ডাস্টবিন-পরিচ্ছন্নতা কর্মী নেই, অধিবাসীরাই দেশকে পরিপাটি রাখে

স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিচ্ছন্নতার কাজে অংশগ্রহণ করতে হয় জাপানের শিক্ষার্থীদের।
স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিচ্ছন্নতার কাজে অংশগ্রহণ করতে হয় জাপানের শিক্ষার্থীদের।  © সংগৃহীত

স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিছন্নতা কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা সারা দিনের সব ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা তাদের স্কুল ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করছে যে কখন বাড়ি যাবে।

তারা ধৈর্য্য সহকারে শুনছে যে তাদের শিক্ষক পরবর্তী দিনের সময়সূচী সম্পর্কে কিছু বলছেন। আর শিক্ষকের শেষ কথাগুলো ছিলো: “ওকে, সবাই শোনো আজকের ক্লিনিং রোস্টার। প্রথম ও দ্বিতীয় সারি শ্রেণীকক্ষ পরিষ্কার করবে। তৃতীয় ও চতুর্থ করিডোর, সিঁড়ি আর পঞ্চম লাইনে যারা আছো তারা টয়লেটগুলো পরিষ্কার করবে।” পঞ্চম সারি থেকে কিছুটা কান্নার মতো শব্দ আসলেও শিশুরা উঠে দাঁড়ালো এবং ক্লাসরুমের পেছনে রাখা সব উপকরণ নিয়ে টয়লেটের দিকে দৌড়ে গেলো।

এটি জাপানে সারাদেশের স্কুলগুলোর একটি পরিচিত দৃশ্য। এই দেশে যারা প্রথমবার বেড়াতে যান তারা অবাক হন কীভাবে দেশটি এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হলো। চলতে ফিরতে গিয়ে তারা দেখেন যে কোথাও ময়লা ফেলার ডাস্টবিন নাই এবং চোখে পড়ে না পরিচ্ছন্নতা কর্মীও। তাহলে এতো পরিষ্কার কীভাবে? এর সহজ উত্তর হলো- অধিবাসীরাই তাদের দেশকে পরিচ্ছন্ন রাখে।

মাইকো আওয়ানে নামের হিরোশিমার একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, “বার বছরের স্কুল জীবনে, এলিমেন্টারি থেকে হাই স্কুল পর্যন্ত, শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের রুটিনে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে অংশ নেয়ার জন্য সময় দেয়া থাকে। বাসা বাড়িতে বাবা মা শিক্ষা দেন যে আমাদের নিজেদের ব্যবহার্য জিনিস ও থাকার জায়গা নিজেরাই পরিষ্কার না করাটা খারাপ।”

চিকা হায়াশি নামের একজন ফ্রিল্যান্সার অনুবাদক বলেন, “আমি কখনো কখনো স্কুলের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে অংশ নিতে চাইতাম না। কিন্তু পরে আমি মেনে নেই কারণ এটা আমাদের রুটিনের অংশ ছিলো।”

স্কুলে পৌঁছেই শিক্ষার্থীরা তাদের জুতা খুলে লকারে রেখে দেয়। আবার বাড়িতেও প্রবেশপথেই জুতো রেখে ভেতরে প্রবেশ করে সবাই। এমনকি বাড়িতে কাজের লোক আসলেও তাই করে থাকে। বাচ্চারা যখন বড় হতে থাকে আস্তে আস্তে তারা ক্লাসরুম, নিজের বাড়ি কিংবা প্রতিবেশী, তারপর তাদের শহর এবং দেশ নিয়ে ধারণা পেতে থাকে।

জাপানে পরিচ্ছন্নতার কিছু কিছু ঘটনা ভাইরাল হয়ে গেছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে জাপানের খেলা শেষে সমর্থকদের স্টেডিয়াম পরিষ্কার করার ঘটনা বিশ্বকে আলোড়িত করেছিলো। খেলোয়াড়রাও ড্রেসিংরুম ছাড়ার আগে সেটি পরিষ্কার করে রেখেছিলো।

ফিফার কর্মকর্তা প্রিসিলা জানসেনস টুইট করেছিলেন, “সব টিমের জন্য এটা দারুণ অনুকরণীয়।”

ঘাসগুলো সবুজ...পরিষ্কার
মাইকো আওয়ানে বলেন, “আমরা জাপানিরা অন্যদের কাছ আমাদের ভাবমূর্তির বিষয়ে খুবই স্পর্শকাতর। আমরা চাই না কেউ আমাদের খারাপ ভাবুক।”

একই দৃশ্য দেখা গেছে জাপানিজ মিউজিক ফেস্টিভ্যালেও।

ফুজি রক ফেস্টিভ্যাল জাপানের সবচেয়ে বড় ও পুরনো সঙ্গীত উৎসব। ভক্তরা বর্জ্য ততক্ষণ সাথেই রেখেছেন যতক্ষণ না তারা একটি ডাস্টবিন খুঁজে পেয়েছেন। ধুমপায়ীদের পোর্টেবল অ্যাশট্রে নিয়ে আসতে বলা হয়েছিলো যাতে করে অন্যরা সমস্যায় না পড়ে। আবার সকাল আটটায় দেখা যাবে অফিস কর্মীরা বা দোকানের কর্মীরা তাদের কর্মস্থলের সামনেও রাস্তাও পরিষ্কার করছেন।

অদৃশ্য ময়লা আবর্জনা
বাচ্চারা স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কমিউনিটি ক্লিনিং-এ অংশ নেয়। স্কুলের কাছে রাস্তা থেকে ময়লা আবর্জনা সরিয়ে ফেলে তারা। সড়ক সংলগ্ন অধিবাসীরাও এ কাজে অংশ নেয়। ঘরের সামনের সড়কের ময়লা সরাতে কারও জন্য তারা অপেক্ষা করে না।

অদৃশ্য ময়লা, জীবাণু কিংবা ব্যাকটেরিয়া- এগুলোও আরেকটি উদ্বেগের বিষয়। কেউ তাই ফ্লুতে আক্রান্ত হলে সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করে যাতে অন্যরা আক্রান্ত না হয়।

স্বাস্থ্য ঝুঁকি
গরমের সময় জাপানে আর্দ্রতা অনেক বেড়ে যায়। খাদ্যদ্রব্য দ্রুত নষ্ট হয়ে ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়। সে কারণে হাইজিনকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়।

বৌদ্ধ ধর্মে পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব অনেক। বিশেষ করে রান্না আর পরিচ্ছন্নতা আধ্যাত্মিক বিষয় বলে বিবেচিত হয়। বৌদ্ধ ধর্ম আসার আগে থেকে জাপানিদের একটি নিজস্ব ধর্ম আছে, তা হলো - শিনতো। এর মূল মর্মবাণীই হলো পরিচ্ছন্নতা।

ধর্মীয় পরিশুদ্ধতা
বৌদ্ধ ধর্মে পরিচ্ছন্নতার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে জাপানিরা এটি এমনিই চর্চা করেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটা আপনাকে পরিশুদ্ধ করে ও সমাজের জঞ্জাল থেকে মুক্ত রাখে। সে কারণেই জাপান এতো পরিচ্ছন্ন। শিনতো উপাসনালয়ে আসার পর ভক্তরা শুরুতেই হাত ও মুখ ধৌত করেন। এমনকি অনেক জাপানি তাদের নতুন গাড়িও উপাসনালয়ে নিয়ে যায় পরিশুদ্ধ করাতে ধর্মযাজকের মাধ্যমে।

আপনি যদি জাপানে বাস করতে শুরু করেন কিছুদিনের মধ্যে আপনিও পরিচ্ছন্ন জীবনধারা আত্মস্থ করে ফেলবেন।


সর্বশেষ সংবাদ