দুর্লভ আলোর নাম সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর

আবুল মনসুর আহমদ
আবুল মনসুর আহমদ

আজ ১৮ মার্চ। প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৯ সালের এই দিনে তিনি ঢাকায় মারা যান। তিনি ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ ও সাংবাদিক এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্রূপাত্মক রচয়িতা। ১৯৪৬-এ অবিভক্ত বাংলার কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইত্তেহাদ-এর সম্পাদক এবং তৎকালীন কৃষক ও নবযুগ পত্রিকায়ও কাজ করেন তিনি।

আবুল মনসুরের জন্ম ১৮৯৮ সালে ময়মনসিংহ জেলার ধানিখোলা গ্রামে। পিতার নাম আবদুর রহিম ফরায়জী এবং মাতার নাম মীর জাহান বেগম। তিনি ১৯১৭ সালে নাসিরাবাদ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, ১৯১৯ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে আই.এ এবং ১৯২১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। এরপর তিনি ১৯২৬ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত কলকাতা রিপন ল’ কলেজে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং বি.এল পাস করেন। এ বছরেই তিনি ময়মনসিংহে আইনব্যবসা শুরু করেন এবং সেখানে তিনি ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তাঁর পেশায় নিয়োজিত থাকেন।

মনসুর আহমদ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী এবং ১৯৫৭ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ সরকারের কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। তার রচনার মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত বিদ্রূপাত্মক রচনাবলি হলো আয়না, আসমানী পর্দা, গালিভারের সফরনামা ও ফুড কনফারেন্স। আত্মজীবনীমূলক দুটি গ্রন্থ আত্মকথা ও আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর। আরও রয়েছে বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের ওপর বিখ্যাত রচনাবলি।

পাকিস্তানের প্রথম দিকে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রথম সারির একজন নেতা। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মেনিফেস্টো ‘একুশ দফা’র রচয়িতা তিনি—যে নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পূর্ববাংলার ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়। রাজনৈতিক কারণে তাকে পঞ্চাশ দশকের শেষ দিকে ও ষাটের দশকের প্রথম দিকে বেশ কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়। বাংলা একাডেমি সম্প্রতি আবুল মনসুর আহমদ রচনাসমগ্র নিয়ে তিন খণ্ড প্রকাশনা করেছে। আরও তিন খণ্ড প্রকাশিতব্য রয়েছে। আবুল মনসুর আহমদ চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে অবিরাম প্রচারণা চালিয়েছিলেন। ইত্তেহাদ-এর সম্পাদক হিসেবে হিনি ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখেন।

ইমরান মাহফুজ লিখেছেন, ‘আবুল মনসুর আহমদ, বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়ের অকুতোভয় এক যোদ্ধার নাম। এ নামটির সাথে প্রায় সকলেই পরিচিত। এই উপমহাদেশে অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে আবুল মনসুর আহমদের নাম এবং স্বতন্ত্রতা নিয়ে বিরাজিত এই নাম এসেছে নানাভাবে আমাদের কাছে। কখনো রাজনীতির মঞ্চে, কখনো সংবাদপত্রে, কখনো সাহিত্যে-স্যাটায়ারিস্ট ও প্রবন্ধের চিন্তানায়ক হিসেবে, এমনকি আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিয় নাম। তাঁর জীবনের শুরুতে বাঙালি মুসলমানের চেতনায় উন্মেষযুগলকে দেখেছেন, যৌবনে উপমহাদেশের স্মরণীয় আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থেকেছেন, পূর্ণজীবনে সংবাদপত্রের সাথে নানা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সর্বোপরি একজন জীবনশিল্পীর চোখে চারপাশ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন।’

তিনি আরো লিখেনে, ‘সম্ভবত অন্য সব পরিচিত ডিঙ্গিয়ে একমাত্র সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদই যেন সর্বোপরি অধিষ্ঠিত নাম, আজকের যেমন তেমনি অনাগত কালের জন্যেও। মননশীলতার বিচারে দেখলে আবুল মনসুর আহমদ নামের যে বটবৃক্ষ- সময়ের মধ্যে থেকে সব সহজযোগ নাগালে থাকা স্বত্তেও,  সময়ের অনাচারের বিরুদ্ধে, অবিচল বটের মতো স্থির ছিলেন। সম্প্রদায়ের প্রতি; প্রত্যক্ষ ও উচ্চকিত হৃদ্যতা থাকা সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রসঙ্গে এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তব্যটি উল্লেখযোগ্য: ‘পরশুরাম হিন্দু দেবদেবী নিয়ে অনেক কিছু বলেছেন, হিন্দু সম্প্রদায় তা সহ্য করেছে। আবুল মনসুর আহমদের দুঃসাহস সেদিন সমাজ সহ্য করেছিল। আজ কোন সম্পাদক এমন গল্প ছাপতে সাহস করবে কিনা এবং সমাজ তা সহ্য করবে কিনা, সে-সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। আবুল মনসুরের আক্রমণের লক্ষ্য কোনো ব্যক্তি, ধর্ম বা সম্প্রদায় নয়। তাঁর বিদ্রোহ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। ‘আয়না’ প্রকাশের এতকাল পরেও মনে হয়, এরকম একটি গ্রন্থের প্রয়োজন আজও সমাজে রয়ে গেছে।’

আবুল মনসুর আহমদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকলেও বিদ্রুপাত্মক রচনার লেখক হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত বিদ্রুপাত্মক রচনা হচ্ছে: আয়না (১৯৩৬-১৯৩৭) ও ফুড কনফারেন্স (১৯৪৪)। তাঁর রচিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে, সত্যমিথ্যা (১৯৫৩), জীবন ক্ষুধা (১৯৫৫) ও আবে-হায়াৎ (১৯৬৪)। আর স্মৃতিকথা, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (১৯৬৯), শের-ই-বাংলা থেকে বঙ্গবন্ধু (১৯৭২) এবং তাঁর আত্মচরিত হল আত্মকথা (১৯৭৮)। সাহিত্যে অবদানের জন্য তাঁকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬০), স্বাধীনতা দিবস পদক (১৯৭৯) ও নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয়।


সর্বশেষ সংবাদ