দেশ এখনো ধর্ষণের সংজ্ঞায়ন করছে সেকেলের দণ্ডবিধি অনুযায়ী

সোহেল রানা, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
সোহেল রানা, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়  © টিডিসি ফটো

৭ বছরের ছোট্ট শিশু সামিয়া আক্তার সায়মা। সবে স্কুলের বাড়ান্দায় আলতো আলতো পা রাখতে শুরু করেছে। অপরূপ সৌন্দযের এই পৃথিবীর সাথে এখনো ভালো ভাবে পরিচয়ই হয়নি তাঁর। হয়তো দেখা হয়নি প্রভাতি সূর্যের আলোক ছটা। কিন্তু এরই মাঝে দেখে ফেলেছে পৃথিবীর অন্ধকার নির্মমতা। ছোট্ট এই শিশুটিকেই ধর্ষণের পর গলায় রশি দিয়ে শ্বাস রোধ করে হত্যা করেছে এক নরপশু। তদন্তকারী ডাক্তার বলছে শিশুটির ঠোঁটে কামড়ের চিহ্ন, যোনীতে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। হায়রে নির্মমতা! আমাদের ক্ষমা করে সায়মা। আজ আমরা এই নিষ্পাপ শিশুটির নিরাপত্তা দিতেও ব্যর্থ। সমাজে আজ ধর্ষণ ক্যান্সার রূপে ধরা দিয়েছে। ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাদ যাচ্ছে না শিশু ও বৃদ্ধারাও। এমনকি রেহাই পাচ্ছেন না বাকপ্রতিবন্ধী বা ভবঘুরে পাগলও। অপসংস্কৃতি, আকাশ সংস্কৃতি, অশ্লীলতা, ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা কারণে দিনে দিনে সামাজিক অবক্ষয় আর অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করেছে।

পাশাপাশি অশ্লীলতার আগ্রাসনে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ও সামাজিক অবক্ষয়ে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সমাজের এই ক্যান্সারকে এখনি রাশ টেনে ধরতে হবে। বিচারহীনতা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে ধর্ষণের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কাজেই ধর্ষকদের অতি দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্ষণ বন্ধে এর কোনো বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন, দ্রুত অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা।

ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশে প্রচলিত আইন:
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধারা ৯-তে বলা হয়েছে- যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন। আর ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।

এই পর্যন্ত চারটি ধর্ষণ বিষয়ক আইনের সন্ধান পাওয়া গেছে। Penal Code, 1860 এর Section – 375/376, Cruelty to Women Ordinance, 1983 এর Section -7/8, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ১৯৯৫ এর ধারা- ২(গ) ততসহ ধারা- ৬, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা -৯(১) এই চারটি আইনই পুরুষ কর্তৃক নারী বা শিশুকে ধর্ষণের আইন এবং তার শাস্তির বিধান।

ধর্ষণ বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করেছে ১৮৬০ সালের দন্ড বিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী। এইখানে ধর্ষণ বলতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে/সম্মতি ব্যতিরেকে ইত্যাদি পাঁচ ধরণের সহবাসকে ধর্ষণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিষয়টা সত্যিকার অর্থে ধর্ষণের বিচার করার জন্য যথেষ্ট ছিল এবং সাথে এমন ও একটা বিষয় সং যুক্ত করা হল যে বিবাহিত স্ত্রীর বয়স যদি ১৩ বছরের কম হয় তবে তার সাথে মিলন উক্ত নারী উপভোগ করলেও রাষ্ট্র স্বামীকে ধর্ষণের শাস্তি দিবে। এই বিধানটা সম্ভবত বাল্যবিবাহ ঠেকানোর জন্য করা হয়েছিল। এই আইনটি যদিও এখনও বহাল আছে কিন্তু এই আইনে এখন আর মামলা হয়না। কেননা এর পরে আরো সময়োপযোগী আইন এসেছে।

Cruelty to Women Ordinance, 1983 এর ৭/৮ ধারায় ধর্ষণের কোন শাস্তির বিধান না করলেও ধর্ষণের সময় মৃত্যু ঘটানো বা ঘটানোর চেষ্টার শাস্তির বিধান করা হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের কোন শাস্তির বিধান করা হয়নি কারণ ধর্ষণের বিচার দন্ডবিধিতেই করা সম্ভব ছিল। এই আইন এখন আর কার্যকর নাই ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু আইন প্রণয়নের সাথে সাথে বাতিল হয়ে গেছে। এই আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা দন্ডবিধির আদলেই রেখে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ধারা – ৬এ প্রথম বারের মত শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়। এই বিধানও ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বাতিল হয়ে যায়।

ধর্ষণের পরিসংখ্যান:
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন এই ছয় মাসে ২০৮৩ জন নারীও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৭৩১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১৩ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১২৩ জনকে৷ আর আত্মহত্যা করেছেন ৫০ জন৷

২০১৬ সাল ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭২৪ জন নারী৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ জনকে৷ আত্মহত্যা করেছেন ১৬ জন৷ ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৪৬ জন নারী৷ আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬০ জনকে৷ এই হিসাব পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী৷ তবে বাস্তব সংখ্যা যে আরো অনেক বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷

কেন বিচার হচ্ছে না?
আমাদের দেশের আইনে এখনো বলা আছে যে, একজন যদি ধর্ষণের অভিযোগ করেন, তাহলে বিচারের সময় তার চরিত্র নিয়ে নানান ধরণের প্রশ্ন করা যাবে। ফলে অভিযুক্তের আইনজীবী দ্বারা এমন জেরার মুখে পড়েন যা তাদের মর্যাদাকে আরো ভুলণ্ঠিত করে।

আদালতে প্রশ্ন করা হয়, কেন তাকে রেইপ করা হলো? কেন ওখানে সে গিয়েছিল? অন্যদের ধর্ষণ করা হয়নি আপনাকে কেন করা হলো? এভাবে একজন অভিযুক্তকে কথার মাধ্যমে আবারো ধর্ষণ করা হয়। এছাড়া প্রশানের দুনীর্তি, ডাক্তারি রিপোর্ট বদলে ফেলা, প্রভাবশালি রাজনীতিবিদদের চাপ, সাক্ষীর নিরাপত্তাহীনতা সর্বোপরি আইনের ফাঁকফোকর, বিচারের দীর্ঘসূত্রতার মাধ্যমে আপরাধী পার পেয়ে যায়। কখনো কখনো ভূক্তভোগী নারী সামাজিক সম্মান, আত্মাসম্মানের ভয়ে ধর্ষকের বিরুদ্ধে লড়তে না চাওয়ার মনোভাবও রয়েছে এর পিছনে।

সামাজিক অবক্ষয়ের চরম মাত্রায় হলো ধর্ষণ। এটা আজ সামাজিক ব্যথিতে পরিণত হয়েছে। তাই এর উত্তরণেও প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে সবার আগে যুবক সম্প্রদয়কে এগিয়ে আসতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই শিশুকে যৌন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে বলে মনে করি। সবার আগে দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেকটি ধর্ষণ মামলার দ্রুত বিচার কার্য সম্পূর্ণ করে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্ষণ আইনের পরিবর্তন করে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করতে হবে।