ডিএনএ অবতার (সায়েন্স ফিকশন সমগ্র) পর্ব-০১

  © সংগৃহীত

জামাল সাহেব ঘুমের মাঝে বিড় বিড় করে কথা বলছেন। বাংলাতে নয়। ইংরেজিতে বলছেন- Again the day begins and I wait and wait and wait for my destiny. I cannot stop the time, but time always stops me. এ কথা বলে জামাল সাহেব চুপ করলেন।

এবার শুরু হল তার নাক ডাকা। নাক ডাকায় তিনি বেশ সেয়ানা লোক। নাক ডাকলে তার আশে পাশের অত্যান্ত বিশ মিটারের মধ্যে কেউ ঘুমাতে পারেনা। নাক ডাকা তো নয়! যেন উনি ইট ভাঙার মেশিন চালাচ্ছেন! নাক ডাকার গতি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। আওয়াজও হচ্ছে উঁচু মাত্রার। এবার মনে হল গভীর রাতে এই শান্ত-সুনিবিড় আর নির্জন বাড়িতে ট্রাক্টর চলছে। জামাল সাহেব হচ্ছেন সেই ট্রাক্টরের ড্রাইভার।

নাক ডাকা বন্ধ। আবার বিড় বিড় করে কথা বলছেন জামাল সাহেব। এবার বলছেন- My life and I cannot go together. Only life is going on. So, Who am I? এই প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?

আবার নীরবতা। নাক ডাকা আরম্ভ হল পুনরায়। এখন শুধু নাকই ডাকছেন না। সাথে মুখেও আওয়াজ করছেন। প্রথমে নাকে আওয়াজ। পরক্ষণই মুখে ফোঁস করে আওয়াজ করে বাতাস ছাড়েন। বাতাস ছাড়ার সময় শরীর দুলে উঠে। তখন বিছানায় ছোট খাটো ভূমিকম্প অনুভূত হয়। সে সময় জামাল সাহেবকে ঘিরে থাকা মশার ঝাঁক দিগ্বিদিক উড়ে পালায়। রাত তখন শেষ প্রহর অতিক্রম করছে। ভোর হতে বেশি দেরি নেই। পূর্বাকাশে সূর্যোদয়ের আয়োজন চলছে মহা সমারোহে। চৈত্রের ভ্যাপসা গরমের মাঝে হালাক ঝির ঝির হাওয়ার আগমন ঘটবে কিছুক্ষণ পর।

সাইন্স ফিকশন সমগ্র।

এই হাওয়াদের ঢেউ এক সময় ‘ভোরের হাওয়া’ নাম নিয়ে বইতে থাকবে পুরো গ্রামের উপর দিয়ে। গাছে গাছে পাখ-পাখালিরা ঘুমের দেশ পারি দিয়ে জেগে উঠবে অল্পক্ষণ পরেই। পাখা ঝাপটিয়ে আড়মোড়া দিতে দিতে ঘুম ভাঙানি ডাক দেয়ার প্রস্তুতি সারছে গ্রাম্য মোরগগুলো। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে নতুন করে নিজের অবস্থান জানাবে সে এই পৃথিবীকে। একটু পরেই অন্ধকারের গহবর থেকে আলোয় আসবে মাটির পৃথিবীর এই গোলার্ধ।

আবার বিড় বিড় করে কথা বেরুচ্ছে জামাল সাহেবের মুখ থেকে। এবার ঠোঁটের কাঁপন আগের চেয়ে বেশি। আগের প্রশ্নের উত্তর এলো। যথারীতি ইংরেজিতে বলছেন- I am the DNA (Di-oxi Ribo Nuclic Acid) of myself. It is constant and universal. So it is immortal!

জামাল সাহেব এবার হু হু করে হেঁসে উঠলেন। চোখ বুঁজে হাসছেন। হাসার সাথে সাথে তার সবগুলো দাঁতের নোংরা রঙের ঝিলিক দেখা গেল। উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন- পেয়ে গেছি! ইউরেকা! আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি! আমি হচ্ছি আমার ‘ডি এন এ’। মরার পরেরও আমার এ ‘ডিএনএ’ গুলো সতেজ থাকবে। হাশরের ময়দানে এই ‘ডিএনএ’ গুলো মিলেই আমার শারীরিক অবয়ব গঠিত হবে। হা হা! কী মজা! কী আনন্দ!

গুড়ুম করে একটা আওয়াজ হল। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি। তারপর আরও একবার ঝাঁকুনি। মনে হচ্ছে ভূমিকম্প। তবুও সন্দেহ হচ্ছে আধা ঘুম আধা জাগ্রত অবস্থায় বিচানায় শুয়ে থাকা জামাল সাহেবের। আরেকটা বড় ঝাঁকুনি হল। জামাল সাহেব বিছানা থেকে সরাসরি পড়ে গেলেন নিচে। শক্ত মাটিতে। এই বুঝি তার শরীরের মাংসগুলো থেতলে গেল। সব কিছু ভালোভাবে বুঝে ওঠার আগেই সজোরে চিৎকার শুরু করলেন তিনি। খানিকটা আহত অবস্থায় চিৎকার করতে করতে বাইরে বেরিয়ে এলেন। চেহারায় বীভৎস ভাব। পুরো এলাকাটা এবার ঘন ঘন কাঁপছে। তীব্র আলোর ঝটকা লাগলো জামাল সাহেবের চোখে। কিছুই বুঝতে পারছেন না। মনে মনে ভাবছেন- এ আলো এলিয়েনদের কোন যানের নয়তো? ভিন গ্রহের বাসিন্দারা চলে এলো না তো?

উনি এলিয়েনদেরও স্বপ্ন দেখেন মাঝে মধ্যে। এলিয়েনদের বাড়িতে দাওয়াত খান ঘুমের ভেতর। মাটির কাঁপন যেন কামড়ে ধরেছে জামাল সাহেবের শরীরকে। এ কাঁপনে জামাল সাহেবের থল থলে শরীর থেকে যদি চর্বির পাহাড় ভেঙে চুরে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায় তাহলে তো ভালই হয়। তীব্র আলোর যে ঝটকা জামাল সাহেবের চোখ ঝলসে দিয়েছে তা এখন আর নেই। এবার গুট গুটে অন্ধকার। এই গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। মনে হচ্ছে অন্ধকার যেন সবাইকে গিলে খাবে। প্রকৃতিতে অমাবস্যার কড়া নিঃশ্বাস পড়ছে। ভ্যাপসা গরমটা এখনও টিকে আছে। আকাশে ঘন-কালো মেঘের দাবড়ানি টের পাওয়া যাচ্ছে ভালোভাবেই।

আশে পাশের বাড়ি ঘর থেকে লোকজন বেড়িয়ে এসেছে। তারাও উদ্বিগ্ন। উৎকণ্ঠার ভেতর তাদের গলা ফেটে চিৎকার বেরুচ্ছে। চারিদিকে শুধু চিৎকার আর চিৎকার। কেউ কারো চেহারা দেখতে পারছেনা। কতগুলো টর্চ লাইট জ্বলছে থেমে থেমে। জামাল সাহেব আরও জোরে চিৎকার শুরু করলেন। উনার হাতেও একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ লাইট। সেটাকে জ্বালিয়ে রেখে উপর দিকে ঘুরাচ্ছেন আর চিৎকার করছেন। ব্যাপারটা দেখতে কেমন অদ্ভুত লাগছে। তার গলার আওয়াজ অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই কর্কশ। কেউ কেউ নিজেদের চিৎকার থামিয়ে জামাল সাহেবের চিৎকার দেখার জন্য তার সামনে এগিয়ে আসল। জড়ো হল। তারা একদিকে অজানা আতঙ্কে ভয়ে কাঁপছে। আবার অন্যদিকে জামাল সাহেবের চিৎকার উপভোগ করছে। জামাল সাহেবের সে কী চিৎকার! ও--হো--হো--হা--আ--ওরে বাঁচা--কি হলো রে--ও আল্লাহ--ও খোদা--।

কেউ কিছুই বুঝছে না। কি ঘটছে এসব? গাছপালা সব নড়ছে। গরু-ছাগল আর শিয়াল-কুকুরগুলো সব এক জোট হয়ে ডাকছে। ডেকেই যাচ্ছে। পাখিরাও বুক ভরা ভয়কে ভর কের ডানা ঝাপটিয়ে আকাশের পথ ধরে যেদিকে পারে, সে দিকে উড়ে গেল। অপ্রত্যাশিত এক দৃশ্য। কেমন একটা গুম গুম আওয়াজ হচ্ছে। আওয়াজটা যেন আকাশ থেকে উৎপত্তি লাভ করে গুলির বেগে মাটিতে ঢুকে যাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যেই ছেলে-বুড়ো, মহিলা সবাই এক জায়গায় জড়ো হতে থাকল। এদের কারও জীবনে বোধহয় এরকম ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। সবার চোখে-মুখে আতঙ্কের ভয়ংকর ঢেউ। মাটির অবিরাম কাঁপুনি কমেছে। তবে থেমে থেমে ঝাঁকুনি বেড়েছে। জামাল সাহেবও বিরতিহীন চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে যাচ্ছেন।

প্রতিবেশী কেউ একজন এসে জামাল সাহেবকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করল। জামাল সাহেবের পরিবারে কেউ নেই। একা মানুষ। বিয়ে করেননি। নারী জাতিকে উনি সহ্য করতে পারেন না। মেয়ে মানুষ নাকি দুনিয়ার ঝামেলা! সারাদিন শুধু পেন পেন করে। কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে।

ধপাস করে একটা আওয়াজ হল। মনে হয় কেউ একজন পড়ে গিয়েছে। জামাল সাহেবের বাড়ির পাশেই একটি ডোবা। সেখানেই পড়েছে মনে হয়। অন্ধকারে বুঝার কোন উপায় নেই। টর্চ জ্বালিয়ে জামাল সাহেব দেখতে পেলেন খুবই মোটা একজন ডোবাতে পড়েছে। তারই প্রতিবেশী। অমল বাবু। তিনি মিষ্টির দোকান করেন। অস্বাভাবিক মোটা ও ভারি শরীর তার। এলাকার ছেলেরা তাকে ডাকে ‘জাম্বু’। জাম্বু নামে বাংলা ছবির মোটা একজন ভিলেন ছিলেন যার চেহারার সাথে অমল বাবুর চেহারারও মিল খুঁজে পায় ছেলে-পেলেরা। অন্ধকারে দৌড়াতে গিয়ে বেচারা পড়ে গেলেন ডোবায়। পড়ে গিয়ে একেবারে গোঁ গোঁ শব্দ করা শুরু করলেন। তাকে টেনে তুলার জন্য কয়েকজন গেল সেখানে।

তবে টানতে গিয়ে অমল বাবুর শরীরের ওজনের কাছে হার মেনে উল্টো তারাও পড়ল ডোবাতে। এভাবে ভয়ংকর এক দৃশ্যের মাঝে হাস্যকর আরেক দৃশ্যের উদয় হল। এর মধ্যে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আগমন দেখল সবাই। মাটিতে ঝাঁকি হচ্ছেই। থেমে থেমে হচ্ছে। জামাল সাহেব কিছুটা আন্দাজ করলেন যে এটা ভূমিকম্প না, অন্য কিছু। ভূমিকম্প এতক্ষণ স্থায়ী হলেতো পুরো এলাকাটাই মাটির নিচে ডেবে যেত। নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত একেবারে। তাহলে কী ঘটছে এসব? (চলবে)

লেখক: মো. মাহফুজুর রহমান
প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
নোয়াখালী সরকারি কলেজ।


সর্বশেষ সংবাদ