কাশ্মীর ইস্যু: একজন বাঙালির প্রশংসায় বিজেপি কেন পঞ্চমুখ

সোমবার ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রহিত করার পর ক্ষমতাসীন বিজেপির অনেক নেতা স্মরণ করছেন প্রয়াত রাজনীতিক শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে। সংসদে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যখন সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের ঘোষণা দেন, পরপরই বিজেপি এবং আরএসএস -এর প্রভাবশালী নেতা রাম মাধব বলেন, "কী চমৎকার আনন্দের একটি দিন আজ ... ৭০ বছর পর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর আত্মত্যাগ সার্থক হলো।"

সদ্যপ্রয়াত বিজেপি নেত্রী এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ মন্তব্য করেছিলেন, "আজকের এই দিনটি ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর প্রতি এক শ্রদ্ধাঞ্জলি।"

বিজেপির পলিসি রিসার্চ সেলের অনির্বাণ গাঙ্গুলি বলেন, "আজ বাঙালি হিসেবে আমাদের খুব গর্বের দিন ... শ্যামাপ্রসাদের বলিদান আজ এত বছর পর সার্থকতা পেল।"

জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ক্ষোভের সাথে বলেন, জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী যে স্বপ্ন দেখতেন, সেটাই বিজেপি এতদিনে বাস্তবায়ন করলো।

কিন্তু কেন ৩৭০ ধারা রহিত করার পর প্রয়াত এই বাঙালি রাজনীতিকের প্রসঙ্গ উঠছে? কেন তার প্রশংসায় বিজেপি পঞ্চমুখ? কাশ্মীর ইস্যুতে তার তথাকথিত সেই বলিদান ঠিক কি ছিল?

কে ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী
আজকের যে বিজেপি, তার সূচনা হয়েছিল পশ্চিম বাংলার প্রয়াত এই রাজনীতিকের হাতে।

স্বাধীনতার পর নেহরুর মন্ত্রিসভায় ভারতের প্রথম শিল্পমন্ত্রী হয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য। মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেও সবসময় কংগ্রেসের বিরোধীতা করেছেন।

তারপর ১৯৫১ সালে নেহেরুর সাথে মনোমালিন্য চরমে ওঠায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২৬শে জুন কট্টর হিন্দু সংগঠন আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) সহযোগিতায় জনসংঘ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠণ করেন।

ঐ জনসংঘই পরে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি নাম নেয়। ফলে, হিন্দু কট্টরপন্থীদের কাছে তিনি পূজনীয় এক নেতা, তাদের আদর্শ।

'এক দেশ মে দো বিধান নেহি চ্যালেঙ্গে'
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক কিংশুক চ্যাটার্জি বলছেন, ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারা যুক্ত করে জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া নিয়ে হিন্দুত্ববাদী শিবির থেকে থেকে প্রথম যারা আপত্তি তুলেছিলেন, তাদের মধ্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ছিলেন অন্যতম।

"তবে ৩৭০ ধারা নিয়ে আপত্তি যে তিনিই একমাত্র করেছিলেন তা নয়, অনেকেই নিমরাজি ছিলেন, নেহেরু নিজেও নিমরাজি ছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তাকে ঐ কাজটি করতে হয়েছিল।"

বিজেপির নেতারা দাবি করেন, সংবিধানের ৩৭০ ধারার অন্তর্ভূক্তি নিয়ে নেহেরুর সাথে বিরোধের কারণে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী নেহেরুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।

তবে দিল্লিতে সাংবাদিক, লেখক এবং গবেষক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় - যিনি ভারতে কট্টর হিন্দু রাজনীতি নিয়ে এক গবেষণা-ধর্মী বই লিখেছেন - বলেন, ১৯৫২ সালের আগে কাশ্মীর নিয়ে শ্যমাপ্রসাদ মুখার্জী অতটা সরব ছিলেন না।

" (১৯৫০ সালে) অ্যাসেম্বলিতে ৩৭০ ধারা নিয়ে যখন বিতর্ক হয়েছিল তখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী তা নিয়ে আপত্তি করেননি।"

মি. মুখোপাধ্যায়ের মতে, তার গঠন করা দল জনসংঘ যখন ১৯৫২ সালের নির্বাচনে খারাপ ফল করলো, তখনই জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের কৌশল হিসাবে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কাশ্মীর ইস্যুকে বেছে নেন।

"কাশ্মীর বা ৩৭০ ধারা তার আগে কখনই তার কাছে প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু ছিল না।"

১৯৫২ সালে জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার বিপক্ষে ব্যাপক রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী।

'এক দেশ মে দো বিধান নেহি চ্যালঙ্গে (এক দেশে দুই আইন চলবে না)'- তার এই স্লোগান তখন দক্ষিণপন্থী হিন্দুদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

সে সময় জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকতে বিশেষ অনুমতিপত্র লাগতো। সেই বিধান ভঙ্গ করে তার একদল অনুগত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে সাথে নিয়ে ১৯৫৩ সালের ১১ই মে কাশ্মীরে গিয়ে হাজির হন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীও মি মুখার্জীর সঙ্গী হয়েছিলেন।

আইন ভাঙ্গার দায়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে শ্রীনগরেই পুলিশের হেফাজতে তার মৃত্যু হয়। বিজেপি দাবি করে তাকে হত্যা করা হয়েছিল যাতে ৩৭০ ধারার আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়।

কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর আশা পূরণেই কি বিজেপি ৩৭০ ধারা রহিত করলো?
ইতিহাসের শিক্ষক কৌশিক চ্যাটার্জি মনে করেন, ড. মুখার্জীর নাম নেওয়াটা নেহাতই রাজনীতি।

"বিজেপি তাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছে। মানুষকে বলতে চাইছে - 'দেখ আমাদের অবস্থানের ধারাবাহিকতা রয়েছে, আমাদের কোনো দ্বিচারিতা নেই...জাতীয়তাবাদী আবেগটাকে উস্কানোর আরো একটা প্রয়াস।"

নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ও মনে করেন, কাশ্মীর ইস্যুতে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর যে অবস্থান ছিল তার সাথে বর্তমান বিজেপির রাজনীতি খাপ খাচ্ছে বলেই তার এত গুণগান হচ্ছে।

"শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বহু দিক ছিল। শুধু শেষ দু বছর তিনি কাশ্মীর নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিলেন। বিজেপি এখন শুধু তার ঐ দু বছরের রাজনীতির কথাই বলছে...।"

"আসল কথা আপনি যদি ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিজেপির শাসন দেখেন তাহলে দেখবেন পরোক্ষাভাবে যে বার্তাটি তারা মানুষকে দিয়েছে তা হলো 'আমরা অন্য কিছু করতে পারি আর নাই পারি, অন্তত মুসলমানদের আমরা একটা শিক্ষা দিতে পেরেছি।' সেই বার্তা দিয়ে বিজেপি ২০১৯ সালে নির্বাচন জিতেছে।"

নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় মনে করেন, এখন সামনের নির্বাচনগুলোতে সুবিধা পেতে বিজেপি কাশ্মীরকে পূঁজি করছে।


সর্বশেষ সংবাদ