্কিত বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে সাইবার জগতে ব্যক্তির তথ্য-গোপনীয়তা আইনি ভিত্তি পাওয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিতর্কের জন্ম হয়েছে।

সাইবার আইনে সুস্পষ্ট ধারা ব্যক্তির গোপনীয়তা অধিকার রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। এর ফলে একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের জন্য আইনের আশ্রয় নিয়ে এর জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নারীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আজ হুমকির সম্মুখীন। এর মাধ্যমে নারীদের উত্ত্যক্ত করা ও তাদের অগোচরে প্রতারণার সুযোগে অশ্লীল ছবি ও ভিডিওচিত্র ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম উদ্ধৃত করা হলো: ‘বিয়ের প্রলোভন দিয়েই স্কুলছাত্রীর ভিডিও করা হয় নগ্ন দৃশ্য’, ‘প্রেমের ফাঁদে ফেলে স্কুলছাত্রীর নগ্ন ভিডিও...’, ‘ধর্ষণের দৃশ্য মুঠোফোনে, বিয়ে ভাঙল মেয়েটির’ ইত্যাদি।

দুর্ভাগ্যজনক যে, সম্প্রতি বাংলাদেশে গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘনকারী নানা ধরনের ঘটনা ঘটলেও, এখন পর্যন্ত ব্যক্তির তথ্য-গোপনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা অনেকটা সীমিত পর্যায়েই রয়ে গেছে এবং এটি শুধু সাইবার জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত ব্যক্তির তথ্যগত গোপনীয়তা বিষয়ে আইনি কাঠামো প্রবর্তন করা।

ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা ইস্যুতে যেসব ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয় সেগুলো হলো, অপ্রত্যাশিত ই- মেইল, প্রবঞ্চনা, অনুসন্ধান ও দখল, ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে ডাটাবেজ তৈরি, অযাচিত ফোন, মোবাইল মেসেজ ইত্যাদি। গোপনীয়তার সাথে সংশ্লিষ্টতা অনুযায়ী কারো বাসায় কোনো ধরনের অনুপ্রবেশ, অনুসন্ধান সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।

তবে বাংলাদেশ সংবিধানের ধারা ৪৩ (ক) অনুযায়ী ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় উল্লেখযোগ্য কারণ ছাড়া, দেশের নিরাপত্তা, জনআদেশ, জননীতি ও জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত কারণে গোপনীয়তার অধিকার বাতিল হতে পারে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি কখনোই অন্য এক ব্যক্তির গোপনীয়তা, পারিবারিক বিষয়, বাসস্থান বা যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমনকি আত্মসম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো পদক্ষেপও নিতে পারবে না। এরকম হস্তক্ষেপ বা আক্রমণের বিরুদ্ধে আইন সুরক্ষিত করতে প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে।

নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের (International Covenant on Civil and Political Rights) ১৭নং অনুচ্ছেদ, জাতিসংঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার’সের ১৪নং অনুচ্ছেদ এবং জাতিসংঘের শিশু সুরক্ষা সনদের ১৬নং অনুচ্ছেদে ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

যাচ্ছেতাই ভাবে ক্যামেরায় ধারণ করা ছবি ও ভিডিও যেগুলো অপরজনের ব্যক্তিগত তথ্য ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে ফেসবুক ও ইউটিউবে। এতে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে মানুষের সামাজিক অবস্থান, এতে ঘটছে সুইসাইডের মত মারাত্মক ঘটনাও।

এই ব্যাপারে আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনের কাঠামো একটু জটিল হবার কারণে মানুষ আইনের আশ্রয় লাভ করতে পারছে না। আর আমরা এমনি এক জাতি যারা অপরের হেয় বা প্রতিপন্ন হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটা দেখে আমরা মজা পাই, যারা অপরের ব্যক্তিগত তথ্যে হস্তক্ষেপ করে বা অপরকে হেয় করে তার সামাজিক অবস্থান নিয়ে খেলা করে তারা মানসিক রোগীর পর্যায়ে পড়ে। এদেরকে আমি বলবো, মানসিক রোগী।

তবে রাষ্ট্রের জনগণের নিরাপত্তায় এখনি ডাটা পলিসি তৈরি করা, ব্যক্তিগত তথ্যে হস্তক্ষেপ করা ব্যক্তিকে ট্র্যাক করার মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা জরুরি বলে মনে করি।

শিক্ষার্থী: বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, আইন বিভাগ


সর্বশেষ সংবাদ