প্রেমিকার চিঠির আদলে ‘নকশীকাঁথা’ ক্ষেত সাজালেন কৃষক

কৃষক আব্দুল কাদিরের নকশীকাঁথা ক্ষেত
কৃষক আব্দুল কাদিরের নকশীকাঁথা ক্ষেত  © সংগৃহীত

দৈনন্দিন নানানভাবে আমরা ভালবাসার বহিপ্রকাশ দেখতে পাই। বিশ্বপ্রেমিকদের ইতিহাসের দিকে তাকালে সেখানে দেখি অপার মহিমায় ভালবাসার জয়গাঁথা সাজানো। তেমনি এক ভালবাসার বহিপ্রকাশ ঘটিয়েছেন ময়মনসিংহের কৃষক আব্দুল কাদির। প্রেমিকার চিঠির খামের আদলে ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ ‘নকশীকাঁথা’ ক্ষেত সাজিয়েছেন তিনি।

সৃষ্টিশীল মনের অধিকারী কৃষক আব্দুল কাদির (৪০)। ৩৫ শতক জমিতে শৈল্পিক বুননে ফসলের মাঠকে করে তুলেছেন দৃষ্টিনন্দন। দেখে যেন মনে হবে ক্ষেত নয়, এ যেন পরম যত্নে আঁকা এক নকশীকাঁথার মাঠ। এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন শত শত মানুষ কৃষক কাদিরের ক্ষেত দেখতে ভিড় করছেন।

সৌখিন কৃষক আব্দুল কাদিরের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ি ইউনিয়নের পাড়াখলাবলা গ্রামে। তিনি হাজী তারা মিয়ার দ্বিতীয় পুত্র।

সরেজমিন মাঠে গিয়ে কৃষক কাদিরের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তার গ্রামে একটি ’বন্ধুমহল’ ডিজিটাল ক্লাব আছে। তিনি সেই ক্লাবের উপদেষ্টা সদস্য। ক্লাবের সদস্যরা তার কাছে ডিজিটাল পদ্ধতির কিছু করে দেখানোর জন্য আবদার করে। ক্লাবের সদস্যদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করতে লাগলেন কি করা যায়। হঠাৎ তার মাথায় এলো স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে পাওয়া রবি শস্য সরিষার প্রদর্শনী প্লটে চিত্রকলার আলোকে বীজবপন করে কিছু নতুনত্ব সৃষ্টি করা যায় কি না।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্লাবের সদস্যদের সহায়তায় ৩৫ শতক জমিতে হাল চাষ করে জমির বুকে চিত্রাংকন করেন। তারপর চিত্ররেখার মাঝে বারী-১৫ জাতের সরিষা বীজ বপন করেন। জমিতে সেই বীজ গজানোর পর পুরো ক্ষেত যেন জীবন্ত ছবির রূপ ধারণ করে। ‘বন্ধুমহল’ ক্লাবের সদস্যরা ক্ষেতের নাম দিয়েছেন ‘নকশী কাঁথার মাঠ’। ফসলের এই কারুকার্যময় চিত্ররূপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তা দেখার জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার শত শত মানুষ ক্ষেতের পাশে ভিড় করছেন।

ক্ষেত ঘুরে দেখা যায় দুপাশে রয়েছে দুটি নৌকা, জাতীয় ফুল শাপলা, চার কোণে চারটি লাভ চিহ্ন এবং ক্ষেতের মধ্যখানে একটি বড় লাভ চিহ্ন। যার ভিতরে রয়েছে কৃষক আব্দুল কাদিরের নাম। জমিতে এই নান্দনিক ছবি আঁকার পেছনে যুক্তি কি? জানতে চাইলে কাদির বলেন, নৌকা আমি ভালোবাসি। নৌকা হলো আমার প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও গণমানুষের প্রতীক। শাপলা হলো আমাদের জাতীয় ফুল। ফুলের প্রতি ভালোবাসা থেকেই শাপলা আঁকা।

ক্ষেতের চার কোণে ও মধ্য ভাগে ‘লাভ’ চিহ্ন আঁকার বিষয়ে জানতে চাইলে কাদির হেসে উত্তর দেন। জানান তার ভালবাসার কথা। তিনি বলেন, ‘এর পেছনে একটি মজার গল্প রয়েছে। গল্পটি হলো কিশোর বয়সে উপজেলার সোহাগী গ্রামের এক কিশোরীর প্রেমে পড়েছিলাম। তখন সেই প্রেমের সেতুবন্ধন রচিত হয়েছিল চিঠির মাধ্যমে। প্রেমিকা আমাকে যখন চিঠি লিখতো তখন চিঠির চার কোণে চারটি এবং মাঝখানে একটি বড় লাভ চিহ্ন এঁকে দিতো। লাভ চিহ্নের ভেতরে লেখা থাকতো প্রেমিকার ও আমার নাম। কিশোর বয়সের সেই লাভ চিহ্নকে ফসলের জমিতে ফুঁটিয়ে তুলে ভালোবাসার প্রতি সম্মান দেখালাম।’

আব্দুল কাদির বলেন, ‘আমার প্রেমিকার নাম মকসুদা বেগম। ভালোবেসে তাকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছি। আমাদের সংসারে এক মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে। মাকসুদা আমার কাছে মমতাজের মত। সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রীর ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ পৃথিবী বিখ্যাত সুরম্য তাজমহল তৈরী করেছিলেন। আমি গরীব, আমার সামর্থ্য নেই, কিন্তু আমার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই। তাই তাজমহল বানাতে না পারলেও জমিতে সেই লাভ চিহ্নের নকশা এঁকে প্রেমের নিদর্শন হিসেবে প্রেয়সীকে লেখা চিঠির মতোই নিজের জমিতে প্রেমপত্র এঁকেছি।’

কৃষক আব্দুল কাদির আরও জানান, জমিতে দৃষ্টিনন্দন ফসল ফলানোর পর মানুষের কৌতূহল দেখে ক্লাবের সদস্যরাও আমার ক্ষেতের আদলে তারাও ফসল আবাদের প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। গ্রামের যুবকরা বাজে নেশা ছেড়ে যদি কৃষিকাজে মনোযোগী হয়ে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হয় তাহলেই আমার প্রয়াস স্বার্থক হবে বলে মনে করি।

এ ব্যাপারে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাধন কুমার গুহ মজুমদার বলেন, কৃষক আবদুল কাদির মানসিক ভাবনার সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন নিজের ফসলের মাঠে। তার ব্যতিক্রমী উদ্যোগটি সত্যিই খুব প্রশংসনীয়।


সর্বশেষ সংবাদ