রমজান নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে কী বলা আছে?

  © টিডিসি ফটো

কুরআন ও সুন্নাহর প্রতিটি বিধান বিশ্বমানবতার জন্য কল্যাণকর। শারীরিক, আত্মিক, ইহলৌকিক, পরলৌকিক যাবতীয় কল্যাণ ও চিরশান্তির মূল উৎস। সকল সক্ষম ঈমানদারদের উপর আল্লাহ তায়ালা রমজানের রোজা ফরজ করেছেন। রোজা ইসলামের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার প্রিয় বান্দাদের নিছক কষ্ট দেয়ার জন্য রোজা ফরজ করেননি। তিনি এ সম্পর্কে কুরআনে ঘোষণা করেছেন: ‘তোমরা যদি রোজা রাখো তবে তাতে রয়েছে তোমাদের জন্য কল্যাণ, তোমরা যদি সেটা উপলব্ধি করতে পারো।’ (সূরা বাকারাহ্ : ১৮৪)। এখানে কল্যাণ বলতে সর্ববিষয়ে মঙ্গল ও সফলতার কথাই বুঝানো হয়েছে।

ইসলামের আলোচনা সুবিস্তৃত। জ্ঞানের সকল ক্ষেত্রেই এর বিচরণ ঘটেছে। এমনকি, পবিত্র কুরআনকে সামনে রেখে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় আবিষ্কার করেছেন এবং আমাদেরকে দিয়েছেন জানা-অজানা নানান তথ্য।

ইসলামের ৫ টি স্তম্ভের মধ্যে সাওম (রোজা) অন্যতম। আমাদের অনেকেরই একটি ভুল ধারনা আছে যে, রমজান মাসে রোজা পালনে শরীর ও স্বাস্থ্যের ভীষণ ক্ষতি হয় এমনকি দেহে পুষ্টি সাধনে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ কথা একদমই ঠিক নয়, বরং রোজা রাখলে কায় ও মননের বিকাশ ঘটে এমনকি এর মধ্যে রয়েছে নানাবিধ উপকারিতা।

প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) যিনি ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, তিনি বলেছেন, সাওম(রোজা) পালন করো, তোমরা সুস্থ থাকবে। (মুসনাদে আহমাদ) এ হাদীস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, রোজা রাখার মধ্যে সুস্থ থাকার অনেক উপাদান রয়েছে।

১৯৯৭ সালে ‘দেহের সজীব পুষ্টির ইতিবৃত্ত’ শিরোনামে পরিচালিত এক গবেষণায় প্রমান হয়েছে, রোজা মানবদেহের খারাপ কোলেস্টরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড কমিয়ে নিয়ে আসে এবং ভালো কোলেস্টরল বাড়িয়ে দেয়। আর এর মাধ্যমে মানুষের হার্টকে কার্ডিও ভাসকুলার রোগ থেকে রক্ষা করে। (দৈনিক আল-আরাবিয়া,৮ জুলাই,২০১৪)

রোজা হলো ক্ল্যাসিক্যাল যুগসহ বর্তমানে আধুনিক অনেক চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের গবেষণার অন্যতম বিষয়। চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক ইবনে সিনা তার অনেক রোগীকে একাধারে তিন সপ্তাহ রোজা পালনের নির্দেশ দিতেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. হেপোক্রেটিস বহু শতাব্দী পূর্বে বলেছেন, ‘The more you nourish a diseased body the worse you make it.’

অর্থাৎ, ‘অসুস্থ দেহে যতই খাবার দিবে, ততই রোগ বাড়তে থাকবে।’ এ কথায় বলা যায় মাঝে মাঝে দেহকে খাবার গ্রহন করা থেকে বিরত রাখতে হবে।কেননা, সমস্ত দেহে সারা বছর যে জৈব বিষ (Toxin)জমা হয়, দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার ফলে সে জৈব বিষ দূরীভূত হয়।

বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড নারায়াড বলেন, ‘রোজা মনস্তাত্ত্বিক ও মস্তিষ্ক রোগ নির্মূল করে দেয়।মাননবদেহের আবর্তন বিবর্তন আছে। কিন্তু, রোজাদার ব্যক্তির শরীর বারংবার বাহ্যিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করে, রোজাদার ব্যক্তি দৈহিক খিচুনী এবং মানসিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয় না।’

২০১৬ সালে নোবেল জয়ী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. ইয়োশিনোরী ওহশুমি, তার গবেষণা ‘Mechanisms underlying autophagy’-তে, কোষ কিভাবে নিজের আবর্জনা পুন:প্রক্রিয়াজাত করে সুস্হ ও সজীব থাকে সে বিষয় তুলে ধরেছেন, কোষের এ প্রক্রিয়ার নাম অটোফাজি (Autophagy), এ প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয় করতে হলে মানুষকে কমপক্ষে ১২ ঘন্টা (Fasting) পালন করতে হবে।

ডা. ক্লিভ তার পেপটিক আলসার নামক গবেষণামূলক গ্রন্থে লিখেছেন, ভারত, জাপান ও ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন এলাকার তুলনায় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এই পেপটিক আলসার রোগের প্রকোপ অনেক কম, কেননা তারা সিয়াম পালন করে থাকেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘সিয়াম কোন রোগ সৃষ্টি করে না।’

জার্মানির এক স্বাস্থ্য ক্লিনিকের গেইটে লেখা আছে, ‘রোজা রাখো স্বাস্থ্যবান হবে।’ এর নিচে লেখা আছে, ‘মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ।’ জার্মানিসহ অন্যান্য খৃস্টান চিকিৎসকেরা রোজার উপকারিতার বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণা করেছেন।

কতিপয় আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অভিমত:

১. ডা. জুয়েলস এম. ডি বলেছেন, ‘যখনই একবেলা খাওয়া বন্ধ থাকে, তখনই দেহ সেই মুহূর্তটিকে রোগমুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে।’

২. প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. জন ফরম্যান ‘Fasting and eating for health’ প্রবন্ধে সুস্বাস্থ্য রক্ষায় উপবাস এবং খাবার গ্রহণের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে উপবাসের স্বপক্ষে মত দিয়েছেন।

৩. প্রফেসর বি এন নিকেটন দীর্ঘায়ু লাভের এক গবেষণা রিপোর্টে তিনটি কাজের কথা বলেন। এগুলো হলো (ক) পরিশ্রম করা, (খ) নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং (গ) প্রতি মাসে কমপক্ষে একদিন রোজা বা উপবাস থাকা।

৪. ডা. এম. কাইভ বলেন, ‘রোজা রাখলে শ্লেষ্মা ও কফজনিত রোগ দূরীভূত হয়।’

৫. ডা. ফ্রাঙ্কলিন বলেছেন, ‘রোজা স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী; তবে ইফতারিতে বেশি খাওয়া ক্ষতিকর।’

৬. ডা. লিউ থার্ট বলেছেন, ‘দেহের রোজা অত্যন্ত হিতকর টনিক। রোজাদাররা অনেক রোগ থেকে মুক্ত থাকেন।’

৭. ডা. নিধন চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘রোজাকে সুন্দর একটি পবিত্র ঔষুধ বললে ভুল হবে না।’

৮. ভারতের নেহেরু গান্ধী গোটা জীবন রোজায় অভ্যস্থ ছিলেন। তিনি তার অনুসারীদেরকে বলেন, ‘রোজার মাধ্যমে আত্মসংযম বাড়ে এবং মানবাত্মা পবিত্রতা অর্জন করে।’

৯. বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম বলেছেন, ‘রোজা মানুষের দেহে কোনো ক্ষতি করে না। ইসলামের এমন কোনো বিধান নেই, যা মানবদেহের জন্যে ক্ষতিকর। গ্যাস্ট্রিক ও আলসার-এর রোগীদের রোজা নিয়ে যে ভীতি আছে তা ঠিক নয়। কারণ রোজায় এসব রোগের কোনো ক্ষতি হয় না বরং উপকার হয়। রমজান মানুষকে সংযমী ও নিয়মবদ্ধভাবে গড়ে তুলে।’

সাওম পালনে অন্যান্য  উপকারিতাসমূহ,

১. কঠোর স্নায়ুব্যথার উপশম হয়।
২. রক্তস্বল্পতা ও রক্তশূন্যতা দূর হয়।
৩. ওজন ও মেদভুঁড়ি কমে।
৪. চর্মরোগ ও বাতরোগের প্রতিষেধক।
৫. ডায়াবেটিকস রোগ নিয়ন্ত্রনে আসে।
৬. গ্লাইকোজেন, শরীরের ভেতরে পুঞ্জীভূত স্নেহ এবং ধমনীতে মওজুদ চর্বিকে কাজে লাগায়। ইত্যাদি বহুরকম উপকারিতা লাভ হয় রোযা রাখার মাধ্যমে।

এ থেকে প্রমানিত হয়, রোজা কেবল আত্মশুদ্ধি ও পাপ মোচনের মাধ্যম নয় বরং দেহকে সুস্থ ও স্বাভাবিক ভারসাম্যপূর্ণ রাখার অন্যতম মাধ্যমও বটে। একজন মুসলিম হিসেবে পবিত্র রমজান মাসে এ ফরজ রোজাগুলো পালন করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব।

লেখক: তানভীর হোসাইন 
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 
১০ম ব্যাচ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ 


সর্বশেষ সংবাদ