রমজানের আয়ে ১২ মাস চলে, সেই রমজানেই বন্ধ কওমি মাদ্রাসাগুলো

এক কওমী মাদ্রাসার চিত্র
এক কওমী মাদ্রাসার চিত্র

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় গত মাসের ১৭ মার্চ দেশের সব কওমি মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করে কওমি মাদ্রাসার সমন্বিত বোর্ড আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া। ছয় বোর্ডের প্রতিনিধিরা বৈঠক করে ওইদিন এই সিদ্ধান্ত জানায়। কিন্তু লকডাউনের এই জীবনযাত্রায় কেমন আছেন এই শিক্ষাব্যবস্থার হাজার হাজার শিক্ষকরা। কীভাবেই বা চলছে তাদের দিনকাল?

সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, রজমান মাস কওমী মাদ্রাসার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আয়ের বড় একটি অংশ এ মাসেই এসে থাকে। একজন বলছেন, বলা যায় রমজানের টাকা দিয়েই ১২ মাস চলি, আর সেই রমজানেই বন্ধ আমাদের মাদ্রাসাগুলো। করোনা-সঙ্কট কতদিন চলবে, সেটাও বলা যাচ্ছে না। স্বভাবতই হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেয়া যাচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যানবেইসের পুরোনো এক হিসেব মতে বাংলাদেশে মোট ১৩ হাজার ৮২৬টি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লক্ষ ৮৮ হাজার ৪৬০ জন। যেখানে কর্মরত আছেন হাজার হাজার শিক্ষক। লকডাউনের জীবনে যাদের অনেকেই অসহায় দিন কাটাচ্ছেন। এসব আলেমদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র ভরসা মাদ্রাসাগুলো বন্ধ থাকায় কোনো বেতন-ভাতা না পাওয়ায় অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। চক্ষুলজ্জায় কারো কাছে চাইতেও পারছে না। খাটতে পারছেন না দিনমজুরের মতও। এ অবস্থায় অনেক সময় পরিবার নিয়ে কোনোভাবে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের।

জানতে চাইলে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের নেতা মাওলানা মিজানুর রহমান জানান, রমজান মাসে কওমি মাদ্রাসাগুলোতে মানুষের দান-সদকাহ বেশি আসে। আর এ দিয়েই মাদ্রাসার পুরো বছরের খরচের বেশিরভাগ অংশ পূরণ করা হয় এবং এর একটি অংশ দিয়ে শিক্ষকদের বকেয়া বেতনও পরিশোধ করা হয়। কিন্তু এ বছর সে সুযোগ থাকছে না। এ অবস্থায় আমরা এসব আলেমদের সহায়তার জন্য ইতোমধ্যে ‘ওলামা ত্রাণ কমিটি (করোনা ও দুর্যোগ)’ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটির মাধ্যমে আলেমদের সহায়তার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তাই আমরা সরকার ও বিত্তবানদের কাছে এসব অসহায় আলেমদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করছি।

সম্প্রতি এই বিষয়টি নিয়েই উদ্বেগ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা ও জাতীয় দ্বীনি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে সরকারের প্রতি সাহায্যের আবেদন আহ্বান জানান তিনি।

আল্লামা মাসউদ বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দেশের সব কওমি মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ ও মাদ্রাসা ভবনের ভাড়া প্রদানে চরম সংকটে আছে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। মাদ্রাসার সাধারণ শিক্ষকরা কোনরকমে দিন অতিবাহিত করছে লকডাউনের এই সময়টাতে। তাই সরকারের উচিত কওমি মাদ্রাসার এই শিক্ষকদের অর্থনৈতিক দূরাবস্থা উত্তরণে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কওমি শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জড়িয়ে আছে দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী। দীর্ঘ কয়েক যুগে এখান থেকে অগণিত আলেম তৈরি হয়েছেন। অগণিত খোদাভীরু, চরিত্রবান, সৎ ও যোগ্য ব্যাক্তি তৈরী হয়েছেন তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কওমি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছেন এমন অনেকের অসাধারণ প্রতিভা, সৃজনশীলতা ও যোগ্যতা ছিল কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সার্টিফিকেকের মূল্য না থাকায় সরকারি বা বেসরকারি ভাল কোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করা তো দূরের কথা; চাকরির জন্য আবেদন করারও সুযোগ ছিল না তাদের। তবে সবাইকে উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কওমি সনদ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত রয়ে গেছে এই শিক্ষাব্যবস্থা। সর্বশেষ করোনাভাইরাসের জন্য গত ১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ায় এই সমস্যা আরো তীব্রতর হয়েছে।

দ্বীপ জেলা ভোলা। জেলার সাত উপজেলার প্রায় ছোট-বড় সাড়ে চার শতাধিক কওমী মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। যেখানে কর্মরত প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষক। এ জেলারই দরগা রোড কারিমিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মো. হারুন জানান, তার মাদ্রাসায় শিক্ষক ও কর্মচারি মিলে ১৫ জন স্টাফ রয়েছে। গত তিন মাস ধরে তাদের বেতন বাকি। দেশে চলমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের বেতন দেয়াসহ তাদেরকে সহযোগিতা করা দরকার। কিন্তু মাদ্রাসার তহবিলে কোনো টাকা নেই। যারা এতদিন মাদ্রাসায় দান করতেন তাদেরও আর্থিক অবস্থা ভালো না। তাই খুব দুঃশ্চিন্তায় আছি।

আরেকজন জানান, দেশের এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন এসব কওমি আলেম। তাদের সংসার চলার একমাত্র মাধ্যম হলো মাদ্রাসার বেতন। সেটিও এখন বন্ধ। তারা কারো নিকট হাত পাততেও পারছেন না। অনেক শিক্ষক মোবাইল করে তাদের দুরবস্থার কথা জানালেও আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না। তাই আমরা এসব আলেমদের কথা চিন্তা করে গত এক মাস ধরে ভোলার জেলা প্রশাসক, ত্রাণ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত ও মৌখিকভাবে জানিয়েছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা পাইনি।

কওমী মাদ্রাসায় টাকা আসে কোথা থেকে?
বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, কওমী মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পায়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষই তাদের থাকা-খাওয়া এবং পড়াশোনার খরচ বহন করে। অনেক মাদ্রাসা আছে যেখানে নির্ধারিত কোন বেতন নেই। শিক্ষার্থীদের আর্থিক সচ্ছলতার উপর নির্ভর করে বেতন নেয়া হয়। এতো বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের ব্যয় বহন করছে কারা? কোত্থেকে আসছে এতো টাকা?

কওমী মাদ্রাসার যারা সমালোচক তাদের মনে এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। এসব মাদ্রাসা বিদেশী সহায়তা পায় কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কেউ-কেউ। কিন্তু এসব মাদ্রাসার সাথে সম্পৃক্তরা বলছেন, কোন বিদেশী সহায়তা নয়, সমাজের ভেতর থেকেই টাকার জোগান আনে।

ঢাকার একটি অন্যতম বড় কওমী মাদ্রাসা জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামি আরজাবাদ। সেখানে প্রায় ১২০০ ছাত্র পড়াশোনা করছে, যাদের অধিকাংশই সেখানে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার সুবিধা পায়। মাদ্রাসায় দুটি ভবন রয়েছে। একেকটি চারতলা করে।

এ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া বলেন, ‘আমাদের যে ছাত্র সংখ্যা আছে তার দুভাগ হলো দরিদ্র ফ্যামিলির ছেলে। এ দেশের যে মুসলিম জনসাধারণ আছে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অনুদানে মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। তেমন একটা সমস্যায় পড়তে হয় না আমাদের। একজন দিনমজুরও এখানে অনুদান প্রদান করেন তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী।’

ইসলাম বিষয়ক লেখক এবং গবেষক মাওলানা শরিফ মোহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশের সবগুলো কওমী মাদ্রাসা সমাজের ভেতর থেকে অনুদান নিয়ে পরিচালিত হয়। ‘জুম্মার নামাজে অংশগ্রহণ করে এমন কোন ধার্মিক মুসলমান আপনি পাবেন না যার কওমী মাদ্রাসায় ১০ টাকার অংশগ্রহণ নেই। ১০ টাকা থেকে এক কোটি টাকা অনুদান দেবার মতো মানুষ এ সমাজে আছে,’ বলছিলেন শরীফ মোহাম্মদ।

এসব বিষয়েই বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা ও জাতীয় দ্বীনি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান আল্লাহ ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলেন, করোনা বিস্তাররোধে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ পাশাপাশি খেটে খাওয়া মানুষদের লকডাউনের সময়ে খাবার পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ত্রাণ তহবিল গঠনের জন্য আমি সরকারের প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ‘মানুষকে ঘরে আটকে রাখলেই হবে না, তাদেরও খাদ্য ও জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা আমাদের করে দিতে হবে’ এর প্রশংসা করছি। দেশের অন্যতম শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের প্রতি এই দুর্যোগ মুহূর্তে সহানুভূতি প্রকাশ করতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।


সর্বশেষ সংবাদ