বেসরকারি চিকিৎসা শিক্ষার বেহাল দশা!

  © সংগৃহীত

দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বেহাল দশা। নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক, কোথাও কোথাও রয়েছে একাডেমিক ভবনের সংকট। অনেক মেডিকেল কলেজে রয়েছে দরকারি সব সরঞ্জমাদির অভাব। ল্যাব নেই অনেক মেডিকেল কলেজে। হাসপাতালও নেই কিছু কিছু মেডিকেল কলেজে। তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার মতো শক্ত কোন নীতিমালাও নেই। অনেক মেডিকেল কলেজের নেই বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসির) অনুমোদন। অনুমোদন থাকলেও নেই বিএমডিসির অনুমোদন নবায়ন করা। মাত্র ৬ পাতার একটি দুর্বল শর্তের নীতিমালা দিয়ে চলছে চিকিৎসা শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা।

গত ৬ মে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এসব অনিয়মের চিত্রফুটে উঠে। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বেসরকারি মেডেকেল কলেজ হাসপাতালের যে সব সমস্যা রয়েছে তা সমাধানে ৬ মাস সময় বেধে দেওয়া হয়েছে। ৬ মাসের মধ্যে শর্তাদি পূরণে ব্যর্থ হলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

সভায় অংশ নেওয়া কর্মকর্তা এবং মেডিকেল কলেজগুলোর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর সবগুলোর লেখা পড়ার মান সমান না। এ কারণে মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে গ্রেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যে সব মেডিকেল কলেজের সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে চট্রগ্রামের বেসরকারি সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ। এই মেডিকেল কলেজের একাডেমিক ভবনের সংকট রয়েছে। কলেজের জন্য একলাখ এবং হাসপাতাল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কমপক্ষে একলাখ বর্গফুটের ফ্লোর স্পেস থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্ত তাও নেই কলেজটিতে। কলেজটিতে রয়েছে শিক্ষক সংকট। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাক ল্যাবের ব্যবস্থায়ও নেই। কলেজটি মিউজিয়ামে দরকারি সরঞ্জমাদি নেই। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত শিক্ষক, কর্মকর্তাৎ-কর্মচারিদের জন্য সার্ভিস রুল তৈরি করা হয় নি।

তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মালিকরা বলছেন সমস্যা সমাধানে কাজ চলছে। চট্রগ্রাম বিজিসি ট্রাস্ট বেসরকারি মেডিকেল কলেজের পরিচালক অধ্যাপক ডা: এসএম তারেক বলেন, সরকার যে সময় বেধে দিয়েছে ওই সময়ের মধ্যে আমরা সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি। ঢাকা কমিউনিটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের পরিচালক অধ্যাপক ডা: আতিকা বেগম বলেন, সমস্যা আছে সমাধানও হবে। তবে আমি এখন আর ওই হাসপাতালে কাজ করছি না।

সমস্যায় জর্জরিত কুমিল্লা সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজের, কুমিল্লা ইষ্টার্ণ মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা ময়নামতি মেডিকেল কলেজ, রাজশাহীর বরিন্দ মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ ঢাকার বেসরকারি কমিউনিটি মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে চট্রগ্রামের বেসরকারি সাউদার্ন মেডিকেল কলেজের মতো ঠিক একই সংকট রয়েছে। এই সব প্রতিষ্ঠানকে সমস্যা সমাধানে ৬ মাস সময় বেধে দেওয়া হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন ৬ মাসের মধ্যে এত বিপুল পরিমান সমস্যা সমাধান মোটেই সম্ভব না। রাজশাহীর শাহ মাখদুম মেডিকেল কলেজের বিএমডিসি’র অনুমোদন নেই। বিএমডিসির অনুমোদন নেওয়ার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির ২০১৫-২০১৬, ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষের একাডেমিক অনুমোদন নবায়ন করা হয়েছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজের নিজ নামে জমির নামজারি থাকার কথা থাকলেও তা কিন্তু নেই। নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি মেডিকেল কলেজের জন্য একলাখ বর্গফুট এবং হাসপাতালের জন্য একলাখ বর্গফুট ফ্লোর থাকার কথা থাকলেও কিন্তু শাহ মাখদুম মেডিকেল কলেজের কলেজের জন্য রয়েছে মাত্র ৩০ হাজার বর্গফুট এবং হাসপাতালের জন্য রয়েছে মাত্র ১৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর। হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা আরো ১৬৮টি বাড়ানো, বেড অকুপেন্সি রেট আরও ৫৮ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৭০ শতাংশে উন্নীত করা, মান সম্মত গ্যালারি, অডিটরিয়াম কক্ষ ও লাইব্রেরি তৈরি করা এবং শিক্ষক নিয়োগে বিএমডিসি’র নীতিমালা মানার অনুশাসন দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। এতগুলো সমস্যা থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

বগুড়া টিএমএসএস মেডিকেল কলেজে নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক। শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধির শর্তে প্রতিষ্ঠানটির ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের একাডেমিক স্বীকৃতি অনুমোদন নবায়ন করা হয়েছে। রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের একাডেমিক ও হাসপাতাল ভবনের ফ্লোরস্পেস কম। সকল বিভাগের শিক্ষক সংকট রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। রোগীর সংখ্যা, বেড অকুপেন্সি, হাসপাতালের নাম পরিবর্তনের লাইসেন্সসহ এবং সকল বিভাগের শিক্ষক সংকট সমাধানের শর্তে ২০১৮-২০১৯, ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের একাডেমিক অনুমোদন নবায়ন করা হয়েছে। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠান মেডিকেল কলেজের বিপরীতে দুই কোটি এবং হাসপাতালের বিপরীতে ১৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ওই টাকার যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়েছে কী না তা খতিয়ে দেখছে মন্ত্রণালয়।

রংপুরের নর্দান বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১ লাখ ১০ হাজার ৫’শ ফুট একাডেমিক ভবন ও ৩৪ হাজার তিন’শ ৩৬ বর্গফুট ঘাটতি রয়েছে। এই মেডিকেল কলেজের নামে জমিও নামজারি করা নেই। রোগীর শয্যা সংখ্যা ঘাটতি রয়েছে ২১০টি। গ্যালারী, ল্যাব, মিউজিয়াম এবং টিউটরিয়াল রুমে দরকারি সরঞ্জাম নেই। বেড অকুপেন্সি ঘাটতি ৪৪ শতাংশ, সার্জারি ও মেডিসিন বিভাগে ৮ জন করে শিক্ষক এবং অন্যান্য বিভাগে ৪ জন করে শিক্ষক ঘাটতি রয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে দফায় দফায়পত্র দিয়ে সমস্যা সমাধানের কথা বলা হলেও তা আমলে নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। উল্লিখিত কারণে এই মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রী ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয় নি।

ঢাকার সাপ্পোরো ডেন্টাল কলেজের বিএমডিসি’র অনুমোদন নবায়ন করা নেই। রয়েছে একাডেমিক ফ্লোর সংকট, রয়েছে শিক্ষক স্বল্পতা, লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয় রেফারেন্স বই নেই। গ্যালারি ও টিউটরিয়াল কুমের ঘাটতি রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। একাডেমিক পরিবেশ দৃশ্যমান করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির ২০১৬-২০১৭, ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের একডেমিক অনুমোদন নবায়ন করে সার্বিক পরিবেশ উন্নীতর জন্য ছয়মাস সময় বেধে দেওয়া হয়। একই ধরণের সমস্যা রয়েছে ঢাকার বেসরকারি অপডেট ডেন্টাল কলেজে। তাদের ক্ষেত্রেও একই ধরণের শর্ত জুড়ে দিয়ে শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রম অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ঢাকার সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ নানা ধরণের সংকট বিরাজ করছে। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানটির বিএমডিসির অধিভূক্তি হালনাগাদ করা নেই। হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা কম। শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে কলেজটিতে। কলেজটির নামে দুই একর জমি থাকার কথা নেই। লাইব্রেরিতে আসন স্বল্পতার কারণে শিক্ষার্থীদের লেখা পড়ায় ব্যাগাত হচ্ছে। সব কিছু উন্নয়নের জন্য ৬ মাস সময় বেধে দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম অনুমোদন করা হয়েছে। ঠিক একই ধরণের সমস্যা বিরাজ করছে চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, চট্রগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, চট্টগ্রাম বেসরকারি মেরিনসিটি মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম বিজিসি ট্রাষ্ট মেডিকেল কলেজে। ওই প্রতিষ্ঠানটির ক্ষেত্রেও একই ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ঢাকার বারিধারা পাইওনিয়ার ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালে ২০১৫-২০১৬ শিক্ষা বর্ষে তিনজন, ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ১০ জন অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করায় প্রতিষ্ঠানটির প্রতি শিক্ষার্থী প্রতি একলাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। জরিমানার অর্থ নন ট্যাক্স রেভিনিউ হিসেবে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ১-২৭০১-০০০১-২৬৮১ কোডে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছ। টাকা ওই কোডে জমা দিয়ে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে। আগামী শিক্ষা বর্ষে জরিমানা দেওয়া আসনে ছাত্র ভর্তি চলবে না। মন্ত্রণালয় থেকে যে সংখ্যক আসন অনুমোদন দেওয়া আছে তা বহাল থাকবে। সিলেটের বেসরকারি জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ১৯৯৪-১৯৯৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত একাডেমিক অনুমোদন নবায়ন বাবদ মোট বারো লাখ ৫০ হাজার টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে বলে সভায় জানানো হয়। ওই প্রতিষ্ঠানকে করা জরিমানার প্রথম কিস্তি তিন কোটি টাকা নির্ধারিত সময়ে প্রদান এবং অন্য দুইটি কিস্তি যথাসময়ে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার শর্তে ১৯৯৪-১৯৯৫ থেকে ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের একাডেমিক অনুমোদন নবায়ন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া, ঢাকার তেজগাঁও এমএইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজে বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপী কোর্সে ২৫টি আসন অনুমোদওয়া হয়েছে। তবে ফিজিওথেরাপি কোর্স চালুর জন্য চারটি শর্ত দেওয়া হয়েছে। একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপি কোর্স চালু করতে হবে। মেডিকেল কলেজের ইউনিট হিসেবে চালু করা যাবে না। চার বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণসহ নিজস্ব জমিতে স্থানান্তর করতে হবে। বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপি পরিচালনার ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত হবে এবং ভবিষ্যতে মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা বিভিন্ন নির্দেশিকা অনুসরণ করতে হবে। অপরদিকে, ঢাকার বেসরকারি ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজের একই ধরণের সমস্যা সমাধানে এক বছর সময় বেধে দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির জমি নিজস্ব নামে নামজারি, বিএমডিসি’র অধিভূক্তি গ্রহণসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এক বছর সময় দেওয়া হয়েছে। টাংগাইলের কুমুদিনি মেডিকেল টেকনোলজী ইন্সটিটিউট, টাংগাইল ডিএমটি (ল্যা:) কোর্সে ২০টি, ডিএমটি( রেডিওলজী এন্ড ইমেজিং) কোর্স ২০টি, ডিএমটি (ফিজিওথেরাফি) কোর্সে ২০টি ডিএমটি (ডেন্টাল) কোর্সে ২০টি এবং অপথ্যালমিক এ্যাসিসটেন্ট কোর্সে ২০টি আসনসহ নতুন আইএইচটি স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়।


সর্বশেষ সংবাদ