ডিএনএ অবতার (সায়েন্স ফিকশন সমগ্র) পর্ব-০২

  © সংগৃহীত

ছোট্ট একটি এলাকা। নির্জন। নিরিবিলি। বাড়ি ঘর গোটা তিরিশেক। এই তিরিশটি বাড়ি নিয়েই একটি গ্রাম। গ্রামের নাম পরে বলব। গ্রামটির অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য অন্যান্য গ্রাম থেকে স্বতন্ত্র। এ গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। তবে মাঝে মাঝে গ্রামবাসী রাতের বেলায় তীব্র আলোর ঝাপটা দেখতে পায়। এই আলোর উৎস সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারেনা। সবাই ভাবে ব্যাপারটা ঐশ্বরিক বা দ্বৈবিক। যেমনটা আজ রাতেও সবাই দেখেছে। গ্রামটিকে ঘিরে রয়েছে ছোট বড় ফসলের খেত। চৈত্র-বৈশাখ মাস ছাড়া সারা বছর এ খেতগুলোর সমাবেশে বিলের আকৃতি ধারণ করে এখানকার করে নিচু জমিগুলো। তবে এখন চৈত্রের আগুনঝরা রোদের গরম শ্বাসে খেতগুলোর বুক চিরে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফোটলগুলোর গভীর থেকে গরম বাতাস ত্যাগ করে আর্তনাদ করছে ভূ-প্রকৃতি।

একটা সরু রাস্তা এসে মিশেছে অনেক দূর থেকে যেখানে অনন্তপুর বাজার অবস্থিত। সেই অনন্তপুর বাজারের ভূমি অফিসে চাকুরী করেন জামাল সাহেব। তার পুরো নাম জনাব জামাল উদ্দিন আহমেদ, পদে ভূমি অফিসের কেরানী। আজ তিনি বেতন পেয়েছিলেন। রাতের এমন অদ্ভুত ঘটনার সময় হুরাহুরি করে বেরুতে গিয়ে টাকাগুলো আনতে তার মনে ছিলনা। তাই ভয়ে চিৎকারের পাশাপাশি টাকগুলোর জন্যও হায় হুতাশ করেছেন। তার পরনে শুধু একটা লুঙ্গি। তার মত অনেকই আজ শুধু লুঙ্গি পড়ে বেরিয়েছে। অমল বাবুর পরনে শুধু একটা গামছা। ছোট্ট একটি নেংটির মত ঝুলে আছে সেটা।৷

সবাই তখনও ছুটছে। এক একটা ঝাঁকুনি দেয় আর সবাই হু হু করে চিৎকার দিয়ে এদিক ‍ওদিক ছুটে পালায়। ঝাঁকুনি থামলে আবার ফিরে আসে এক জায়গায়। হঠাৎ ঝাঁকুনি থেমে গেল। লোকজন সব থমকে দাঁড়াল। তবে এবার আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটল। কারও টর্চ জ্বলছেনা। যতই টিপা টিপি করুক সবাই, টর্চ তার চোখ মেলছেনা। জামাল সাহেব তার পাঁচ ব্যাটারির টর্চের ব্যাটারিগুলো খুলে সেগুলোকে তার লুঙ্গির সাথে কয়েক ঘষা দিয়ে আবার টর্চে লাগালেন। তাতেও কোন কাজ হলোনা। তার দেখা দেখি সবাই এরকম করল বটে, কিন্তু টর্চ তার অন্ধত্ব গোছাতে পারছেনা। তাতে কোন সমস্যা হচ্ছেনা আপাতত। এরই মধ্যে সূর্যের আভা দেখা গেল আকাশের পূর্ব কিনারে। সুবেহ সাদেক। জামাল সাহেব খেয়াল করলেন তার ঘড়ির তিনটি কাঁটাই অচল। অটল। সেগুলোও নড়ছেনা। বোবা হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপার কি? সবারই একই অবস্থা। এতক্ষণ মাটির ঝাঁকুনিতে সবাই নাজেহাল ছিল। এবার মুহূর্তের এই আজব আচরণে বিচলিত সবাই। এ গ্রামের কারই মোবাইল নেই। থাকলে হয়তো দেখা যেত সেটার স্ক্রিনও ঝাপসা হয়ে আছে। এলিয়েনরা আসলে এরকমটা ঘটে থাকে। জামাল সাহেব ছাত্র জীবনে বহু সায়েন্স ফিকশন ধর্মী গল্প আর উপন্যাস পড়েছেন। তাই তার এমন আন্দাজ হচ্ছে। সন্দেহ হচ্ছে।

তার আন্দাজে ছেদ পড়ল এবার। বিস্ময়ের ভেতর থেকে বিস্ময় জন্ম নিল। আন্দাজকে পরাজিত করে যে সত্য মূর্তমান হয়ে দেখা দিল তা এতদিন জামাল সাহেবের কল্পনাতেও আসেনি। আসার কথাও না। উনি দেখলেন যে উনার হাতের ঘড়ির কাঁটাগুলো সব উল্টোভাবে ঘুরছে! যে টর্চ লাইটটি নিভে গিয়েছিল, যাকে জ্বালানো যাচ্ছিলোনা, সে টর্চ লাইটটি জ্বলছেই তো জ্বলছেই! বরং সুইচ চপলে সেটা নিভে। আর সুইচ ছেড়ে দিলে সেটা জ্বলে। অর্থাৎ স্বাভাবিক নিয়মের বিপরীত। আগে সুইচ টিপলে আলো জ্বলত, ছেড়ে দিলে নিভে যেত। এখন উল্টো স্বভাবে সেটা নিজের অস্তিত্বকে নতুন করে উপস্থাপন করছে। এবার আলোর উজ্জ্বলতা আগের চেয়ে অনেক বেশি। অনেক উজ্জ্বল।

জামাল সাহেবের কান দু’টি খাড়া হয়ে গেল। ঘন ঘন দম নিচ্ছেন। চোখযুগল ছোট থেকে বড় আবার বড় থেকে ছোট হয়ে আজব অভিব্যক্তি প্রকাশ করল। ঠোঁটগুলো কাঁপতে কাঁপতে মূল দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টায় উন্মাদ আজ। হৃদপিণ্ডটা ধুক ধুক আওয়াজ বাড়িয়ে দিয়ে ভয়ের সঞ্চার করে রক্তের ধমনী-শিরার ভেতর গরম বাতাস বিদীর্ণ করে জামাল সাহেবকে জটিল পরিস্থিতির শিকার হতে বাধ্য করল। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ভাবের সাথে কারই ভাব জমলনা। সকলে ভিজছে। কিন্তু গায়ে মাখছেনা। মনোযোগ দিচ্ছেনা। অবশেষে আলো ফোটার সাথে সাথে বৃষ্টি তার পতন সমাপ্ত করে মাটিতে মিশে গিয়ে নিজ অস্তিত্ব বিলীন করে দিল।

রাতের ঘটনার উত্তাপের মধ্য দিয়ে সূর্যের আলোক রশ্মি যাত্রা করল এই পৃথিবীতে। দৃশ্যমান হচ্ছে চারপাশ। মানুষজন এখনও সবাই বাইরে। কেউ ঘরে যায়নি। ছোট্ট একটি এলাকা। মানুষজন সর্বমোট ৫০-৬০ জন। আশে পাশের দু’তিন মাইল কোন বাড়ি ঘর নেই। শুধু ফসলের খেত আর খেত। নিচু জমি। বর্ষাকালে এগুলো পানিতে ভরপুর থাকে।

একমাত্র জামাল সাহেবই এদের মধ্যে একটু লেখা পড়া জানা লোক। বলা যায় এলাকাটির একরকম হর্তা-কর্তা। হাতের ইশারায় এবং গলার ব্যবহারে সবাইকে ডাকলেন। জোরে হাঁক-ডাক দিয়ে বললেন- কেউ কিছু বুইজ্জুইন গো? এরহম ঘটনার মানে কী গো?

বৃদ্ধ বয়সী একজন লোক জবাব দিলেন- আল্লাহর গজব! গজব! আর কিছুনা।

সাথে সাথে বৃদ্ধ বয়সী আরেকজন মহিলা প্রশ্ন ছুড়লেন- গজব ফরব কোন দুঃখে? আমরা কি পাপী?

এবার বৃদ্ধ লোকটি কড়া ভাষায় বললেন- তুমি কথার মাঝখান দিয়া কথা কও কেড়ে? বোকা মেয়ে-ছেলে কোথাকার! চুপ থাক।

অমল বাবু তখনও গামছা পড়া অবস্থায়। তার মুখ দিয়েও কথা বেরুল এরকম করে- অসুর! অসুর! অসুরের দল বুঝি আমরারে দেইখ্যেয়া গেছে! আর থইতোনা। মা দুগ্গা কই রে মা? দুগ্গা দুগ্গা। রক্ষে কর।

জামাল সাহেব তৎক্ষণাৎ অমল বাবুকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন- আরে বেডা তুই গামছা ফইরা কেড়ে এহনও খাড়াইয়্যা রইচছ? যা লঙ্গি ফরগা।

এভাবেই সময় এগিয়ে চলল। কেউ বলল এটা কেয়ামতের লক্ষণ। কেউ বলল এটা জ্বীনদের উৎপাত। নানানজন নানান কথা বলতে লাগল। জ্বাজল্যমান টর্চ লাইটগুলো আচমকা ধপ করে নিভে গেল। ঘড়ির কাঁটাগুলোও পুনরায় সঠিক পথে চলছে। এতে করে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর রূপ ধারণ করল। লোকজন যে যা পারছে, যার মুখ ‍দিয়ে যা আসছে তাই বলছে। জামাল সাহেব সবার কথা থামিয়ে দিয়ে বললেন- কিছু একটা তো হইছেই। দিন বাড়তে থাকুক। সময় গড়াইতে থাকুক, বুঝা যাইবো। সবার সবার বাড়িত যাও। কাম কাইজ শুরু কর।

একে একে সবাই চলে গেল। জামাল সাহেব একা দাঁড়িয়ে রইলেন। পূর্বাকাশ লালে লাল হয়ে সূর্যকে স্বাগতম জানাচ্ছে। জামাল সাহেব সেই দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার মনে একটা ‘কিন্তু’ খেলা করছে। এর উত্তর তাকে বের করতেই হবে। আজকের ঘটনাটা বড্ড বেমানান। তার সন্দেহ কোন ভাবেই দূর হচ্ছেনা। এর পেছনে যৌক্তিকতা রয়েছে। রাতের ঘটনাটাই বড় যুক্তি। সকালের নির্মল বাতাস এসে জামাল সাহেবের উদ্দাম গায়ে দোলা দিয়ে যায়। ফসলের খেতগুলোতে ঢেউ খেলে যায়। শান্ত বাতাস। কোমড়ে হাত দিয়ে রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন জামাল সাহেব। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসলেন। তবে রাস্তা থেকে চোখ সরছেনা তার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সেদিকে। মনে হচ্ছে উনি কিছু একটা দেখছেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। হঠাৎ তার মনে পড়ল এখনওতো ফজরের নামাজ পড়া হয়নি। দ্রুত ওযু সেরে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। নামাজরত অবস্থায় টের পেলেন কেউ যেন তার আশে পাশে আছে। একটা নীরব অস্থিরত্বের ছায়া পড়ল তার উপর।

সালাম ফিরিয়েই জামাল সাহেব উঠে গেলেন নামাজ থেকে। চারপাশ ঘন ঘন চোখ বুলালেন। কই? কাউকেইতো দেখছেননা উনি। তাহলে নামাজের সময় কে এমন ঘুর ঘুর করছিল তাঁর চারপাশ? জামাল সাহেবের গায়ের লোমগুলো সজারুর কাঁটার ন্যায় খাড়া হয়ে গেল। কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত হলেন। চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করলে- কে? কেডা? কেডা তুই? আমার নামাজের সময় ডিসটার্ব করছ। ফাজিল।

বুক থেকে যখন শুকনা শ্বাস বের হয় নাক আর মুখ দিয়ে, তখন এক প্রকার হুম হুম আওয়াজ হয়। এরকমই আওয়াজ আসছে জামাল সাহেবের বাড়ির পেছন থেকে। জামাল সাহেব আরও জোরে ডাকলেন—বাইরইয়্যা আয় কইতাছি। মাইরা লামু। কেডারে তুই?

বুকে হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে আসল একটা লোক। জামাল সাহেবের প্রতিবেশী, নাম আইনুল। জামাল সাহেবের প্রশ্ন শুরু হল-

-- তুই কী আমার নামাজের সময় ডিসটার্ব করছিলি?

-- জে।

-- কি কারণে?

কোন উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ দম নিল সে। চোখ দু’টো তার এত বড় হয়ে গেছে যে দেখলে মনে হবে এই বুঝি সেগুলো আলাদা হয়ে ছিটকে পড়বে। চেহারায় ভয়ের ঢেউ দেখে মনে হচ্ছে যেন সে মৃত্যুদূত আজরাইল ফেরেশতার সাথে ধ্স্তাধস্তি করে কোন রকম বেঁচে এসেছে। জামাল সাহেব আবার ধমক দিলেন—

-- উত্তর দেসনা কেরে? কি অইছে তোর?

-- কি কইতাম জামাল ভাই, আমার যে দম বাইরোয়্যা যাইতাছে।

-- দম বইরইয়্যা যাওনের আগে কথাডা কইয়্যা ফেল বজ্জাত কোহানকার। ক দেহি কি হইছে?

-- দুইডা লোক।

-- কোন দুইডা লোক?

-- পশ্চিম দিক থেইক্কেয়া দুইডা লোক আইছে। জামা কাপড় নাই হেগোর শরীলে। তবে পুরুষ না মহিলা বুঝবার ফরিনাই।

জামাল সাহেব আচমকা নীরব হয়ে গেলেন। নীরবতার ভাষা তার চোখের ভেতর ডিগবাজি দিতে লাগল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগলেন- তাইলে কি আসলেই ঘটনা ঘটতে চলছে?

আইনুল বলল-- ভাইজান কি বলেন?

-- কিছুনা। লোকগুলান দেখতে কেমন রে আইনুল? আরেকবার ক দেহি।

-- বড়ই আজব! চুলগুলা পোকায় খায়া ফালাইছে। শরীরে জায়গায় জায়গায় ক্ষত। ভেতেরে গোসত দেহা যায়। হাত আর পা দুইডা খুবই পাতলা। গায়ের রং টিকটিকির চামড়ার মতন সাদা। আমার সামনে আইসা দাঁড়াইতেই আমার গায়ে ঝাঁকুনি শুরু হয়। ডরাইছিগো ভাইজান!

-- তর লাগে কেমনে দেহা অইল?

আইনুল একটু ইতস্ত করে বলতে লাগল-- গেছিলাম পশ্চিমের খেতে বাথরুম করতাম। পেট খালি করতাছিলাম। এমন সময় তারা আইসা হাজির। একজনের এক চোখ নাই। ভেতরে সাদা জায়গা থেকে রক্তের ফোটা পড়তাছে। ওয়াক! আমারে জিগায়- জামাল সাহেবের বাড়ি কোনডা?

আঁতকে উঠলেন জামাল সাহেব। বললেন- কি বলিস? বাংলায় কথা কয়?

-- জে। বাংলায় কথা কয়। আমি তোরার কোন কথার উত্তর দেইনাই। কোন রকম দইড়া ফালাইছি।

-- পানি খরচ করছ?

-- জে না।

-- যাহ। পরিষ্কার হইয়্যা আয়।

নাকে হাত দিয়ে আইনুলকে বললেন জামাল সাহেব। তার মধ্যে প্রথমে ছিল সন্দেহ। এখন সেটার সাথে ভয়ের সম্পর্ক তৈরি হতে লাগল শীতের চাদরের মত। তার নাম কেন জিজ্ঞেস করবে? এর কারণ কী?

দেখতে দেখতে আরেকজন লোক হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে আসল জামাল সাহেবের নিকট। তারই আরেক প্রতিবেশী ফজলু। সে চিৎকার করতে করতে বলল—ভাইজান পালান আফনি। আফনেরে মাইরা ফালাইব! আফনেরে খুঁজতেছে তারা! তাড়াতাড়ি ভাগেন! তাদের হাতে বাঁশের কইনচা (চলবে)


লেখক :- মোঃ মাহফুজুর রহমান,
প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ,
নোয়াখালী সরকারি কলেজ।


সর্বশেষ সংবাদ