টি-শার্ট সমাচার

টি-শার্টের বিচিত্রতা
টি-শার্টের বিচিত্রতা  © সংগৃহীত

চায়ের দোকানে একদিন গেঞ্জি বা টি-শার্টের গায়ে থাকা বিভিন্ন লেখা নিয়ে কথা হচ্ছে। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাড়ির পাশের চায়ের দোকানে যত প্রকারের আজে বাজে কথা হয়, একজন ডায়াবেটিস রোগীও দিনে এতবার হিসাব করে মূত্র বিসর্জন দেয় না। এসব চায়ের টংগুলোতে সাধারণত অবসর শ্রেণীর মানুষের আসর দেখা যায়। সেখানে তাদের আলোচনায় গেঞ্জি বা টি-শার্টের গায়ে যেসব লেখা থাকে সেগুলোকে এক ধরনের শিল্প বলে চালিয়ে যাচ্ছিল।

মূলত গেঞ্জি বা টি-শার্ট কোম্পানি গ্রাহককে আকৃষ্ট করার জন্য এসব লেখা দিয়ে থাকে। যাতে করে জামাটা পরে বাসা থেকে বের হলে অন্তত মানুষ লেখাটা একটাবার পড়তেও জামাটা দেখে। এর থেকে ক্লিয়ার কথা হলো, এসব লেখাগুলো কোম্পানির শো-অব আর ক্রেতার স্মার্টনেস।

পোশাক একদিকে যেমন শারীরিক এবং মানসিক সৌন্দর্য অপর দিকে এটা একটা সম্প্রদায়ের পরিচিতিও বহন করে। যেটা হলো এক এক সম্প্রদায় বা দেশের মানুষের সংস্কৃতির ভিন্নতার পাশাপাশি পোষাকেরও ভিন্নতা রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ বিভিন্ন উৎসবের সময় হরেক রকমের পোষাক দ্বারা নিজেকে উপস্থাপন করে থাকে।

একদিন একটা কনসার্ট হচ্ছিলো। কনসার্টা ছিল বিজয় দিবস অথবা স্বাধীনতা দিবস অর সামথিং লাইক দ্যাট। তো সেখানে দর্শক গ্যালারীতে উপস্থিত ছিলের তরুণরা। কনসার্টের উপস্থাপক সাহেব বললেন. ‘আমি সামনের দিকে কিছু লোক দেখতে পাচ্ছি। যারা তাদের পরনে ভিনদেশী (আমেরিকান) পতাকা ওয়ালা জামা পরে আসছেন। তারা অনুগ্রহ করে সামনে থেকে পেছনে গিয়ে বসুন, কেউ কিছু মনে করবেন না। অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য রক্ষার্থে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ’। সেখানে এটা একটা কমন সেন্সের ব্যাপার ছিল। দেশীয় কোন সংস্কৃতি চর্চা করতে এসেছে বিদেশী পোশাক মুড়ি দিয়ে।

একজনের টি-শার্টের গায়ে লেখা আছে, ‘সি ব্যাক হু আই এম’। অর্থাৎ তার পরিচয় উনার ব্যাক সাইডে লেখা আছে। তো সবাই উনার ব্যাক সাইড দেখতেছে। সেখানে লেখা আছে ‘অসামাজিক’। অথচ এ অসামাজিক সাইনবোর্ডধারী লোকটিও সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক। একটি টি-শার্টের বদৌলতে আজ তার এ পজিশন। হয়তো বা তার কাছে অসামাজিক শব্দটা স্মার্টনেস। কিন্তু এদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অসামাজিক শব্দটা গভীর অর্থ বহন করে থাকে।

‘সি ব্যাক হু আইএম’ লেখা ছাড়াও হাজারো রকমের লেখা থাকে টি-শার্টের গায়ে। এটা তো একটা দৃষ্টান্ত মাত্র। টি-শার্টের গায়ে এসব লেখা ছাড়াও সামাজিক সচেতনতা মূলক বিভিন্ন লেখা দিয়ে সমাজের ভালো কাজ করা যায়। ইদানিং আরেকটা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কোন কথা যদি ভাইরাল হয়, টি-শার্ট কোম্পানিগুলো তার জন্য বসে থাকে। সেসব ভাইরাল কথা গুলো দিয়ে তাদের টি-শার্টের ডিজাইন করে।

সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ লেখা সম্বলিত জামা নিয়ে মাথা ঘামায়নি এমন লোক হয়তো খুঁজে পাবেন না। কিন্তু আমাদের জাতিগত বাঙালির এমন তাড়নায় কি করার! আমরা নিজেরাই অন্যের মার্কেটিং করায় বেশি অভ্যস্ত। অথচ, জাতীয় কোন দৈনিকে তাদের বিজ্ঞাপন দিতে অন্তত কয়েক ডলার গুনতে হতো। কিন্তু কই! তারা তো এখন এমনিই জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হচ্ছে নিয়মিত!

আলটিমেটলি যেটা হলো, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও কিন্তু ভাইরাল টি-শার্টগুলো সমর্থন পাওয়ার কথা না। সামাজিক প্রেক্ষাপটের বিষয়টা ভিন্ন হতেই পারে। অন্যদিকে এখন তো কেউ কেউ টি-শার্টের এমন প্রচারণাকে সামাজিক মুভমেন্টও বলা শুরু করেছে।

তবুও যাই হোক না কেন, ভাইরাল টি-শার্টের ডিজাইনের বিষয়বস্তু হচ্ছে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। অনেকদিন আগে যখন কুমিল্লায় তনু নামের এক মেয়ের ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তরপর তার মৃত লাশ পাওয়া যায়। তখন তাকে নিয়ে কথা উঠেছিলো, তনু একজন হিজাবওয়ালী নারী। তবুও সে ধর্ষণের মতো নৃশংসতার হাত থেকে রেহায় পায়নি। যার শেষ পরিণতি হয়েছিল মৃত্যু।

এসবে অন্তত এতটুকু ক্লিয়ার যে, শুধুমাত্র পোশাক ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির হাত থেকে একজন নারীকে রক্ষা করতে যথেষ্ট নয়। বিস্তৃতভাবে সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে। সে সাথে নারীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষায় প্রথম ধাপ তার নিজ থেকে শুরু হওয়া উচিত। ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলে স্বাধীনতাকে ভিন্নখাতে ব্যবহার না করে যথাযথভাবে সংযমী হওয়া চাই।

আবার এসব প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা কোন ধরনের লেখা সংবলিত জামা পছন্দ করে না। সাদামাটা তাদের পছন্দ, এটাও একটা ভালো। আবার অনেকে এটাকে তাদের মতো করে স্মার্টনেস হিসেবেও নিয়ে থাকে। এটা প্রত্যেকের মন-মানসিকাতার ব্যাপার। তবে এসবের মাঝে এখনো এরকম কিছু পোষাক উৎপাদনকারী কোম্পানি আছেন যারা বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকদের লেখা অথবা যেকোন শিক্ষণীয় দু-চার লাইন তাদের টি-শার্টগুলোতে প্রমোট করে। 

চায়ের দোকানে টি-শার্টের গায়ের লেখাগুলোকে শিল্প বলার ব্যাপারটা কতটুকু ঠিক জানা নেই। তবে এটা সত্য যে এটা একটা সুন্দর মাধ্যম মানুষকে কিছু দেয়ার। কার্যকর নীরব পদ্ধতি। দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় যেমন উপস্থাপক সাহেব তার কথায় নিজের দেশের ভালোবাসার পরিচয় বা অগ্রাধিকার দিয়েছেন সেটা আসলেই যথার্থ। পাশাপাশি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগে তাকে তার জায়গা থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। পরবর্তী ধাপ হতে পারে সামগ্রিকভাবে সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে আসতে পারে নারীর নিরাপত্তা।

 

লেখক: তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী। 


সর্বশেষ সংবাদ