বিশ্ববিদ্যালয়ের লিচু, ছাত্ররা যেভাবে চোর

দশ বছর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হয়েছিলাম, তখন আমাদের মতিহারের সারি সারি ফলের গাছ দেখে কিছুটা হলেও পুলকিত ছিলাম। আম, লিচু, কাঁঠাল, নারিকেল, জলপাইসহ বিভিন্ন ফল দেখে আমাদের চোখ জুড়িয়ে যেত।

কিন্তু ধীরে ধীরে আমার সেই ধারনার ফাঁটল ধরে। যখনই লিচুর একটু গুটি হয় ঠিক তখনই জালে ঢেকে দেয়া হয়। এখনভাবে সংরক্ষণ করা হয়, যেন একটি পাখিও সেই ফল ছুঁতে পারবে না।

এরপরও একদিন আম খাওয়ার মনঃস্থির করলাম, কিন্তু পাশে থাকা বন্ধুটি যখন বললো, এইগুলো ইজারা দেয়া হয়েছে। লোক লজ্জার ভয়ে ফলে হাত দেয়ার সাহস হয়নি। যখনই আম-লিচু পাকার সময় হবে ঠিক তখনই দেড় মাসের একটা লম্বা ছুটি দেয়া হতো। বিশ্ববিদ্যালয় পার করেছি, কিন্তু একদিনও সেইগুলো খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।

কয়েকদিন আগে শুনলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলে লিচু নামাতে গিয়ে ইজারাদারর হাতে পিটুনি খেয়ে হাত ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে।

বিষয়টি শোনার পর সত্যি অবাক হয়ে গেছি। যাদের বিশ্ববিদ্যালয়, যাদের লিচু গাছ আর তারা লিচু খাবে না তো কে খাবে শুনি? যারা লিচু পাড়তে গিয়েছিল তারা চিহিৃত চোর ছিল নাকি?

রাতে পাড়তে গিয়েছিল, বলে তারা কি চোর হয়ে গেল নাকি? যারা চোর চোর বলে মুখে ফেনা তুলছেন, তারা জানে না তাদের অধিকার কতটুকু? নিজেদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে আর কতদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব বলুন?

আমাদের সবাই কৈশোরে রাতের বেলায় ফল পেড়ে খাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। লিচু চুরি শব্দ ব্যবহার করে ক্যাম্পাসের অনুজদের সংবাদে কিছুটা হলেও লজ্জিত বটে।

প্রথমত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যতগুলো ফলের গাছ আছে তা সবগুলো বছরের পর বছর লিজ দেয়ার সংস্কৃতি চালু রেখেছে, তাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধু শিক্ষার্থী নয় শিক্ষকদেরও ফল খাওয়া থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, এই লিজ গ্রহণকারীরা স্থানীয় হওয়ায় অনেকটা দাপট দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সাথে দূব্যবহার করেন। যেটা ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক পরিবেশের সাথে যায় না।

নামে মাত্র অর্থে লিজ দেয়ার টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারকে সমৃদ্ধ করার পরিবর্তে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ব্যক্তিগত সুবিধায় বড় কিছু।

নিজেদের ক্যাম্পাসের গাছ থেকে ফল খাওয়াকে যারা অপরাধ বানিয়ে রেখেছেন, তারা জানে কী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি সম্পদের মালিক কে? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছের ফলের দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জন্য সংরক্ষণ করা উচিত।

কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল পাকার পর শিক্ষার্থীদের কাছে নামে মাত্র মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করা উচিত। নিজেদের গাছে নিজেদের বঞ্চিত করা, মেনে নেয়া যায় না। আর তা পেড়ে খাওয়ার অপরাধে শিক্ষার্থীদের মারধর করার যে সাহস দেখিয়েছে তা শুধু অপরাধ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের পরিপন্থি বটে!

লেখক: জাপানে পিএইচডিরত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।


সর্বশেষ সংবাদ