যৌথ পরিবার ভাঙছে, বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রম

শফিকুল ইসলাম
শফিকুল ইসলাম  © ফাইল ফটো

শিক্ষা, প্রযুক্তি, জাতীয় মাথাপিছু আয়, জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি যে হারে এগিয়ে যাচ্ছে; যৌথ পরিবার ভাঙছে সেই একই আনুপাতিক হারে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনগুলো ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে সেটা বুঝতে কারো সমাজবিজ্ঞানী হতে হয় না। এই ভাঙনের লীলা খেলায় অসহায় হয়ে যাচ্ছে হাজারো বাবা-মা, যার হিসেব আমাদের অজানা। ভাঙনের এ লীলা খেলায় শেষ আশ্রয় হয় তাদের বৃদ্ধাশ্রমে।

চোখের পানি এদের নিত্য সঙ্গী। অতীত স্মৃতি আগলে যারা দিন কাটিয়ে পরপারে পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায়। সন্তানের ভালোবাসা যাদের কপালে জুটে না তাদের আশ্রয়স্থল হয় এই বৃদ্ধাশ্রমে। অতি আদরে সন্তানকে বড় করে বৃদ্ধ বাবা মা বার্ধক্যে হয়ে যায় একা, সহায়-সম্বলহীন। সারাজীবন খেয়ে না খেয়ে সন্তানকে উজাড় করে দিয়ে সময়ের শেষ প্রান্তে অবসর অসুস্থ অবস্থায় বাবা-মা সন্তানের কাছে হয়ে পড়ে অকর্মণ্য, সংসারের বাড়তি ঝামেলা। এসবের বেশিরভাগ যৌথপরিবার। যার ভাঙনের মধ্যদিয়ে বর্তমান প্রজন্ম খুব আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। আজকের নবীন ভুলে যায় সেও একদিন প্রবীণ হবে, সেও হবে কারো বাবা-মা!

এসব অসহায় মানুষগুলোর শোকের ছায়ায় দেশের সকল বৃদ্ধাশ্রমেও প্রতিদিন এক-একটি ভোর আসে। কিন্তু ভোরের সেসব অনুভূতি তাদের কাজ করে না। এ জীবন নিয়ে প্রহর ঘুনতে ঘুনতে বৃদ্ধাশ্রম ‍গুলোতেও আবার সন্ধ্যা নেমে আসে।

পত্রিকা ও অন্যান্য উৎস থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। গৃহছাড়া অবহেলিত ও অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এ উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছিল এই শান রাজবংশ। প্রাচীন চীনে শান রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা বর্তমান সমগ্র বিশ্বে প্রসার লাভ করে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা প্রবর্তন হয় ডা. এ. কে. এম আবদুল ওয়াহেদের হাত ধরে। বার্ধক্যে সবার জন্য শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ও স্বস্তিময় জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ডা. এ. কে. এম আবদুল ওয়াহেদের উদ্যোগে ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান।

পরে সরকারি উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবন এবং তারো পরে ১৯৯৩-৯৪ সালে সরকারি অনুদানে হাসপাতাল ও হোম ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির ৫০টিরও বেশি শাখা রয়েছে। এছাড়া কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন- অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, ব্র্যাক, ইআইডি, প্রবীণ অধিকার ফোরাম প্রভৃতি প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করে।

মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় প্রবীণদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী ছিল ১৯৯০ সালে ৪০ লাখ ৯০ হাজার। এরপর ১৯৯১ সালে দাঁড়ায় ৬০ লাখে। ২০১০ সালের পর ১ কোটি ২৫ লাখের বেশিতে এসে দাঁড়ায় এ সংখ্যা। ২০২৫ সালে এ সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ হবে প্রায়। প্রবীণ হয়ে সন্তানের কাছে বোঝা হতে চায় না কেউই। প্রবীণ তার অধিকার নিয়ে নিশ্চয়ই থাকতে চায় তার পরিবারে। সেই পরিবারের সদস্য যেন মানুষ হয়, মানবিক হয়। আজকের সন্তান যেন অনুভব করে তারাও একদিন বাবা মা হবে, বৃদ্ধ হবে। মনে রাখতে হবে চিরদিন কারো সমান নাহি যায়। বৃদ্ধদের নিরাপদ ও উত্তম আশ্রয়স্থল হোক পরিবার, বৃদ্ধাশ্রম নয়।

লেখক: শফিকুল ইসলাম
প্রভাষক: হিসাববিজ্ঞান বিভাগ
মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ


সর্বশেষ সংবাদ