নজরুলের তাৎক্ষণিক কাব্য প্রতিভা ও হাস্যরসাত্মক গল্প

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।  © সংগৃহীত

আজ ১২ ভাদ্র। সাম্য,  মানবতা, দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৩ তম প্রয়াণ দিবস। আজকের দিনে নশ্বর পৃথিবীর মায়া তুচ্ছ করে দীর্ঘদিন রোগে শোকে ভুগে পরপারে পাড়ি জমান নজরুল। তিনি  সৈনিক, যাত্রা দলের সদস্য এবং রুটির দোকানের শ্রমিক হিসেবে ছোটবেলায় দুখু মিয়া হয়ে নিজের কষ্টের জীবন অতিবাহিত করেছেন। কলম হাতে নিয়ে গেয়েছেন মানবতার জয়গান। উপাধী পেয়েছেন বিদ্রোহ কবি হিসেবে। অসংখ্য গান লিখে হয়েছেন গানের পাখি বুলবুল। পেয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা। কবির কাব্য প্রতিভা ছিল অসংখ্য অনন্য গুণে মহিমান্বিত ও উদ্ভাসিত। নজরুল বেশিদিন লিখতে পারেননি।  তিনি লিখেছিলেন মাত্র ২৩ বছর। এ ২৩ বছরে নজরুল বাংলা সাহিত্যকে করেছেন বেশ সমৃদ্ধ ও ঋদ্ধ। একসময় তিনি মারাত্মক অসুস্থ-ই হয়ে পড়লেন। জীবনের ৪২ টি বছর গেল এ অসুস্থতায়। এ দীর্ঘ সময় ছিলেন তিনি লেখালেখি থেকে নিবৃত্ত। নজরুল তাৎক্ষণিক ভাবে মুখে বা লিখে  কবিতা ও ছড়ার শৈলী বিন্যাসে ছিলেন দারুণ সিদ্ধহস্ত। এমনি কয়েকটি খন্ড চিত্র ও তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া হাস্যরসাত্মক কিছু গল্প নিয়ে আজকের এ লেখা।

নজরুলের জীবনের কিছুটা সময় কেটেছে কুমিল্লায়। সেই নার্গিসের কথা তো আমরা কমবেশি সকলেই জানি। আজ কুমিল্লার নার্গিস কথা নয়। অন্য গল্প। ১৯২১ সালে কুমিল্লায় কাজী নজরুল ইসলাম ইন্দ্র সেনগুপ্তের বাড়িতে ছিলেন। একদিন জানালা খুলে তিনি দেখেন অঞ্জলি নামে ছোট একটি মেয়ে পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। কবি ভাবলেন গাছে হয়তো কেউ আছে তার সঙ্গে মেয়েটি কথা বলছে। সে হয়তো তাকে পেয়ারা দিচ্ছে না। নজরুল বের হয়ে গাছের কাছে গিয়ে উপরে তাকিয়ে দেখেন কেউ নেই গাছে। জিজ্ঞেস করলেন, কার সঙ্গে কথা বলছো? অঞ্জলি তখন মজা করে বলল, ওই দুষ্টু কাঠবিড়ালিটার সঙ্গে। অঞ্জলি অনেকটা অনুযোগের সুরে বলল প্রতিদিন পেয়ারা খেয়ে পালিয়ে যায় দুষ্টু কাঠবিড়ালী একটা পেয়ারাও আমাকে খেতে দেয় না। নজরুল অঞ্জলি ও কাঠবিড়ালীর সেই ঘটনা নিয়ে লিখলেন ‘খুকি ও কাঠবিড়ালী’ নামের জনপ্রিয় ছড়াটি।

কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?-
 ডাইনি তুমি হোঁত্কা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
বাতাবি-নেবু সকলগুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও


একদিন শিল্পী আব্বাসউদ্দিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে কাজী নজরুল ইসলামকে পেলেন না। না পেয়ে তিনি সকালে তার বাসায় গেলেন। বাসায় গিয়ে দেখলেন কাজী নজরুল ইসলাম গভীর মনোযোগ দিয়ে তার লেখনি চালিয়ে যাচ্ছেন। কোন কথা না বলে নজরুল ইশারায় আব্বাসউদ্দিনকে বসতে বললেন। আব্বাস উদ্দিন দীর্ঘক্ষণ  ধরে  বসে থাকার পর জোহরের নামাজের সময় হলে তিনি যেতে উদ্যত হলেন। নজরুল বললেন ‘কি খুব তাড়া আছে নাকি ,যেতে হবে?’ আব্বাসউদ্দিন বললেন “তেমন কিছু না, তবে আমার জোহরের নামাজ পড়তে হবে। আমি এসেছি একটা ইসলামি  গজল নেবার নিমিত্তে। নামাজ আদায়ের কথা শুনে নজরুল তাড়াতাড়ি একটি পরিস্কার চাদর নামাজের জন্য বিছিয়ে দিলেন। আববাস উদ্দীন জোহেরর নামাজ শেষ করে ফেললেন। নজরুল সাথে সাথে আব্বাস উদ্দিনের হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন ‘এই নাও তোমার ইসলামি গজল।’ আব্বাস উদ্দিন অবাক দৃষ্টিতে  দেখলেন তার নামাজ পড়তে যে সময় লেগেছে ঠিক সেই সময়ের মধ্যে নজরুল পুরোপুরি একটি নতুন ইসলামি গজল লিখে ফেলেছেন। সেই গানটি পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়েছিল। বিখ্যাত সেই গজল, 

“হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ
দিলাম তোমার চরণ তলে হৃদয় জায়নামাজ।
আমি গোনাহগার বে-খবর
নামাজ পড়ার নাই অবসর
তব, চরণ-ছোওয়ার এই পাপীরে কর সরফরাজ।।
তোমার অজুর পানি মোছ আমার পিরহান দিয়ে
আমার এই ঘর হউক মসজিদ তোমার পরশ নিয়ে
যে শয়তান ফন্দিতে ভাই
খোদার ডাকার সময় না পাই
সেই শয়তান থাক দূরে (শুনে) তকবীরের আওয়াজ
হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ।।”   


কবি নজরুল ইসলাম ছোটবেলায় যখন আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ করতেন। তখনও তিনি বড় মাপের কবি হননি। তিনি রুটি বানাতে গিয়ে তৎক্ষণাৎ ছড়াও বলে ফেলতেন। সেই সময় আটা মাখছেন আর  কিশোর নজরুলের গা বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছিল। সেই সময় ছড়া কাটলেন তিনি,

 ‘মাখতে মাখতে গমের আটা, 
 ঘামে ভিজল আমার গা-টা।

কোনো একদিন নজরুল ইসলাম সিরাজগঞ্জে গিয়েছিলেন আসাদ উদ্দৌলা সিরাজীর বাসায়। খাবার দাবার শেষ হবার পর নজরুলকে দই দেয়া হলো। কিন্তু সে দই  টক হয়ে গিয়েছিল।  দই সম্ভবত আগে ভাগেই নিয়ে আসাতে এরকম নষ্ট হয়ে টক হয়েছিল। টক দই খেয়ে নজরুল আসাদ উদ্দৌলার দিকে তাকিয়ে চোখে-মুখে অদ্ভূত ভঙ্গি করে অনেকটা মজা করে বললেন- ‘তুমি কি এই দই তেতুঁল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে আনলে নাকি? একথা শুনে সবাই তো হেসে খুন। 

কাজী নজরুল ইসলাম গান রেকর্ডিংয়ের জন্য কলকাতায় তখন গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একদিন তিনি গ্রামোফোনের অফিসে দোতলায় বসে আছেন। সেইসময় এক কমর্চারী এসে বললেন, ‘কাজীদা, ইন্দুদি (সঙ্গীতশিল্পী ইন্দুবালা) আপনাকে নিচে ডাকছেন।’ এ কথা শুনে নজরুল কৌতুকের সুরে মজা করে  বললেন, ‘আর কত নিচে নামব, ভাই?

কবি নজরুল তখন মোসলেম ভারত পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। পত্রিকাটির তখন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। কলকাতার এক বাদ্যযন্ত্র ব্যবসায়ী এলেন কবির কাছে। আবদার করলেন  কবিকে একটি বিজ্ঞাপন লিখে দিতেই হবে। কোম্পানির নাম ডোয়াকিন অ্যান্ড সন্স কোম্পানি। হারমোনিয়াম কোম্পানি আর কি। কবিও তক্ষুণি কাগজ-কলম নিয়ে লিখে ফেললেন সেই সময়ের আলোচিত বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটি ছিল এমন, 

কী চান? ভালো হারমোনি?
কাজ কি গিয়ে-জার্মানি?
আসুন দেখুন এইখানে,
যেই সুর যেই গানে,
গান না কেন, দিব্যি তাই,
মিলবে আসুন এই হেথাই,
কিননি কিন, ডোয়ার কিন। 

ছোটদের জন্য পাঠ্য পুস্তক লিখতেন আলী আকবর নামে একজন ব্যক্তি। তো আলী আকবর একদিন নজরুল ইসলামকে তার একটি পান্ডুলিপি দেখিয়ে মতামত জানতে চাইলেন। পুরো পান্ডুলিপিটি পড়ে নজরুল বললেন, আপনার পান্ডুলিপির ছড়াগুলো ছোটদের পাঠের  উপযোগী হয়নি। নজরুল বললেন যদি আপনি চান তো আমি একটা ছড়া আপনাকে  লিখে দিতে পারি। তিনি অনুরোধ করলেন নজরুলকে একটি ছড়া লিখে দেয়ার জন্য। নজরুল ইসলাম দু’খিলি পান মুখে ভরে লিখলেন সেই বিখ্যাত লিচু চোর ছড়া, 

বাবুদের তালপুকুরে 
হাবুদের ডালকুকুরে 
সেকি বাস করলে তাড়া 
বলি থাম, একটু দাড়া। 

পুকুরের ঐ কাছে না 
লিচু এক গাছ আছে না 
হঠা না আস্তে গিয়ে 
য়্যাব্বড় এক কাস্তে নিয়ে।

গাছে গিয়ে যেই চড়েছি 
ছোট এক ডাল  ধরেছি,
ও বাবা মড়াত করে 
পড়েছি সরত জোরে।

মেধা মননশীলতা, সৃজনশীলতা বিকাশে নজরুল বাংলা সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। নজরুলের বাংলা সাহিত্যে আগমন ছিল ধুমকেতুর মতো তার প্রস্থানটাও ছিল খুব কষ্টের অভিমানের সেই ধুমকেতুর মতোই। আজ এই কবির প্রয়াণ দিবসে মনে পড়ে গেল তারই লেখা একটি কবিতার কয়েকটি ছত্র,

'যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনা, আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি-আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি আমি নেতা হতে আসিনি,আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলামনা বলে আমি এই প্রেমহীন নীরব পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম। যেদিন আমি চলে যাব সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা কত কবিতা হয়ত বেরুবে আমার নামে, দেশপ্রেমিক-ত্যাগীবীর-বিদ্রোহী বিশেষণের পর বিশেষণ, টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পর মেরে, বক্তার পর বক্তা এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে-বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো, তোমার আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটা ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি।'

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক