কুরবানী ও পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মার্ডার কেস!

মো. আবু রায়হান
মো. আবু রায়হান  © টিডিসি ফটো

অতিবাহিত হয়ে গেল আত্ম উৎসর্গের মহিমায় চিরভাস্বর পবিত্র ঈদুল আজহা। কুরবানির গোড়াপত্তন কিভাবে হলো এর ইতিহাসের দিকে তাকালে অতীতে আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এর দুই পুত্র হাবিল কাবিল ও তাদের কুরবানি করার কাহিনী চলে আসে। প্রাসঙ্গিকক্রমে চলে আসে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম খুনের ঘটনা। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করলো।’ (মায়িদা: ৩২)রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কবীরা গুনাহগুলোর মধ্যে সবচে বড় গুনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা কথা বলা।’ (বুখারী : ৬৮৭১; মুসলিম : ৮৮)

সাম্প্রতিককালে প্রত্নতাত্ত্বিকরা একটি দেহাবশেষ আবিষ্কার করে বলছেন, পৃথিবীতে মানুষ খুন হয়েছিল আজ থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার বছর আগে। গবেষকদের হিসেবে সেটিই প্রথম খুন।তারা উত্তর স্পেনের অ্যাটাপুরে পর্বতের এক গুহা থেকে কিছু দেহাবশেষ উদ্ধার করে তারপর এসব কঙ্কালের একটির মাথার খুলির ময়নাতদন্ত করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন । কিন্তু পবিত্র কুরআন ও বিশ্বাসীদের মতে, পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ.)-এর ছেলে ছিলেন হাবিল ও কাবিল। পরশ্রীকাতরতায় কাবিল তার ভাই হাবিলকে হত্যা করে। পৃথিবীর বুকে সেটিই প্রথম হত্যাকাণ্ড বলে ইসলামে স্বীকৃত। বাইবেলের বর্ণনায়ও কুরআনের বর্ণনার সাযুজ্য পাওয়া যায়।বাইবেলে প্রথম খুন হওয়া মানুষটির নাম আবেল বলা হয়েছে ।যার মৃত্যু হয়েছিল আপন ভাইয়ের কুঠারের আঘাতেে । Cain treacherously murdered his brother Abel, lied about the murder to God, and as a result was cursed and marked for life. With the earth left cursed to drink Abel's blood, Cain was no longer able to farm the land. .(Genesis 4:1–16)

হযরত আদম (আ:) ও বিবি হাওয়া (আ:) পৃথিবীতে আগমনের পর তাদের সন্তান জন্ম হতে লাগলো। ধীরে ধীরে পৃথিবীতে মানুষ বাড়তে লাগলো । কিন্তু এখানে দৃশ্যত একটি সীমাবদ্ধতা থেকে গেল। আদম (আ:) ও হাওয়া (আ:) যেহেতু পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী। তাই তাদের পরের প্রজন্মে যত সন্তানের জন্ম হবে তারা সকলেই হবে ভাই-বোন। ইসলামী নিয়ম অনুসারে, ভাই বোনের মাঝে বিবাহ সিদ্ধ নয়। সে হিসেবে সেটিই হয়তো হতো পৃথিবীর শেষ মানব প্রজন্ম। এরপর মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতো পৃথিবী থেকে। কিন্তু তা ছিল পুরো মানবজাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। তাই সেই সময়ে বিশেষ একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে এর সমাধান করা হলো। বিবি হাওয়ার গর্ভে তখন সন্তান জন্ম নিতো জোড়ায় জোড়ায়। প্রতি জোড়ায় একজন ছেলে আর একজন মেয়ে জন্ম নিতো। একই জোড়ার ছেলে ও মেয়েরা পরস্পর বিয়ে করতে পারতো না। বিয়ে করতে হলে ভিন্ন জোড়ার কাউকে করতে হবে। কাবিল ও হাবিল ছিল ভিন্ন জোড়ার, তাই তাদের ব্যাপারটি স্বাভাবিক নিয়মেই সমাধান হয়ে যায়।

একজন আরেকজনের জোড়ার মেয়েকে বিয়ে করবে। কিন্তু এখানে একটি সমস্যা দেখা দিয়েছিল। হাবিলের জোড়ার মেয়েটি গাযা দেখতে তেমন সুন্দরী ছিল না। সেই তুলনায় কাবিলের জোড়ার মেয়েটি আকলিমা ছিল অনেক বেশি সুন্দরী ও অনন্যা। নিয়ম অনুসারে হাবিল অধিক সুন্দরী সুশ্রী আকলিমাকে বিয়ে করার কথা আর কাবিল বিয়ে করবে অপেক্ষাকৃত কম সুন্দরী গাযাকে। কিন্তু কাবিল বেঁকে বসে। সে হাবিলের জোড়ার গাযাকে বিয়ে করবে না।নাছোড়বান্দা কাবিল যেভাবেই হোক নিজের জোড়ার সুন্দরী মেয়ে আকলিমাকে বিয়ে করবে।এমতাবস্থায় পিতা হযরত আদম (আ:) তাদের দুজনকে আল্লাহর নামে কুরবানি দিতে বললেন। যার কুরবানি আল্লাহ গ্রহণ করবেন, তার ইচ্ছাই জয়ী হবে বলে জানিয়ে দিলেন । কার কুরবানি গৃহীত হলো আর কার কুরবানি গৃহীত হলো না, তা কীভাবে বোঝা যায়? তৎকালীন সময়ের কুরবানি এখনকার কুরবানির মতো ছিল না। সে সময়ে কোনো জিনিস কুরবানি দিলে আসমান থেকে আগুন এসে ঐ জিনিসকে পুড়িয়ে দিতো। কুরবানির বস্তুকে ভূমি থেকে উপরে কোনো স্থান বা পাহাড়ে রাখা হতো, আকাশ থেকে আগুন এসে যদি বস্তুকে পুড়িয়ে দিতো, তাহলে বোঝা যেতো আল্লাহ কর্তৃক কুরবানী গৃহীত হয়েছে। পিতা আদম (আ:) এর দেওয়া মীমাংসা অনুসারে তারা উভয়েই কুরবানির বস্তু উপস্থাপন করলো। আল্লাহর কাছে হাবিল একটি সুস্থ ও মোটাতাজা দুম্বা কুরবানি করলো এবং কাবিল তার কিছু সবজি ও শস্য কুরবানি করলো। তখন সবজি ও শস্যও কুরবানির জন্য কুরবানি করা যেতো। কোনো কোনো বর্ণনা থেকে জানা যায়, হাবিল কুরবানি করেছিল উৎকৃষ্ট মানের দুম্বা আর কাবিলের শস্য ছিল নিকৃষ্ট মানের। আল্লাহ হাবিলের কুরবানিকেই কবুল করেছিলেন। উপর থেকে আগুন দিয়ে দুম্বাটিকে পুড়িয়ে নিলেন, কিন্তু কাবিলের শস্যকে কিছুই করলেন না। সে হিসেবে বিয়ের নিয়ম আগের মতোই রইলো, হাবিল বিয়ে করবে কাবিলের জোড়ায় জন্ম নেয়া আকলিমাকে।এবিষয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, আদমের দুই ছেলের ঘটনা তুমি তাদের যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও। যখন তারা কুরবানী করেছিল তখন একজনের কুরবানী কবুল হল এবং অন্য জনের হলো না।( সূরা মায়িদা আয়াত ২৭)। আয়াতে বর্ণিত দুই ছেলে হলো হাবিল, কাবিল। তাওরাতে এদের নাম কাইন ও হেবল।

কিন্তু কাবিল কুরবানি কবুল না হওয়ার এই অপমান সহ্য করতে পারলো না। সে ভাবলো, হাবিলের জন্য তার কুরবানি আল্লাহ গ্রহণ করেননি। কুরবানিতে প্রত্যাখ্যাত হওয়াতে এবং স্ত্রী হিসেবে কাঙ্ক্ষিত আকলিমাকে না পাওয়াতে সে অত্যন্ত রাগান্বিত হলো। রাগের বশে হাবিলকে সে বললো, তোর ইচ্ছা কোনোভাবেই আমি পূরণ করতে দেবো না। প্রয়োজনে তোকে হত্যা করবো। যেন তুই আকলিমাকে বিয়ে করতে না পারিস। কোনো কোনো উৎস থেকে জানা যায়, কাবিলকে পাপিষ্ঠ ইবলিস শয়তান এমন ধ্বংসাত্মক ভাবনার উস্কানি দিয়েছিল।

কাবিলের এমন আচরণে হাবিল অনেক সুন্দর উত্তর দিয়েছিল। সে বলেছিল, আল্লাহ তাদের কুরবানিই কবুল করেন যার উদ্দেশ্য হয় সৎ। আর তুমি আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আমার গায়ে আঘাত করলেও, আমি তোমাকে কিছু বলবো না। কারণ আমি আমার আল্লাহকে ভয় করি।এসব কথায় কাবিলের উদ্দেশ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। রাগের বশবর্তী হয়ে সে আপন ভাই হাবিলকে হত্যা করলো। এরপরই কাবিলের মন গলে যায় এবং অনুভব করে, আহারে, কত বড় ভুল করে ফেললো সে! নিজের ভাইকে নিজ হাতে মেরে ফেললো। এটিই ছিল বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম খুনের ঘটনা।

এর চেয়ে বড় ধৃষ্টতা আর কী হতে পারে! ভেতরে ভেতরে সে অনেক অনুতপ্ত হলো এবং নিজের অপকর্ম কীভাবে ঢাকবে, তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লো। তখনো মৃতদেহ কবর দেওয়ার ব্যাপারে কোনো নিয়ম তৈরি হয়নি, কারণ এর আগে কোনো মানুষের মৃত্যু ঘটেনি। মৃত দেহটিকে নিয়ে কী করবে এ নিয়ে যখন সে চিন্তায় নিমগ্ন তখন দেখলো, একটি কাক তার ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে একটি গর্ত করলো। তারপর সেই গর্তে একটি মৃত কাককে টেনে এনে কবর দিয়ে দিলো। এটি দেখে কাবিল ভাবলো, তাকেও হয়তো এভাবে কবর দিতে বলা হচ্ছে। তাই একটি গর্ত করে সে তার ভাইকে কবর দিয়ে দিলো। ইসলামের ইতিহাস অনুসারে এটিই ছিল মানবজাতির প্রথম কবর। কোনো কোনো উৎস থেকে জানা যায়, কাক দুটি ছিল ফেরেশতা এবং এদেরকে আল্লাহই পাঠিয়েছিলেন, যেন এদের দেখে কাবিল শিখতে পারে।

হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি (সাঃ) বলেছেন,‘'যে কোন ব্যক্তিকে অন্যায় ভাবে হত্যা করা হয়, তার পাপের ভাগ আদম (আঃ)-এর প্রথম (হত্যাকারী) পুত্রের উপরও বর্তাবে। কারন সে-ই প্রথমে হত্যার রীতি চালু করেছিল'।( বুখারী ৭৩২১ )।মহান আল্লাহ অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা হতে ও কাউকে হত্যায় উদ্বুদ্ধ করা হতে আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।


সর্বশেষ সংবাদ