রমযানের অতিরিক্ত আমলগুলো কী, কিভাবে আদায় করতে হয়

  © ফাইল ফটো

রমজান মাস প্রতিটি মুমিন-মুসলিমের জন্য আমলের বসন্ত কাল। নিজেদের ঈমানকে সজীব করার মুখ্য সুযোগ রয়েছে এ মাসে। বছর ঘুরে রাহমাত,মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে মাহে রমজান আমাদের মাঝে আগমন করে। যা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য মহা আনন্দের ও সুসংবাদের। পবিত্র এই রমজান মাসে মহান আল্লাহ আমাদের উপর সিয়াম ফরয করেছেন।

আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘হে ঈমানদার গণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে সিয়াম ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া (আল্লাহভীতি) অর্জন করতে পার।’ (সূরা বাকারা: আয়াত-১৮৩)

রমজানের দিনগুলো গতানুগতিক অন্যান্য দিনের মত নয়। রমজান মাসের নিজস্বতা স্বকীয়তা রয়েছে। রমাযানের প্রতিটি দিনক্ষণ আমরা যাতে আমলে সালেহ সম্পাদনের মাধ্যমে অতিবাহিত করতে পারি, যাতে রমাযান আগমনের উদ্দেশ্য আমরা হাসিল করতে পারি সেভাবে আমাদের পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হবে। আমাদের সমাজে দেখা যায় অনেকেই সিয়াম,ইফতার,সেহরি,তারাবী মধ্য রমাযান সীমাবদ্ধ মনে করে। গুটিকয়েক কাজের মধ্য রমাযান সীমাবদ্ধ মনে করা বিষয়টি সঠিক নয়। রমাযান মাস আসলে রাসূল সা. বিশেষভাবে কিছু আমলের প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। যে আমল গুলো সম্পাদনের মাধ্যমে রমাযান আরো অর্থবহ ও তাকওয়া অর্জনে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করত। তাই সকল মুসলিম ভাই- বোনদের সেগুলো জানা ও আমল করা জরুরী।

১.রমাযানের সিয়াম পালন করা- রমাযান মাসে প্রতিটি মুসলিম ভাই-বোনদের সর্বপ্রধান ও আবশ্যকীয় কাজ হলো সিয়াম পালন করা।রমাযান মাসে দিনের বেলায় পানাহার,স্ত্রী মিলন ও যাবতীয় অনাচার- পাপাচার থেকেই বিরত থাকায় সিয়াম। আল্লাহ তায়ালা বলেন,' তোমাদের মধ্যে যেই ব্যক্তি রমাযান মাস পাবে ,সে যেন সিয়াম পালন করে।('সূরা বাকারা: আয়াত-১৮৫)।

ঈমানদার ব্যক্তি মাত্রই প্রতিটি বিষয়ে হারানোর যেমন ভয় থাকবে তেমনি আশাও থাকবে পুরস্কার পাবার। তাই হাদিসে বলা হয়েছে,শুধু সিয়াম পালনই যথার্থ নয়; সিয়াম পালনের সাথে ঈমানী দৃঢ়তা ও সাওয়াব আশা করা জরুরী। তবেই আল্লাহ সিয়ামের প্রতিদানে বলেছেন, সিয়ামপালনকারীর পূর্বের গোনাহ মাফ করে দিবেন।(-সহীহ বুখারী ১৯০১, সহীহ মুসলিম:৭৬০,আবু দাউদ: ১৩৭২)

২.তারাবীহর সালাত আদায় করা

রমাযান মাসের সাথে তারাবীহ’র সালাত জড়িত। তাই সিয়াম পালনের সাথে সাথে এ মাসে তারাবীহ’র সালাত আদায় করা একটি ফজিলতপূর্ণ ইবাদাত। তারাবীহ’র সালাত ইতমিনানের সাথে রুকু সিজদা ধীর স্থিরভাবে আদায় করা জরুরী। অনেক মসজিদে দেখা যায় তাড়াহুড়া তারাবীহর সালাত আদায়ের কারণে রুকু সিজদার যথার্থ হক আদায় হয় না। তা মূলত সালাত চুরির নামান্তর বলা চলে। রাসূল সা. বলেছেন;" পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট চোর হল ,সে যে সালাতে রুকু সিজদা পরিপূর্ণরুপে আদায় করে না।(মুসনাদে আহমাদ: ২২৬৯৫, মিশকাত:৮৮৫) . আমাদের তারাবীহর সালাতে রুকু- সিজদা যেন যথার্থ হয় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। পাশাপাশি সহীহ শুদ্ধ কুরআন তেলওয়াত নামায কবুলের জন্য জরুরি।

তারাবীহর সালাত আদায়ের ফজিলত অপরিসীম। হাদিসে বলা হয়েছে;" যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব প্রাপ্তির আশায় রমাযান মাসে কিয়াম করল তার অতীতের গোনাহসমূহ মাফ করা হবে"। (সহীহ বুখারী: ৩৮,১৮০২,১৯১০,২০১৪ সহীহ মুসলিম৭৬০,আবু দাউদ১৩৭২,) তাই রমাযান মাসে তারাবীহর সালাত আদায়ের পাশাপাশি কিয়ামুল লাইল বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিত।

৩. ইফতার করা/ অপরকে ইফতার করানো / ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে দোয়া করা

সেহরি খেয়ে সিয়াম শুরু করে ইফতার করার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ইফতার করা সিয়াম পালনকারীর জন্য বড় আনন্দের বিষয়।রাসূল সা. বলেছেন, সিয়ামপালন কারীর দুটি খুশির সময় রয়েছে। এক. সিয়াম পালন কারী যখ ন ইফতার করে খুশী হয়।দুই.আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। (সহীহ বুখারী : ১৯০৪)

সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা সুন্নাহ সম্মত। সূর্যাস্ত হয়েছে জেনে ও ইফতারী বিলম্বে করা অনুচিত। ইফতার জেনেশুনে দেরীতে করাকে হাদিসে নাসারা - ইয়াহুদীদের কাজ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে।রাসূল সা." তোমরা যতদিন তাড়াতাড়ি ইফতার করবে,ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে"(সহীহ বুখারী : ১৯৫৭, সুনানে আবু দাউদ:২২৫৩, ইবনে মাজাহ : ১৬৯৮)

ইফতার খেজুর দ্বারা করা সুন্নাহ।খেজুর না থাকলে পানি দ্বারা ইফতার শুরু করবে। কেননা তা পবিত্র।(সুনানে তিরমিযী :৬৯০, মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৭৫৮৬)

ইফতারীর পূর্বমুহূর্ত দোয়া কবুলের সময়। ইফতারকারীর দোয়া আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কবুল করে থাকেন।( মুসনাদে আহমাদ) । সারাদিন সিয়াম পালন শেষে তা কবুল জন্য ও সারাদিনের ভুল- ভ্রান্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা মুস্তাহাব।আজকাল দেখা যায় ইফতারীর পূর্বে অনেকে ইফতারীর হরেকরকম আইটেম নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দোয়া কবুলের সময় অবহেলায় চলে যায় ।যা সত্যিই দুঃখজনক।

নিজে ইফতার করার সাথে সাথে অপর রোযাদার ব্যক্তিকে ইফতার করানো অধিক সাওয়াবের কাজ।রাসূল সা. বলেছেন,"

যে ব্যক্তি কোন রোযাদার ব্যক্তিকে ইফতার করাবে; আল্লাহ তায়ালা তার আমলনামায় রোযাদারের সমপরিমাণ সাওয়াব দান করবেন। এতে রোযাদারের সাওয়াব একটুও কমানো হবে না"। (সুনানে তিরমিযী ৮০৭; সুনানে ইবনে মাজাহ ১৭৪৬; সহীহ ইবনে হিব্বান ৮/২১৬). ইফতার করানোর অধিক সাওয়াবের কাজে সামর্থ্যানুযায়ী এগিয়ে আসা উচিত।

৪. সেহরি খাওয়া

সিয়াম পালনের জন্য সাহরি খাওয়া রাসূল সা. এর সুন্নাত। রাসূল সা. সেহরি খাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা সেহরিতে বারাকাত রয়েছে। মুমিনের জন্য উত্তম সেহরীর খাবার হলো খেজুর।(আবু দাউদ:২৩৪৫, মিশকাত: ১৯৯৮, সহীহ আত্- তারগীব:১০৭২) ইয়াহুদি ও আমাদের রোযার মধ্যে পার্থক্য হলো সেহরি খাওয়া।(সহীহ বুখারী :১৯২৩).সেহরী খাওয়ার সাথে রোযা রাখার নিয়ত করা জরুরী। কেননা রাসূল সা. বলেছেন; "যে রাতে ফজরের আগে সিয়াম পালনের নিয়ত করেনি, তার সিয়াম হবে না"।( সুনানে নাসাঈ)।ইমাম নববী রহ. বলেন, মনের মধ্যে কোনো কাজের ইচ্ছা বা সিদ্ধান্ত নেয়াকেই নিয়ত বলে।সুতরাং রোযা রাখার মনের মধ্যে সক্রিয় থাকাটাই নিয়তের জন্য যথেষ্ট।মুখে উচ্চারণের প্রয়োজন নেই।

৫.কুরআন তেলওয়াত করা/ কুরআন অর্থসহ জানা ও বোঝার চেষ্টা করা/ কুরআনের দারসে নিয়মিত বসা।

রমাযান মাস কুরআন নাযিলের মাস।এ মাসে লাইলাতুল ক্বদরে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সা. এর উপর মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণ হয়। অবতীর্ণের সময় কুরআনের প্রথম বাণী ছিল, "পড় ,তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।" (সূরা আলাক:০১) । সেসময় থেকে বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ আল কুরআন। পবিত্র কুরআন মানবজীবনের জন্য গাইডবুক। কুরআন কিয়ামাতের দিন পাঠকের পক্ষে বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবে।এমনকি কুরআন তার পাঠকের জন্য জান্নাতের সুপারিশ করবে।মহান আল্লাহ কুরআনের সুপারিশ কবুল করবেন।(শুয়াবুল ঈমান:১৮৩৯,মুসতাদরিক লিল হাকিম:২০৩৬, সহীহ আত্- তারগীব:৯৭৩) . তাছাড়া কুরআন তেলাওয়াতকে হাদিসে সর্বোত্তম নফল ইবাদাত বলা হয়েছে। যা তেলওয়াত করলে হরফ প্রতি দশ নেকি পাওয়া যায়।রমাযান মাসে তেলওয়াত করলে আরো অধিক সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে। রমাযান ২৯/৩০ দিনে হয়ে থাকে।রমাযানে প্রতিদিনে একপারা কুরআন তেলওয়াত করলে সহজে একবার কুরআন খতম দেয়া যায়। আমাদের সমাজে অনেকে রমাযান মাসে একাধিকবার কুরআন খতম দিয়ে থাকেন যা সত্যিই প্রশংসনীয়।

তবে একটি মনে রাখা দরকার কুরআন তেলাওয়াতের সাথে অর্থ জানা ও আমল করা জরুরি।কুরআন তেলাওয়াতের সাথে অর্থ জানা থাকলে অন্তরে দাগ কাটে এবং ঈমান সুদৃঢ় হয়।( সূরা আনফাল :০২) কুরআন তেলওয়াতকারী ও তদানুযায়ী আমলকারীকে রাসূল সা. কমলালেবুর সাথে তুলনা করেছেন।রাসূল সা. প্রতি রমাযানে জিবরাঈল আমীনকে কুরআন শুনাতেন। রাসূল সা. যে বছর ইন্তিকাল করেন,সে বছর দু'বার কুরআন শুনিয়েছিলেন।( সহীহ বুখারী: ৪৯৯৮, মিশকাত : ২০৯৯)

তাই মাহে রমাযানে কুরআন জানা ও মানার অনুশীলনের মাস।যারা কুরআন পড়তে পারে না তাদের জন্য সূবর্ণ সুযোগ এ মাস কুরআন শিক্ষার। অন্তত রমাযান মাসে কুরআন পড়া শিখে কয়েকটি সূরা মুখস্থ করলে যেমন সালাতে কাজে লাগবে তেমন কুরআন থাকায় অন্তর বিরান গৃহে পরিণত হওয়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে


৬. বেশি বেশি দান - সাদকা করা

রমাযান মাস মুমিনের জন্য আমলের বসন্তকাল। এ মাসে গরীব- দুঃখীদের সহযোগিতা করা, দান- সাদকা করা অত্যন্ত সাওয়াবের কাজ। ধনসম্পদ ব্যয়ের ব্যাপারে রাসূল সা. ছিলেন সবচেয়ে বেশি দানশীল।রমাযান মাস আসলে অন্যান্য মাসের তুলনায় দানের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিতেন।জিবরাইল যখন রাসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি রহমতসহ প্রেরিত বায়ুর বেগের চাইতে অধিক দান- সাদকা করতেন।( সহীহ বুখারী: ১৯০২)। আমাদের সামর্থ্য অনুসারে দান- সাদকা করা উচিত।

৭. মিসওয়াক করা

সারাদিন অনাহারে অতিবাহিত করে বিকালবেলা রোযাদারের মুখে একপ্রকার গন্ধ বের হয়। যা স্বভাবতই রোযাদার মাত্র সকলে অনুভব করতে পারে। সিয়াম পালনরত অবস্থায় রাসূল সা. অসংখ্য বার মিসওয়াক করতেন।(সহীহ বুখারী ৩০/২৭)। মিসওয়াক করা প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেন," মিসওয়াক হচ্ছে ;মুখকে পবিত্রকারী ও রবকে সন্তুষ্টকারী"। ( ত্বাবারানী,মুজামুল আওসাত: ৭৪৯৬) তাছাড়া রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয় নয়, বরং তা মিশকে আম্বারের গন্ধের চাইতে বেশি সুগন্ধি।(সহীহ বুখারী:১৯০৪, সহীহ মুসলিম:১১৫১,সুনানে নাসাঈ ২২১৭). তাই রমাযানে সিয়ামরত অবস্হায় মুখ পবিত্রকরণে মিসওয়াক করাও একটি ইবাদাত।

৮. সামর্থ্য থাকলে রমাযান মাসে ওমরা পালন করা।

রমাযান অতি বরকতপূর্ণ ও সাওয়াব অর্জনের মাস।রাসূল সা, রমাযানে ওমরা পালন করাকে হজ্জের সমতুল্য ইবাদাত হিসেবে অবিহিত করেছেন।( সুনানে ইবনে মাজাহ ২৯৯৩).যাদের সামর্থ্য আছে মাহে রমাযানের সুবর্ণ সুযোগ তাদের কাজে লাগানো উচিত।

৯. অশ্লীলতা,মিথ্যাচার ও যাবতীয় পাপাচার পরিত্যাগ করা

শুধু পানাহার ত্যাগের নাম সিয়াম নয়, বরং পানাহার ত্যাগের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য অশ্লীলতা, মিথ্যাচার, পরনিন্দা, যাবতীয় পাপাচার পরিত্যাগকারী ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার নিকটে সিয়ামপালন কারী হিসেবে গণ্য হবে।সিয়ামরত অবস্থায় এগুলো ত্যাগ না করলে আল্লাহর নিকটে ঐ পানাহার ত্যাগী ব্যক্তির কোনো প্রয়োজন নেই।( সহীহ বুখারী: ১৯০৩, আবু দাউদ:২৩৬২, তিরমিযী:৭০৭)

১০. ঝগড়া- বিবাদে লিপ্ত না হওয়া

সিয়াম ঢালস্বরুপ । সিয়াম মানুষদের বিভিন্ন পাপাচার ও বিভিন্ন ঝগড়া- বিবাদ থেকে দূরে রাখে। তবুও যদি কোনো ব্যক্তি রোযাদার ব্যক্তির সাথে ইচ্ছাকৃতভাবে ঝগড়া করতে আসে,গালিগালাজ করে, তাহলে রোযাদার ব্যক্তি নিজে লিপ্ত না হয়ে সুন্দরভাবে ঐ ব্যক্তিকে বলবে আমি রোযাদার। (সহীহ বুখারী:১৯০৪, সহীহ মুসলিম: ১১৫১,সুনানে নাসাঈ:২২১৭) সুতরাং রোজাদার ব্যক্তি সিয়ামের কবুলিয়াতের জন্য ঝগড়া বিবাদ ত্যাগ করা উচিত।

১১. অধিক নফল ইবাদাত ও ভালো কাজে লিপ্ত থাকা।

রমাযানের প্রতিটি সময় বরকতময়। আমাদের রমাযানে নফল ইবাদাতের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া উচিত। অন্যান্য মাসে আমরা যে সৎকাজগুলো করতাম, রমাযান মাসে সেগুলোর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া।আল্লামা ইবনুল কাইয়ূম রহ. বলেন, "রাসূল সা. এর আদর্শ ছিল রমাযান মাসে সকল ধরনের ইবাদাত বেশি বেশি করা"।(যাদুল মা'আদ ১/৩৩১) তাই এ মাসে বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করা, কুরআন তেলওয়াত করা,দান সাদকা করা, ইহসান, অপরকে কুরআন পড়তে শিখানো ইত্যাদি সকল ধরনের ভালো কাজে লিপ্ত থাকা উচিত। নিজে ভালো কাজ করার সাথে সাথে অপরকে ভালো কাজের সাথে সম্পৃক্ত করার মাঝে সাওয়াব রয়েছে। রাসূল সা. বলেছেন; যে ব্যক্তি কল্যাণের পথ দেখালো,তার জন্য রয়েছে আমলকারীর সমপরিমাণ সাওয়াব।( সহীহ মুসলিম)

১২. রমাযানের শেষ দশদিন বিশেষভাবে ইবাদাতে নিমগ্ন থাকা

রমাযান রাহমাতের দশক দিয়ে শুরু হয়ে নাজাতে শেষদশকে শেষ হয়। রমাযানের শেষের দশক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। রমাযানের শেষদশক আগমন করলে রাসূল সা. পরিবার- পরিজনদের সাথে নিয়ে ইবাদাতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। সবাইকে উৎসাহিত করতেন বেশি বেশি ইবাদাতে নিমগ্ন থাকার জন্য।অথচ আমাদের বর্তমান সমাজে শেষদশকের চিত্র একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিত। শেষদিকে অনেকেই ঈদুল ফি তরের কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় কাটায়।রমাযান শেষ দশকের ফজিলত পূর্ণ সময়ের সৎব্যবহার করেনা।শেষদশকের বিশেষ আমল এতেকাফ করা,লাইলাতুল ক্বাদর তালাশে ব্যস্ত থাকা প্রতিটি মুসলমানের উচিত।

১৩.এতেকাফ করা

রমাযানের শেষদশকের বিশেষ আমল হলো এতেকাফ করা। এতে-কাফ করা সুন্নাত । রাসূল সা. মদিনা থাকা অবস্থায় এতেকাফ করতেন। . এতেকাফের মাধ্যমে বান্দা নিজেকে দুনিয়ার সবকিছু থেকে আলাদা করে আল্লাহর ইবাদাতে একান্তে মিলিত হয়।ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে নিরন্তন সাধনায়।এতেকাফ ঈমান বৃদ্ধির একটি মুখ্য বিষয়। আয়েশা রা. বলেন; রাসূল সা. প্রত্যেক রমাযানের শেষদশকে এতেকাফ করতেন ইন্তিকাল পর্যন্ত।পরলোকগমনের পর তার স্ত্রীগণ এতেকাফ করতেন। তবে রাসূল সা. যে বছর পরলোকগমন করেন,সে বছরে বিশদিন এতেকাফ করেছিলেন।( বুখারী,মুসলিম:২০৪১) তাই সিয়ামপালনকারীদের সকলের উচিত এতেকাফের এ মুখ্য সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ঈমানী চেতনাকে আরো উন্নতর পর্যায়ে প্রাণীত ও সজীব করে তোলা।

১৪. রমাযানের শেষ দশকের বেজোড় রজনীতে লাইলাতুল ক্বাদর তালাশ করা।

রমাযান অতি মহিমান্বিত বরকতপূর্ণ একটি মাস । এ মাসে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির জন্য পথনির্দেশিকা অল কুরআন লাইলাতুল ক্বাদর রজনীতে অবতীর্ণ করেন। (সূরা বাকারা:১৮৫)। কুরআন অবতীর্ণের কারণে মাসটি যে মন ফজিলতপূর্ণ তেমনি যে রজনীতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সেটি একহাজার মাসের চাইতে উত্তম(সূরা ক্বাদর: ০৩)। রাসূল সা. ঘোষণা দিয়েছেন; যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব প্রাপ্তির আশায় লাইলাতুল ক্বাদরে জেগে ইবাদাত - বন্দেগী করবে আল্লাহ ঐ বান্দার অতীতের গোনাহসমুহ মাফ করে দিবেন।তবে লাইলাতুল ক্বাদর কবে সে বিষয়ে হাদীসের বিশুদ্ধমতে শেষ দশকের বেজোড় রজনীতে তালাশ করতে বলা হয়েছ।( সহীহ বুখারী:২০১৭). রমাযান মাসের ২১,২৩,২৫,২৭,২৯ তারিখের রাতগুলোর যে কোন একটিতে ক্বাদরের রাতটি রয়েছে।( সহীহ বুখারী:২০২০,সহীহ মুসলিম: ১১৬৯). নির্দিষ্ট করে প্রতিবছর ২৭ তারিখের রাতে লাইলাতুল ক্বাদর উৎযাপনের পক্ষে রাসূল সা. হতে বিশুদ্ধ দলীল নেই। রাত জাগরণের সময় বার বার নিম্নের দোয়াটি পড়তে হয়। দোয়াটি হলো" আল্লাহুম্না ইন্নাকা আফুউবুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা' ফু আন্নী। অর্থ : হে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা তোমার পছন্দীয়,সুতরাং আমাকে ক্ষমা কর।( সুনানে তিরমিযী : ২৭৮৯) । তাই ইবাদাতের মুখ্য সুযোগের রাতটি আমাদের তালাশ করা উচিত।

১৫. বেশি বেশি তাওবা ও ইস্তিগফার করা

রমযানের আগমনের উদ্দেশ্য সিয়াম পালনের মাধ্যমে যাতে ঈমানদারগণ নিজেদের গোনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারে ও তাকওয়া অর্জন করতে পারে।রমায়ানের বেশিরভাগ আমলের ফজিলতে বলা হয়েছে অতীতের গোনাহ পরিমার্জনা করা হবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিটি মুসলমান জন্য বিশাল সুযোগ। সেজন্য এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে রমাযানের প্রতিদিন- রজনীতে বেশি বেশি তাওবা - ইস্তিগফার করা উচিত। যাতে আল্লাহ আমাদের অতীতের কৃত অপরাধগুলো ক্ষমা করে দেন।" রাসূল সা. ঐ ব্যক্তির জন্য লা' নতের ব্যাপারে আমিন বলেছেন, যে রমাযান মাস পেয়েও নিজের গোনাহগুলো মাফ করিয়ে নিতে পারল না"।(সহীহ ইবনে হিব্বান,মুজামে তাবারানী)

১৬. সাদকাতুল ফিতর আদায় করা।।

রমাযান মাসের শেষে মুসলমানদের অন্যতম প্রধান উৎসব ঈদুল ফিতর।ঈদুল ফিতর আগে প্রতিটি মুসলমান নারী- পুরুষ,ধনী-গরীব,স্বাধীন- অধীন,ছোট- বড় নির্বিশেষে সকলের উপর সাদকাতুল ফিতর আদায় করা ফরয। তাতে যেমন রোযাদারের ভুল-ত্রুটি মার্জনা করা হয় তেমনি ফকির- মিসকিনরা কিছুটা হলেও অনায়াসে ঈদুল ফিতর উৎযাপন করতে পারে।এতে ধনী-গরীব সকলের মাঝে সম্প্রীতি গড়ে ওঠে।( বুখারী১৪৩২,মুসলিম ৯৮৪).

তবে সাদকাতুল ফিতর ফিতর ঈদের সালাতে জন্য বের হবার পূর্বেই আদায় করতে হবে।( সহীহ বুখারী :১৫০৯).

ঈদের সালাতের পরে সাদকাতুল ফিতর আদায় করলে তা সাধারণ সাদকা হিসেবে গণ্য হবে।( সুনানে আবু দাউদ :১৬০৯)

পরিশেষে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা জানাই যে, যাতে সুস্থ থেকে রমাযানের সিয়ামপালনের সাথে অন্যান্য বিশেষ আমলগুলো সম্পন্ন করতে পারি,নিজেদের গোনাহগুলো জন্য তাওবাতুন নাসুহাহ করতে পারি, আল্লাহ আমাদের সকলের সিয়াম কবুল করে যেন জান্নাতুল রাইয়্যান দান করেন। আমিন।


লেখক, কাউসার হোসাইন

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১০ম ব্যাচ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ


সর্বশেষ সংবাদ