ডিএনএ অবতার (সায়েন্স ফিকশন সমগ্র) পর্ব-০৪

প্রতীকি ছবি
প্রতীকি ছবি  © ফাইল ফটো

একটু ভিন্ন প্রকৃতির এলাকা এটি। অনেকটা নির্জন। এই একটি এলাকা নিয়েই একটি গ্রাম। গ্রামের একটি সুন্দর নাম আছে। নীলমণির চর। গ্রামটির ভৈাগোলিক অবস্থানই এর নামকরণের সার্থকতা বহন করে। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে দূরবর্তি একটি প্রত্যন্ত গ্রাম হল নীলমণির চর। আধুনিক জন জীবন থেকে আলাদা। সেখানে যাওয়াটাও অনেকটা দূর্ভেদ্য।

বছরের আট মাসই এলাকাটি পানির সাথে জল খেলায় মত্ত থাকে। অর্ধ ডুবন্ত থাকে। যেন সত্যিই সাঁপের মাথায় বসানো ভয়ংকর সুন্দর “নীলমণি”। এর আশে পাশের গ্রামগুলোর নামও বিচিত্র, যেমন-এর পূর্বে “নাগমণির চর”, পশ্চিমে “মনসার লীলা”, আর উত্তরে ‘শালুকপুর’। দক্ষিণের গ্রামটার নাম বিচিত্র নয়, অদ্ভূত। এর নাম “ঠ্যাডার জঙ্গল”। সবগুলো গ্রামই নির্জন আর নিরিবিলি। মানব বসতি খুব একটা নেই। এসব গ্রামের নিচু জমিতে প্রচুর সাপের বসবাস।

গ্রামগুলোর ভূ-প্রকৃতি নিচু। ঝোঁপ-ঝাড়ে ভরপুর। নীলমণির চরের মত অন্যান্য গ্রামগুলোয় জন-বসতি কম। আধুনিক সভ্যতা থেকে অনেক দূরে এদের অবস্থান। এক সময় এ অঞ্চল দিয়ে বয়ে ‍গিয়েছিল বিশাল এক প্রমত্তা নদী। কালের বিবর্তনে নদীটি গতিপথ পরিবর্তন করে আরও দক্ষিণে সরে গেছে। নদীটির নাম ‘নরসুন্দা’। মানুষের ক্রমান্বয়ে পরিবেশ দূষণের ফলে প্রকৃতির কাছে যৌবন বিলিয়ে দিয়ে আজ মৃতপায় নরসুন্দা। তবে গ্রামগুলোর নামকরণ নিয়ে এলাকার বাসিন্দাদের মুখে অনেক কল্প-কাহিনী শুনা যায়। তাদের ধারণা, পৃথিবীর সেরা সেরা দৈত্য আর দানবেরা বাস করে এসব গ্রামের জঙ্গলগুলোতে। রাতের বেলায় যখন এসব জঙ্গলে শিয়াল মামারা প্রতিযোগিতা করে ডাকে, তখন গ্রামের ছোট্ট বাচ্চারা ঘুমায়। শিয়ালের ডাকই এদের ঘুম পাড়ানি গান।

জলাবদ্ধ গ্রামগুলো যেন ছোট্ট একটা আমাজান। জলাভূমিগুলোতে প্রচুর শালুক জন্মে। সেই সাথে কুচুরিপানা। হাঁটু-সামন কাঁদা পানির সঙ্গমে এখানের ভূমি চোরাবালির মত আচরণ করে। আয়তনে ‍পৃথিবীর পঞ্চম বৃহ্ত্তম দেশ ব্রাজিলের আমাজান জঙ্গলে এরকম একটি এলাকা আছে যা পুরো ইংল্যান্ডের চেয়েও বড়। তার মানে আমাদের বাংলাদেশ থেকেও বড়। আমাজানের সেই জলাবদ্ধ এলাকায় বিশ-পচিশ ফুট লম্বা লম্বা পাইথন (বড় অজগর) থাকে। আর নীলমণির চরের জলাভূমিতে থাকে বিচিত্র প্রজাতির সাঁপ। বর্ষাকালে যখন চারিদিক পানিতে থই থই করে, সাঁপগুলো তখন মানুষের বাড়ি-ঘরে উঠে। সুযোগ বুঝে তারা মানুষের গৃহ পালিত হাঁস-মুরগির উপর হামলা করে। স্থানীয় মানুষজনও সাঁপদের এরকম বিচরণে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছে। মূলত এসব সাপের নামানুসারেই এখানকার গ্রামগুলোর নামকরণ হয়েছে বলে আন্দাজ করা যায়। জামাল সাহেবের খাটের নিচেও দু’টি বড় বড় গর্ত। এগুলো সাঁপের গর্ত না ইদুরের গর্ত তা নিয়ে জামাল সাহেবের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তিনি যখন রাতের বেলায় ঘুমের মাঝে বিড় বিড় করে কথা বলেন, তখন এই গর্ত দু’টো থেকেও ফোঁস ফোঁস আওয়াজ আসে।

জামাল সাহেব খুব বেশি চিন্তিত। অদ্ভূত লোক দু’জন নিজেদেরকে এলিয়েন না বল্লেও ধরেই নিতে হয় তারা এলিয়ে প্রকৃতিরই কেউ হবে। না হলে তারা দীর্ঘকাল মাহাকাশে থাকার কথা বলবে কেন? অদ্ভূত তাদের আচরণ! বাংলায় কথা বলে। বাংলাদেশ থেকে কেউ তো এখনও মহাকাশে যায়নি। তাহলে এরা বাংলা শিখল কিভাবে? আবার পাসপোর্ট অফিসের কথা বলে তারা উধাও হয়ে গেল। পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে তারা না জানি কি কান্ড ঘটিয়ে ফেলে কে জানে। জড়ো হওয়া লোকজনের সবাই একে অপরের সাথে আলাপ করতে করতে সরে পড়ল। শুধু জামাল সাহেব একা বসে রইলেন ঘরের বারান্দায়। অপেক্ষা করছেন তিনি। লোক দু’টো হয়তো তার কাছে ফিরে আসবে। আজ অফিসে যাবেন না তিনি। যা হবার হোক। তবুও এর শেষ দেখে ছাড়বেন। গভীর চিন্তায় মগ্ন জামাল বাবু।

এটা দুশ্চিন্তা। তার মনে একটা কথাই বার বার ঘুরে ফিরে আসছে। অদ্ভূত লোক দু’জন তাকে কেন পছন্দ করবে? তিনি দেখতেও তো তেমন সুবিধের নয়। খুবই বিশ্রি। গায়ের রং কুচ ‍কুচে কালো। মুখমন্ডল কুৎসিত। তার উপর তিনি একা মানুষ। বিয়ে করেন নি। মেয়ে মানুষ সহ্য করতে পারেন না। তবে একবার নাকি বিয়ে করতে গিয়েছিলেন হাওড় অঞ্চলে। বিয়ের দিন নাকি কনে কাঁদতে কাঁদতে দু’বার অজ্ঞান হয়ে যায়। তা দেখে জামাল সাহেব বিয়ের আসর থেকে চলে আসেন। তার ধারণা এটা দুটি কারণে হতে পারে। এক- তার (জামাল সাহেবের) চেহারা এতই ভয়ংকর যে তাকে দেখে কনে ভয় পেয়েছে। দুই- যে সব মেয়েরা বিয়ের দিন কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যায়, তাদের অন্য জায়গায় সম্পর্ক থাকে। কবুল না বলেই জামাল সাহেব চলে এসেছিলেন বিয়ের আসর থেকে। তারপর আর বিবাহ করা হয়নি তার। বিয়ে করা নিয়ে এলাকার লোকজনের ভেতর খানিকটা বিতর্ক আছে। কেউ বলে তিনি বিবাহ করেছিলেন। কেউ বলে করেন নি। জামাল সাহেবের প্রতিবেশি অমল বাবুর স্ত্রী ফুলবাসীর ধারণা তিনি (জামাল সাহেব) গোপনে সংসার করছেন। পরিবার কিশোরগঞ্জ শহরে থাকে। তবে এতে কারো তেমন কোন সমর্থন নেই।

এতসব কিছু চিন্তা করেও জামাল বাবুর মনে ঘুরে ফিরে সেই অদ্ভূত দু’জন লোকের কথায় আসছে বারবার। কে তারা?

জামাল সাহেব একটু পেছনের জীবনে ফিরে গেলেন। যৌবনে তারা এলিয়েনদের নিয়ে কতই না কল্প-কাহিনী পড়েছেন। বর্তমানে তিনি চল্লিশোর্ধ ব্যক্তি। ছোট বেলা থেকেই তিনি এলিয়েনদের ব্যাপারে একটু দূর্বল। বেশ আগ্রহী। না হলে এখনও তিনি এলিয়েনদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেন কেন? কিশোরগঞ্জ গভর্মেন্ট বয়েজ স্কুলে পড়ার সময় তিনি পড়েছিলেন অনেকগুলো সায়েন্স ফিকশনধর্মী বই। সেসব বইয়ের কোন একটিতে তিনি পেয়েছিলেন মহাকাশে এলিয়েন থাকার একটা সমীকরণ। আজও মনে আছে তার সেই সমীকরণটি। সমীকরণটির নাম হল “ড্রেকের সমীকরণ”। সমীকরণটির বিষয়ে আমরা পড়ে জানব। তার আগে এলিয়েনদের নিয়ে কিছু জানা-অজানা কথা শুনা যাক।

‘এলিয়েন’(Aliens) বা ভিনগ্রহের প্রাণি বলতে পৃথিবীর বাইরে মহাকাশের অন্য কোন স্থানের প্রাণকে বুঝায়। এসব প্রাণি পৃথিবী ভিন্ন কোন গ্রহে বা উপগ্রহে বাস করতে পারে যেগুলো পৃথিবী থেকে কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ বা কয়েক কোটি আলোক বর্ষ দূরে অবস্থিত। আবার সৌরজগতের অতি কাছেও হতে পারে। আলোক রশ্মি এক বছরে যে পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে বলে “এক আলোক বর্ষ”। আলো বা আলোক রশ্মির গতিবেগ সেকেন্ড এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। সাধারণভাবে এর মান 3x108 ধরা হয়।

অনেকের ধারণা এ প্রাণযুক্ত প্রাণির দেহ মানুষের আকৃতির। আসলে তা ঠিক নাও হতে পারে। পৃথিবীর সীমানার বাইরে যে কোন প্রকার প্রাণি এমনকি অতি ক্ষুদ্রাকার ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াও এলিয়েনদের তালিকায় থাকতে পারে। আবার কোন প্রাণির DNA (Di-oxi Ribo Nuclic Acid) কেও এলিয়েন বলে সনাক্ত করা যেতে পারে। ইংরেজি Aliens শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হল ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ বা ‘অনাহুত আগন্তুক’।

মহাবিশ্ব হল একটি রহস্যজালের আঁধার। এতে রয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি বা তারকামন্ডল। এসব তারকামন্ডলের আরেক নাম ছায়াপথ। এসব কোটি কোটি ছায়াপথের মাঝে একটি ছায়াপথের নাম ‘আকাশ গঙ্গা’ যেখানে আমাদের পৃথিবীর বসবাস। আকাশ গঙ্গার আরেক নাম ‘মিল্কিওয়ে’। আর এই আকাশ গঙ্গার কোটি কোটি সৌরজগতের ভীড়ে আমাদের সৌরজগতও একটি। এসব সৌরজগতে অসংখ্য তারকা বা নক্ষত্র অবিরাম মিট মিট করে। চোখের পাতার মত পিট পিট করে। জ্বল জ্বল করে। উজ্জল-অনুজ্জল তারা। এদের মধ্যে আমাদের সূর্যও একটি নক্ষত্র। পৃথিবীতে যে কিনা সকল শক্তির উৎস। আমাদের সৌরজগতের মত অগণিত সৌরজগৎ থাকার আশংকা থেকেই বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা আশংকা করেন যে পৃথিবীর বাইরেও প্রাণ থাকতে পারে। এসব বিজ্ঞানীরদের মধ্যে স্টিফেন হকিংস এবং কার্ল সোগানের নাম উল্লেখযোগ্য। তারা মনে করেন যে যেহেতু মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল, সেহেতু এর সৌর জাগতের বাইরে প্রাণ থাকার সম্ভাবনাও বেশি।

অনেকে প্রথিবীর বাইরে প্রাণের প্রমাণের জন্য বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে দেখা যাওয়া UFO(=Un-identified Flying Object=অচেনা উড়ন্ত বস্তু)’র কথা বলেন। তবে বেশিরভাগ UFO কেই পৃথিবীসৃষ্ট আকাশযান অথবা কোন মহাজাগতিক বস্তু বা দেখার ভুল হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়।

এছাড়াও আর্জেন্টিনার উত্তর-পচিমাঞ্চলে সাগরপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ৭০০ মিটার (১৫হাজার ৪০০ ফুট) উপরে লেক ডায়মান্ট নামক হ্রদে ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। এ আবিষ্কার থেকে ভিনগ্রহে প্রাণের ব্যাপারে সূত্র পাওয়া যেতে পারে। কেননা হ্রদটির কাছেই রয়েছে মাইপো আগ্নেয়গিরি। এখানে কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেনের প্রকট অভাবেও বেঁচে আছে। এর আগে বিরুপ পারবেশে টিকে থাকা ‘এক্সট্রিমোফিলস’ নামক ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু ’পলিএক্সট্রিমোফিলস’ নামক ব্যাকটেরিয়া চরম বৈরি পরিবেশে টিকে থাকতে সক্ষম। ওই হ্রদে আর্সেনিকের নিরাপদ মাত্রার চেয়ে ২০ হাজার গুণ বেশি মাত্রা রয়েছে। তাপমাত্রা প্রায়ই শূণ্যের নিচে নামে। কিন্তু অতিরিক্ত লবণক্ততার কারণে বরফ জমাট বাঁধেনা। এ আবিষ্কার নিঃসন্দেহে ভিনগ্রহের বৈরি পরিবেশেও প্রাণের অস্তিত্তের পক্ষে রায় দেয়।

এতসব চিন্তা করতে করতে জামাল সাহেব ঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন। ক্লান্ত দেহ তার। ঘুমের মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখছেন। দেখছেন তার পাশে একটা খাটিয়া। খাটিয়ায় একটা মরা লাশ। পুরুষ মানুষের লাশ। তবে লাশ কথা বলে। জামাল সাহেব সে প্রশ্ন করল- হাই মামু, কেমন আছুইন?

জামাল সাহেব বেশ রাগান্বিত হয়ে উত্তর দিলেন- ভালা নাই। মুশকিলে আছি। তর কী খবর?

লাশ আবার উত্তর করল- খবর নাই মামু। কবরে যামু। কাফন ফইরা ফুইত্তেয়া রইছি।

-- তুই মরছছ কেল্লাইগ্গেয়া?

-- জন্ডিজ অইছিল।

-- ডাক্তার দেহাছনাই।

-- না । সময় পাইনাই মামু।

-- কেন? সময় পাস নাই কেন? কি কাজ করতি?

-- কি আর করবাম। খালি মদ আর গাঁজা টানছি।

-- তাইলে তো তোমার লিভারে সমস্যা ছিল।

-- ধুর মামু! কথা না বাড়াইয়া একটা বিড়ি দেইন। নাক দিয়া ধোঁয়া ছুডামু।

এবার জামাল সাহেব চেতে গেলেন। কর্কশ কন্ঠে বল্লেন- বেয়াদ্দব! আমি বিড়ি খাইনা। আমারে মামু ডাকস কেড়ে? আমি কি তোর মামু লাগিরে হারামজাদা।

একথা শুনে লাশও উত্তেজিত হয়ে গেল। সেও বলল- তাইলে সরে দাড়ান। আমারে নিতে লোকজন আইতাছে। তয় শুনেন। আপনার কানে কানে একটা কথা বলি।

জামাল সাহেব কিছু না বলে তার মুখখানা মরা লাশের মুখের কাছে নিলেন। মরা লাশ কোন কথা না বলে জামাল সাহেবের কানে জোড়ে একটা কামড় বসিয়ে দিল। একেবারে দাঁত বিধিয়ে দিল। জামাল সাহেব বুক ফাটানো চিৎকার দিয়ে উঠলেন। চিৎকার করে বল্লেন- আ----আ--- ওফফফ রে! জানোয়ারের বাচ্চা। আমার কানডা খাইয়্যা লাইলো। ও-- বা --- বা---রে!

আচমকা লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন জামাল সাহেব। তার ঘুম ভেঙে গেছে। আশে পাশে কেউ নেই। বেলা অনেক গড়িয়েছে। চোখ কচলাতে কচলাতে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। দেখলেন তার সামনে সেই অদ্ভূত লোক দু’জন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চাহনি অদ্ভূত। চোখের মনি নেই। সাদা-শুভ্র চোখ। একজন হাত তুলে ইশারায় জামাল সাহেবকে সালাম দিলেন। (চলবে)।

 

লেখক: প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নোয়াখালী সরকারি কলেজ


সর্বশেষ সংবাদ