গল্প: ফাঁদ

  © টিডিসি ফটো

উচ্চমাধ্যমিক শেষে গ্রাম থেকে ঢাকায় কোচিং করতে যাওয়া। ২০১২ সালের পরে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে একবারও যাওয়া হয়নি ঢাকায়। তাছাড়া ঢাকা বা শহর বলতেই যে মানুষের নানা রকম হয়রানি আর অনিশ্চয়তার জায়গা, সেটা মগজে গেঁথে গিয়েছিল অনেক আগেই। সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা হতো পকেটমার, ছিনতাই এসব নিয়ে। কারন, ইতোপূর্বে এমন অনেক ঘটনা শুনেছি, যেগুলোর মুখোমুখি হওয়ার কল্পনা করতেই গা শিউরে ওঠে।

শুনেছিলাম ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে নাকি কোনো এক ভদ্রলোক ছিনতাইকারীদের হাতে ধরা পড়েছিলো। তারপর পলিথিনে করে বাথরুমের ময়লা এনে গায়ে ঢেলে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে সবকিছু হাতিয়ে নিয়েছিলো ছিনতাইকারীরা। ভদ্রলোক লজ্জায় সবকিছু দিতেও বাধ্য হয়েছে। কি বিদ্ঘুটে অভিজ্ঞতাই না সেদিন হয়েছিলো ঐ ভদ্রলোকের!

তারপর, কয়েকজন মিলে কোনো এক পথচারীকে মারধর করছে। মারধরের শিকার মানুষটাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের মোবাইল মানিব্যাগ সব খুইয়েছেন অনেকে। কারন, মারধরকারী আর ভুক্তভোগী সবাই মিলেই একটা চক্র। মানুষকে ফাঁদে ফেলতে কেউ মারছে আবার কেউ মার খাচ্ছে।

এরপর, ভিড়ের মধ্যে মোবাইলটা ছু মেরে নেওয়ার পর একই জামা গায়ে অনেকেই আশপাশে ঘুরাফেরা করতে দেখা যায়। তখন আর কাউকে সন্দেহ করার সুযোগ থাকে না। এমন হাজারো ফাঁদ পেতে বসে প্রতারকরা। যাদের ফাঁদে একবার পড়লে বাঁচার কোনো জো নেই।

যাইহোক, এমন বেশকিছু ঘটনা আগেই শুনেছিলাম। তাই বেশ সতর্ক আর সচেতনতায় ভালোই যাচ্ছিলো কোচিং-এর সময়টা। একদিন বাবা ঢাকায় আসে কোনো এক কাজে। তাই বললো চিটাগাং রোড ডেমরায় আসার জন্য। তখন রাত ৮ টা কিংবা ৯ টা বাজে। এসময় বন্ধুবান্ধব কাউকে সাথে যেতে বললেও রাজি হবে না হয়তো। তাই একাই যেতে হবে। তবে আমারও কেন জানি ভয় হচ্ছিলো কোনো বিপদ ঘটে কিনা। কারন, শহরে আগে কখনো রাতে একা হাঁটিনি। তারপরও বের হলাম। তবে সাথে কোনো টাকা পয়সা না, শুধুমাত্র মোবাইলটা নিয়ে বের হয়েছিলাম। পুরো রাস্তায় শুধুমাত্র একবার মোবাইলটা বের করেছিলাম। বাবা এখন কোথায় আছে সেটা জানার জন্য। হয়তো তখনি শকুনের দৃষ্টি পড়েছে।

এরপর দোকানগুলো পেরিয়ে একটু অন্ধকারে যেতেই কেউ একজন আমার মাথায় থাকা ক্যাপটা ছুঁ মেরে নিয়ে যায়। প্রথমে ভেবেছিলাম বন্ধুবান্ধব কেউ দুষ্টামি করছে। পরে দেখলাম একটা গলীর মধ্যে ঢুকে পড়েছে ১৫-১৬ বছর বয়সি ছেলেটা। আমাকে বললো ওর হাত থেকে ক্যাপটা নিতে। আমিও ভাবলাম নিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু হঠাৎ করে কেউ একজন আমাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে গলীতে ঢুকানোর চেষ্টা করলো। তারপর সন্দেহের তীরটা আরও তীক্ষ্ণ হয় আমার। তবুও আমি ক্যাপটা নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম।

এক পর্যায়ে ওরা দুজন গলির আরও ভিতরে চলে গেলো। আমি তখনো মেইন রোডে দাঁড়িয়ে। আমি যখন ভিতরে যাচ্ছিলাম না। তখন তারা একটা ঘরের সামনে আমার ক্যাপটা ফেলে চলে গেলো। সেখানে একটা বাতি জ্বলছিল। অনেক্ক্ষণ অপেক্ষার পর ওদের আর কোনো সাড়াশব্দ আনাগোনা না দেখে সাহস করে ক্যাপটা আনতে যাই। যদিও মনে মনে ভাবছিলাম, আজ বুঝি মোবাইলটা খোয়া গেল!

এরপর ধীরে ধীরে ক্যাপটার কাছাকাছি যেতে না যেতেই ওরা দুজন কোথা থেকে যেন তেড়ে এলো। আমিও টুপির মায়া সাঙ্গ করে পাল্টা দৌড় দিলাম। লক্ষ্য ছিলো কোনোমতে গলী থেকে বের হওয়া। পায়ের জুতা একটা ইতিমধ্যে রাজপথে লুটে পড়েছে। তবুও সামনে এগিয়ে গেলাম।

অতঃপর গলি থেকে বের হতেই বেশ জোরে একজনের সাথে ধাক্কা লাগে। লোকটা আমাকে ধমক দিলো। আমি তাকে সবকিছু খুলে বললেও সে সোজা হেটে চলে গেলো। হয়তো সে আমাকেই প্রতারক ভেবেছিলো কিনা কে জানে! তাই সচেতন মানুষের মত আমার বিপদে আর এগিয়ে এলো না। যদিও তার এমন আচরণে মনটা মোটেও খারাপ হয়নি আমার। কারন এমন প্রতারিত শহরে মানুষের কিছু করার থাকে না। যেখানে সহানুভূতি অধিকাংশ সময় কাল হয়ে যায়। সেখানে মানুষ সহযোগিতা করবে কোন ভরসায়?

যাক অল্পের জন্য ওদের হাতে ধরা পড়িনি। গলি থেকে বের হয়ে জোরে জোরে মানুষকে বলতে দেখে ওরা দৌড়ে পালিয়েছে ততক্ষণে। এরপর বাকী পথটা মনের মধ্যে হাজারো ভয় নিয়ে জোরকদমে হাঁটছিলাম। আবারও কোনো ফাঁদে পা দেওয়ার আশঙ্কায় খুব বেশি শঙ্কিত ছিলাম। যে শঙ্কা আজও কাটেনি। হয়তো কখনো কাটবেও না।


সর্বশেষ সংবাদ