গল্প: মানুষ

  © সংগৃহীত

হেকমত চৌধুরী। একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। খুন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতি তাকে মর্মাহত করে।

একদিন সকালে, বাজার থেকে গরুর মাংস কিনে, বাসায় ফিরছিলেন। পথে একটি কুকুর, পলিথিনে থাকা ওই মাংস কামড়ে নিল। হেকমত চৌধুরী রেগে, কুকুরকে ধাওয়া দিলেন। ততক্ষণে মাংস খাওয়া শুরু করেছে কুকুরটি, সঙ্গে আরও কয়েকটা কুকুর। হেকমত চৌধুরীর ধাওয়ায় কুকুরগুলো গেল না। বরং হেকমত চৌধুরীর দিকে ওই কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করে ওঠল।

হেকমত চৌধুরী যেন কুকুরের কথা বুঝতে পারছেন। কুকুর তাকে বলছে, আরে মানুষ! আমরা তো আর আমাদের মাংস খাই না। অন্য প্রাণীরটা খাই। তোমরা মানুষ তো মানুষেরও মাংস খাও!

হেকমত চৌধুরী: কীভাবে? কুকুর: কেন রিফাত, বিশ্বজিৎ, নুসরাতসহ যত হত্যা- এগুলো কি অন্য প্রাণী করেছে? মানুষই তো করেছে। ওই যে নিউজিল্যান্ডে মসজিদে, শ্রীলঙ্কায় গির্জায়, ঢাকায় গুলশানে হামলা। কত মানুষ মরলো। হিন্দু-মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, যে ধর্মেরই হোক, মানুষই তো মরেছে? মারলো কারা? মানুষই তো?

হেকমত চৌধুরীর কথা বন্ধ। অস্থির তিনি। বাড়ি ফিরলেন না। রমনা পার্কের দিকে পা বাড়ালেন। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলেন, দুই কিশোরীকে উত্ত্যক্ত করছে কিছু বখাটে। হেকমত চৌধুরী ওই বখাটের বোঝালেন, তাদের বুঝাতে পেরে স্বস্তি তার।

হাঁটা থামিয়ে, বাসে উঠলেন। বাসে এক সুন্দরী নারী, নারীর আসনে। আশপাশের বেশ কয়েকজন পুরুষ ওই নারীর থেকে চোখ নামাচ্ছেনই না। তাদের অপলক কুনজর মেয়েটির দিকে। এর মধ্যে একজন বয়ষ্ক লোকও আছেন। একজন আবার মেয়েটির গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন। হেকমত চৌধুরী সহ্য করতে পারছিলেন না, লোকগুলোকে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। এমন সময় নারীটি বাস থেকে নেমে গেলেন। হেকমত চৌধুরী বলতে গিয়ে আর বলতে পারলেন না। শুধু বিড়বিড়িয়ে বললেন, 'তোদের মা-বোন নেই। মা-বোন না ভাবতে পারিস, মানুষ তো ভাবতে পারিস।'

কিছুক্ষণ পর বাস থেকে নেমে রমনা পার্কে ঢুকলেন হেকমত চৌধুরী। একটি গাছের নিচে নিরিবিলি বসে, দেশ-বিদেশের নানা সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবছেন।

হঠাৎ হেকমত চৌধুরী একটি আওয়াজ শুনতে পেলেন। কে যেন তাকে প্রশ্ন করছে, আপনি কি মানুষ? তিনি বলে উঠলেন, হ্যা মানুষ।

আপনি কি সেই মানুষ, যারা অন্যের কষ্টে আনন্দ পান, অন্যকে উপহাস করে দৃপ্ত হন। আপনি কি সেই মানুষ? দুর্নীতি করেন, ঘুষ খান, অন্যের অনিষ্ট করেন, আবার ধর্মকর্মও করেন। আপনি কি সেই মানুষ? খাদ্যে ভেজাল দেন, মাদক ছড়িয়ে দেন। আপনি কি সেই মানুষ, বাইরে মানবিক, কিন্তু ঘরে স্ত্রীকে নির্যাতন করেন। আপনি কি সেই মানুষ? দিনে এক চেহারা, রাতে আরেক। আপনি কি সেই মানুষ? মানুষের গিবত করেন, অপবাদ দেন। আপনি কি সেই মানুষ? বাসে একা যুবতী পেলে ধর্ষণ করেন।

এভাবে একের পর এক অদৃশ্য ব্যক্তির প্রশ্নের মুখোমুখি হেকমত চৌধুরী। হেকমত চৌধুরী এবার চেঁচিয়ে উঠলেন, কে আপনি? কে বলছেন? আমার সামনে আসুন। কিন্তু হেকমত চৌধুরীর সামনে কেউ এলো না।

অদৃশ্য ব্যক্তির শেষ কথা ছিল, 'আসলে দরকার তো নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ। একজন ব্যক্তি মূল্যবোধ সম্পন্ন হলে, তার প্রভাব পরিবারে পড়ে। সেই প্রভাব সমাজে, সমাজের প্রভাব রাষ্ট্রের ওপর পড়ে। তাই ব্যক্তি মানুষকে নিয়ে আগে ভাবতে হবে।'

এদিকে বাসায় স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে হেকমত চৌধুরীর জন্য উদ্বিগ্ন। তার ফোনে বারবার কল ঢুকলেও রিসিভ হচ্ছে না। বেলা ১১টায় বাসায় ফিরলেন তিনি।

দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলেন স্ত্রী। আজ তো শুক্রবার। রাস্তায় জ্যাম নেই। এতো দেরি কেন? কিন্তু কথা বলার অবস্থায় নেই হেকমত চৌধুরী। তার প্রেশার বেড়ে গেছে। সবাই ধরাধরি করে বিছানায় নিয়ে গেলেন। মাথায় পানি দেয়া হচ্ছে। সবাই চিন্তিত। ডাক্তারকে খবর দেয়া হলো। ডাক্তার এলেন, প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেন। এরপর হেকমত চৌধুরী কুকুর ও রমনা পার্কের ওই ঘটনা সবাইকে বললেন। ছেলে-মেয়েদের মা বললেন, তোদের বাবার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। কী সব উল্টাপাল্টা বলছে। সবাই সিদ্ধান্ত নিলেন, বাবাকে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নেয়ার। পরদিন তাকে, ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নেয়া হলো।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে ছেলেমেয়েরা বর্ণনা দিলেন, তাদের বাবা প্রতিদিন পত্রিকা আর টেলিভিশনের খবর দেখেই সময় কাটান, প্রতি ঘণ্টার আপডেট রাখেন। বিভিন্ন খুন-খারাপির খবর দেখে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। নানা টেনশন করেন।

হেকমত চৌধুরীকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিলেন, আপনি এখন থেকে কোনো পত্রিকা পড়বেন না। টেলিভিশনের খবর দেখবেন না। এই বয়সে এত খোঁজ রাখার দরকারটা কি আপনার। হ্যা, যদি টেলিভিশনের খবর দেখতেই হয়, বিটিভির খবর দেখবেন। কারণ- নো নিউজ ইজ গুড নিউজ। এছাড়া ভালো বইও পড়তে পারেন। যেমন- কৌতুকের, হাসির নাটকও দেখতে পারেন।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বার থেকে বেরিয়ে হেকমত চৌধুরী বিড়বিড়িয়ে বলছিলেন, অমানবিক ডাক্তার। দেশের কোনো খোঁজ-খবরই রাখে না। আমাকে বলে পত্রিকা পড়বেন না। বলে- নো নিউজ ইজ গুড নিউজ। আমাকে জ্ঞান দেয়। আরে, কোথায় এসব সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাববে, তা না...।


সর্বশেষ সংবাদ