গুজবের গজবে আমরা

  © টিডিসি ফটো

ইদানীং দেশে একটার পর একটা সিরিজ ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণ, খুন, গুম, ডেঙ্গু, বন্যা, এর সঙে যুক্ত হয়েছে পদ্মা সেতুতে শিশুদের মাথা লাগবে বলে এক ধরনের গুজব।এ গুজব রটে গেল চতুর্দিকে। এরমধ্যে নেত্রকোনায় মিললো একজন পথচারীর ব্যাগের ভেতরে শিশুর দেহহীন কাটা মাথা। আতঙ্ক বেড়ে গেল জনমনে। মাথা কাটার সত্যতা মিললো। ছেলে ধরা আতঙ্ক বেড়ে গেল। যদিও ঘটনাটি কাকতালীয়।

গলা কেটে ধাবমান ব্যক্তিকে জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। ক্ষিপ্ত জনগণের রোষানলে ওখানেই তাকে অক্কা পেতে হলো। জীবিত উদ্ধার করা গেলে হয়তো হত্যার মোটিভ জানা যেত। যদিও পুলিশ প্রশাসন চলমান গুজবের সঙ্গে ঐ মাথা কাটা শিশুর কোনো সম্পর্ক নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। এরপরেও কি গুজব থেমেছে? থামেনি বরং এটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।

এমনিতে দেশে চলছে ডেঙ্গু জ্বর এডিস মশার উপদ্রব এবং দেশের কিছু অংশ ভয়াল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। এ দুর্যোগের দিনে মানুষের সৃষ্ট গুজবের গজবে জনগণ দিশেহারা। জনগণ এখন মারমুখি কখনো কখনো বেপরোয়া। ঢাকার বাড্ডায় কি নির্মম লোমহর্ষক ঘটনাই না ঘটলো। তাসলিমা বেগম রেনু নামের একজন নারীকে দিনে দুপুরে ছেলে ধরা অপবাদ দিয়ে সাপ মারার মতো নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো। কি বর্বরতা! কি পাশবিকতা! নেই যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ। সন্দেহ হলো আর এমনি সাপ পেটানোর মতো পিটিয়ে ইহলীলা সাঙ্গ করলাম। আহা কী শক্তি, সাহস আমাদের!

অবলীলায় লাঠির আঘাতে জর্জরিত। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কারো একটু মায়া হলো না? জীব জন্তুকেও তো মানুষ এতো নৃশংসভাবে হত্যা করে না। আশরাফুল মাখলুকাত দাবিদার মানুষ পারলো? রেনুর মেয়ে তুবাকে কি জবাব দেবে? ও তো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তুবা তার মাকে খুঁজে। তার অভিশাপ কি তোদের স্পর্শ করবে না পাষণ্ড! ছোট ফুটফুটে তুবার চোখের জল তোদের মত নরপিশাচদের কি ডুবিয়ে মারবে না? দেশে কি আইন আদালত নেই? তোরা আইন হাতে তুলে নেওয়ার কে? তোদের শাস্তিও নিষ্ঠুরভাবে হওয়া প্রয়োজন।

বাঙালি গুজবে কান দিয়ে বিশ্বাস করতে পটু। সত্যতা যাচাইয়ের বিন্দু মাত্র চেষ্টা আমরা করি না। একারণে আজ গুজবটা আমাদের সৃষ্ট গজবে পরিণত হয়েছে। চিলে কান নিয়ে গেছে বলে আমরা কাকের পেছনে দৌঁড়াই কিন্তু নিজের কান কানের জায়গায় আছে কি না হাতড়িয়েও দেখি না।কবি শামসুর রাহমান তাইতো পণ্ডশ্রম কবিতায় বলেন

"এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।
দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,
কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে"

গুজব হল এমন কোন বিবৃতি যার সত্যতা অল্প সময়ের মধ্যে অথবা কখনই নিশ্চত করা সম্ভব হয় না। অনেক পন্ডিতের মতে, গুজব হল প্রচারণার একটি উপসেট মাত্র। গুজব অনেক ক্ষেত্রে "ভুল তথ্য" এবং "অসঙ্গত তথ্য” এই দুই বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। "ভুল তথ্য" বলতে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যকে বুঝায় এবং "অসঙ্গতি তথ্য” বলতে বুঝায় ইচছাকৃতভাবে ভ্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা।পীযূষ কান্তি বড়ুয়া তার কল্লা-গুজব কবিতায় বলেন,

"এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ
উন্নয়নে আর কিতাবে
কেমনে ভাবি গুজব প্রেমী
ভীরু মানুষ দেশ জিতাবে"

বানোয়াট বা কল্পকাহিনিকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রচারের ইতিহাস তো পুরনো। তবে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের ইতিহাস খুব বেশিদিনের না। অরাজনৈতিক গুজব, যেমন, সাধু সন্ন্যাসীর অলৌকিক ক্ষমতা,পীর দরবেশ, মৃত ব্যক্তির জীবন লাভ, স্বপ্নাদেশ এবং নানা রকমের গুজব কুসংস্কার প্রচারের কাহিনি এদেশে অনেক পুরনো।

এ লেখা যখন লিখছি সোসাল মিডিয়ায় কিছুক্ষণের জন্য চোখ আটকে গেল। এ কি দেখছি আমি? চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার কয়রাডাঙ্গা গ্রামের রাতে নিখোঁজ হওয়ার পর সকালে একটি ইটভাটার পাশ্ববর্তী আমবাগান থেকে আবির হুসাইন নামের এগারো বছর বয়সের মাদরাসা ছাত্রের মাথাবিহীন লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ । এ যেন গুজব যারা ছড়িয়েছে তাদের জয়জয়কার অবস্থা। তারা একটি কাল্পনিক মিথ্যা বিষয়কে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কতটা উঠে পড়ে লেগেছে? ভেবে দেখেছেন কি?

যদিও ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনাও তো হতে পারে।কিন্তু যেহেতু এখন ছেলে ধরা গুজবের মৌসুম চলছে তাই গুজব সৃষ্টিকারীরা এর ফসল ঘরে তুলতে ও সফল হতে কসুর করবে না।গুজব ছড়ানোর মনস্তাত্ত্বিক কারণ সম্পর্কে দীর্ঘকাল গবেষণা করেছেন মনোবিজ্ঞানী অলপোর্ট।ও পোস্টম্যান। তারা বলেছেন, ‘গুজব মানুষের চাহিদা বা আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ’। অর্থাৎ যে গুজব ছড়ায় সে চায় যেন সত্যিই এমন কিছু ঘটুক।

প্রশাসনিক কাজে চট্টগ্রাম প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা তাপস পাল ‘ছেলেধরা’ গুজবের শিকার হয়েছেন বলে পত্রিকার মারফত জানা যায় গত সোমবার দুপুরে নগরীর উত্তর কাট্টলী মুন্সিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে এসে অভিভাবকদের সন্দেহের কবলে পড়েন এডিপিও তাপস পাল। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ, জনপ্রতিনিধি ও পুলিশের সহযোগিতায় ওই শিক্ষা কর্মকর্তা এ যাত্রায় বেঁচে যান।

আজ যাদের শত্রু আছে তারা একে অপরকে ছেলে ধরা অপবাদ দিয়ে হেনস্তা করার কৌশল অবলম্বন করছেন। এমনকি স্বামী স্ত্রীও একে অপরকে ছেলে ধরা অপবাদ দিয়ে গণপিটুনির ফাঁদে ফেলে আক্রোশের জ্বালা মিটিয়েছেন।কি একটা বাজে সময় পার করছে দেশবাসী? আজকের এ গুজব যেন নিরীহ জনসাধারণের কাছে মানব সৃষ্ট গজবের রূপ পরিগ্রহ করেছে।যারা গুজব ছড়াচ্ছে জনগণ তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়।

দেশবাসী গুজব গজবের বাইরে মুক্তভাবে বাঁচতে চায়।সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী গতকাল পর্যন্ত গুজবের কারণে ১৭ জেলায় ৭ জন নিহত, ৩৫ জন আহত।মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে জানুয়ারি হতে জুন পর্যন্ত সারাদেশে গণপিটুনিতে ৩৬ জন নিহত হয়েছে। জুলাই মাসে সে সংখ্যা ৪৩ এ ঠেকেছে ।এদেশের অধিকাংশ মুসলিম তারা যদি কুরআনের সুরা হুজুরাতের ৬ নং আয়াতটি মেনে চলতো তাহলে গুজবের মতো অভিশাপে আমাদের পরতে হতো না ।

'হে বিশ্বাসীগণ! যদি কোন পাপাচারী তোমাদের নিকট কোন বার্তা আনয়ন করে, তাহলে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়কে আঘাত না কর এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।'

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।


সর্বশেষ সংবাদ