স্থগিতাদেশ কি শান্তি ফেরাতে পারবে হংকংয়ে?

  © টিডিসি ফটো

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ অঞ্চল হংকং গত কিছুদিন ধরে বন্দি প্রত্যর্পণ বিল নিয়ে বিক্ষোভে উত্তাল। যদিও ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে চীনের স্বায়তশাসিত অঞ্চল হংকংয়ে প্রস্তাবিত আসামি প্রত্যর্পণ বিল অনিদিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হংকংয়ের ইতিহাসে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রথম নারী প্রধান নির্বাহী ক্যারি লাম। তবে, বিক্ষোভকারীরা প্রত্যর্পণ বিল সম্পূর্ণ ভাবে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন।

গেলো ২০ বছরের মধ্যে চীন বিরোধী সর্ববৃহৎ বিক্ষোভ কর্মসূচি হচ্ছে এটি। যদিও চীন এর জন্য বিদেশী শক্তির ইন্ধনকে দুষছে। এই বিক্ষোভে ঘেরাও হয়েছিল পার্লামেন্ট ভবন। বিক্ষোভে ছাত্রছাত্রী ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি কর্মী, কল-কারখানার শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেয়। হংকং পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, সময় বাড়ার সাথে সাথে অংশগ্রহণকারী কমপক্ষে দুই লাখ ৪০ হাজার পর্যন্ত গড়িয়েছে। জনপ্রিয়

আর্ন্তজাতিক ম্যাগাজিন “দ্যা ইকোনমিস্টের” এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, হংকংবাসীরা ২০১৪ সালের সপ্তাহব্যাপী প্রতিবাদের পর থেকে ধারাবাহিক “আন্দোলনের ক্লান্তিতে” ভুগছে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে বিরোধিতা করতে গিয়ে শুরু হয়েছিল তৎকালীন জনপ্রিয় “অ্যামব্রেলা মুভমেন্ট” বা দখল আন্দোলনের। তারপর থেকে নানা ইস্যুতে আন্দোলন হয়েছে হংকংয়ে।

২০১৭ সালে ক্যারি লামের নির্বাচন নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে হংকংবাসীদের মনে। আসলে, হংকংবাসীর ইতিহাসের সঙ্গে সর্বদাই বিদ্রোহ বা বিক্ষোভের সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়। তারপরও হংকং অর্থনৈতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় তার অবস্থান সুসংহত রেখেছে ঈষর্ণীয়ভাবে। হংকংকে বলা হয় “ক্রীড়াশীল পুঁজিবাদের মন্দির”। লন্ডন ও লস এ্যাঞ্জেলেসে একত্রে যত বিলিয়নিয়ার আছে ততজন বিলিয়নিয়ার আছে শুধু হংকংয়ে।

আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নির কেন্দ্র হংকং কিন সাম্রাজ্যকালীন ২২১ খ্রিষ্টপূর্বে চীন সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত চীন ও ব্রিটেনের মধ্য প্রথম আফিম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে চীন পরাজিত হলে ১৮৪২ সালের ২৯ই আগস্ট বিখ্যাত নানকিং চুক্তির মাধ্যমে হংকং বৃটেনের কাছে সর্ম্পণ করতে বাধ্য হয়। এভাবে হংকং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কলোনিতে রুপান্তরিত হয়। তাছাড়া, ১৮৯৮ সালে চীন ও ব্রিটেনের মধ্য সম্পাদিত ইজারা চুক্তির কারণে ৯৯ বছরের জন্য হংকং চলে যায় ব্রিটেনের অধীনে। ১৯৯৭ সালের ১লা জুলাই ইজারা শেষ হয়ে যায় এবং গ্রেট ব্রিটেনের সরকার হংকং ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকারের কাছে নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করে।

কথা ছিল হংকংয়ে বাস্তবায়িত হবে “এক দেশ, দুই নীতি”। কিন্তু, হংকংবাসীদের অভিযোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে না এই নীতি। “একদেশ, দুইনীতি ৫০ বছর স্থায়ী হওয়ার কথা ছিল। বেইজিংয়ের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব থাকলেও হংকং বহুলাংশেই এককভাবে চলতে পারবে। প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন অক্ষুন্ন থাকবে তেমনিভাবে সুনিশ্চিত হবে নাগরিক অধিকার। চীনের অংশ হলেও হংকং থাকবে চীন থেকে আলাদা বিশেষ অঞ্চল হিসাবে।

এই উদ্দেশ্যই হংকং হস্তান্তরের দিন চীনের প্রেসিডেন্ট জিয়াংজেমিন বলেছিলেন “আমাদের হংকংয়ের ভাইয়েরাই চীনের এই ভূখন্ডের প্রকৃত মালিকে পরিণত হয়েছেন”। কিন্তু হস্তান্তরিত হবার প্রায় ২২ বছর পর দেখা যাচ্ছে এর ভিন্ন চিত্র। হংকংয়ের স্থানীয় সরকার, পুলিশ বাহিনী, গণমাধ্যম সর্বত্র চীনা হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে। চীন চাইছে বৈষয়িক উন্নতির মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু, জনগণ চাইছে সকল ক্ষেত্রে বিশেষ স্বাধীনতা।

বর্তমান সময়ে চলমান আন্দোলনের কারণ যে, প্রত্যর্পণ বিল তা বাস্তবায়িত হলে হংকং থেকে কোন আসামীকে চীনের মূল ভূখন্ডে নিয়ে বিচার করা যাবে। জনগণ যার ফলে তাদের বাকস্বাধীনতা, বিচারের স্বচ্ছতা হারাতে পারে বলে মনে করছেন। একারণে, সর্বত্র জনগণ এই আন্দোলনের সাথে একমত পোষণ করছেন। একইভাবে, জনগণের অভিযোগের তীর রয়েছে প্রধান নির্বাহী ক্যারি লামের দিকেও। তিনি চীনা মদদপুষ্ট বলছেন জনগণ ও বিরোধীরাও।

হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপ অনুযায়ী ৫৭ শতাংশ হংকংবাসী এখন ক্যারিলামের পদত্যাগের পক্ষে। তবে, দক্ষিণ এশিয়ার এবং চীনের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হংকংয়ের স্থিতিশীলতাও দরকার। এই বিক্ষোভের কারণে হংকংয়ের অনেক অফিস আদালত বন্ধ হয়ে গেছে যার বিরুপ প্রতিক্রিয়া পড়বে পুঁজিবাজারে। আশার কথা হচ্ছে, ২৮ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া প্রত্যর্পণ বিল বিরোধী আন্দোলনের মুখে ১৫ জুন প্রধান নির্বাহী ক্যারিলাম এই বিল স্থগিতের ঘোষণা দেবেন। আশা থাকবে, জনমতের মূল্যায়ণ করে চীন এবং হংকং সরকার জনদাবির সঠিক ও যথাযথ মূল্যায়ন করে জনবান্ধব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ণ করবে। নতুবা, চীনের যে অভিযোগ, বহিঃশক্রর সংশ্লিষ্টতা তা সত্য প্রমাণিত হবে।

কেননা, চীন ও হংকং যৌথ অর্থনৈতিক অগ্রগতির জয়রথ থামানোর জন্য যেমন আঞ্চলিক তেমনিভাবে বৈশ্বিকভাবে বিরোধী পক্ষ সদাসর্বদা সক্রিয়ভাবে সুযোগ সন্ধান করছে। চীনের চৌকস ও বুদ্ধিদীপ্ত কূটকৌশল এবং হংকংয়ের জনগণের আন্তরিক সহযোগিতা হতে পারে তার যৌক্তিক জবাব।

লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা


সর্বশেষ সংবাদ