৬ নারী শিক্ষার্থীর ভাবনায় নারী দিবস

  © টিডিসি ফটো

আজ ৮ মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিপাদ্য সামনে রেখে দিবসটি পালিত হয়। প্রতিপাদ্যগুলোর মূল কথা থাকে নারীর প্রতি সামাজিক বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়ন দূর করা। সেই সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া হয় নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আর নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিতে। বিশ্বের নানা দেশের মতো আমাদের দেশে দিবসটি পালিত হবে। বর্তমান সময়ে নারীদের চিন্তা-ভাবনা ও সমসাময়িক ব্যস্ততাসহ নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ নারী শিক্ষার্থী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীর আহম্মেদ

প্রভা আক্তার, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

নারী দিবসের মূল তাৎপর্য হলো নারীদের সম অধিকার অর্জন। আজকের বিশ্বে নারীরা এখনো সম অধিকার পায়না। যে কোনভাবে পুরুষদের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে আছে। নারীদের প্রতিনিয়ত পুরুষের নানা বৈষম্য এবং নিপীড়নের প্রতিনিয়ত শিকার হতে হয়। শুধু একদিন নারী দিবস পালন করলেই নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় না। নারী দিবসের তাৎপর্যকে ধারণ করে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নারী-পুরুষর সমমজুরি এবং নারীর নিরাপদ কর্ম পরিবেশের দাবির লড়াই হতেই আজকের নারী দিবসের উৎপত্তি। কিন্তু, এখনো কর্মক্ষেত্রে নারীকে নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয়। নারীদের নিজের স্বপ্ন পূরণ করার আগে তার পরিবার, তার সমাজের চাহিদা মেটাতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা উচ্চ শিক্ষার সিঁড়ি অতিক্রম করতে পারে না। অনেক নারীই আছেন যারা সন্তান ধারণ করে পড়াশোনায় ইতি টেনে সংসারী হতে বাধ্য হয়েছেন। এভাবেই নারীকে শিকলে বাঁধা জীবন অতিবাহিত করতে হয়। সম্প্রতি উদ্বেগজনক হারে ধর্ষণের মাত্রা বেড়ে গেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এর জন্য দায়ী। ঘরে বাহিরে সব জায়গায় নারী অনিরাপদ জীবন ধারণ করে। এসব বিষয় থেকে নারীকে মুক্তি দিতে পারলেই নারী দিবস সার্থক হবে। নারী ও পুরুষের পারস্পারিক সৌহার্দ্যপূর্ণ একটি সুন্দর সমাজ গড়ে উঠুক এই কমানা করি। সবাইকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা।

রূপন্তী দীপা মল্লিক, আইন বিভাগ, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

বলা যায় প্রাচীন যুগ থেকেই নারী একজন মানুষ হিসেবে তার পূর্ণ অধিকার নিয়ে জীবন ধারণ করতে পারেনি। সমাজের যত বাঁধা নিষেধ তা নারীর জন্যই নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক এই ব্যবস্থায় নারীকে চিরকাল পুরুষের অধীনস্থ করে চলতে বাধ্য করা হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে পদে পদে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। আমাদের দেশের নারীদের বর্তমান অবস্থান অতীতের থেকেও অনেক ভয়াবহ। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, ৯৫ শতাংশ নারী তাদের স্বামী কর্তৃক শারিরীক নির্যাতনের শিকার হন। মানসিক নির্যাতনের কোন হিসেব বলাই বাহুল্য। সামগ্রিকভাবে কোন জনগণেরই নিরাপত্তা এদেশে নাই, কিন্তু আলাদাভাবে নারীর নিরাপত্তাটকু যেন কোথাও নেই। না ঘরে না বাহিরে! ক্ষোভের বিষয় হলো নারী ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের কোন বিচারও এ দেশে হয়না। বিগত এক দশকের দিকে নজর দিলে দেখা যায় কত অসংখ্য নারীকে এই সমাজের কাছে বলী হতে হয়েছে। নারীর অধিকার শুধু ধর্ষণ, নিপীড়ন এবং বৈষম্যের দ্বারা ক্ষুণ্ন হচ্ছে না, বাজে দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব, অকথ্য ব্যবহার ইত্যাদি সব রকমভাবে ক্ষুন্ন  হচ্ছে।  নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার সবার। অথচ দেখা যায় বিদ্যমান যে শাসনব্যবস্থা জারী আছে তার প্রভাবে বলী হতে  হচ্ছে সবথেকে বেশি নারীদেরকেই। সুতরাং রাষ্ট্র কর্তৃক জিইয়ে রাখা এই পিতৃতন্ত্রকে কষাঘাত করাটা জরুরী। আর এই জরুরী কাজটা করার উদ্যোগ নারীদেরকে নিতে হবে এবং সাহসের সাথে এই কাজ এগিয়ে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সেই সুতা কারখানার নারী এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক।

মিম খান, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয় 

সমাজের প্রত্যেকটি অঙ্গনে নারীরা পিছিয়ে আছে। নারীদের প্রতি ভ্রান্ত ধারণা তাঁদের অগ্রতিতে প্রতিনিয়ত বাঁধার সম্মুখীন করে। নারীর অগ্রগতি হওয়া উচিত বাঁধামুক্ত। নারীরা শিক্ষা এবং কুসংস্কারের বাঁধা কিছুটা অতিক্রম করতে পারলেও নিরাপত্তা ইস্যুতে অনেক পিছিয়ে আছে। ধর্ষণ এবং ইভটিজিংয়ের ভয়ে রাস্তায় কোন নারী একা চলতে সাহস পায়না। ২০১৯ সালে ব্যাপকহারে নারী ধর্ষণের শিকার হলেও অপরাধীদের কোন বিচার হয়নি। এই ঘটনায় বলে দেয় নারীরা আজকের সমাজে কতটা অসহায় জীবন যাপন করে। বেশিরভাগ নারী চার দেয়ালের মাঝে আটকে পড়ে বন্ধী জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়, পরিবার নামক কারাগার তাদের বন্ধী জীবন যাপন করতে বাধ্য করে। খেলাধুলায় নারীদের এগিয়ে আসা নিয়েও সমাজের মানুষদের বিরূপ মনোভাব রয়েছে। একটি সুন্দর সমাজ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়েরই সমান গুরুত্ব রয়েছে তবুও কেন পুরুষের অধিকার নারীর তুলনায় বেশি হবে?সর্বক্ষেত্রে নারীরা তার অধিকার ফিরে পাবে এটাই আমার চাওয়া। নারীরা অবাধে এগিয়ে যাক। ঘরে-বাহিরে নারীরা সুরক্ষিত থাকুক,  নিরাপদে থাকুক এমন একটা সমাজ গঠে তুলুন। নারীর প্রতি সকল বৈষম্যের অবসান হলেই নারী দিবস সার্থক হবে।

সুমাইয়া রিমা, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আন্তর্জাতিক নারী দিবস হচ্ছে রাষ্ট্র, সমাজ ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে এবং স্তরে পুরুষের সমপর্যায়ে নারীর অধিকারবাদের এক উজ্জ্বল দিন। অবশ্য বলতে হয় সমান অধিকারের দাবি যেন পশ্চিমা দেশের প্রগতির অন্তিম ধারায় পর্যবসতি না হয়। আমরা স্বীকার করি ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে নারী শিক্ষার হার আজ পুরুষের সমপর্যায়ে উন্নীত। সেই সঙ্গে সমান অধিকারের দাবিও সোচ্চার। কিন্তু আমাদের স্বীকার করতে হবে, রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের প্রাথমিক অবস্থা হতে একদল মহীয়সী নারী যে বাগ্মিতাশক্তি ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন তা আজ বিশ্বের অজানা নয়। আন্দোলনের বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন এবং নিজের কর্মপ্রতিভার পরিচয় দিয়ে গেছেন। অবশ্য বলতে হয়, নারী শিক্ষা-দীক্ষায় পুরুষের পাশে দাঁড়ানোর অধিকার লাভ করলেও পরিবার ও সমাজ জীবনে বহু নারী আশানুরূপ শান্তি ও সন্তোষ লাভ করতে পারেনি। নারীর অধিকার বিষয়ে রাষ্ট্রও সজাগ। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ যাতে না-থাকে সে ব্যাপারে আইনের ব্যবস্থা আছে। এত কিছুর পরও নারী নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি বেড়েই চলছে। শিক্ষা-দীক্ষা কিছুই পারছে না। বহু নারী যেমন অনেক ক্ষেত্রে নারীত্বের মর্যাদা হারিয়েছে। একদল পুরুষের ক্ষেত্রে নারী শুধুই ভোগ-লালসার সামগ্রী। শিক্ষিত-অশিক্ষিত দুটি দিক একই অবস্থায় আছে। উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত পুরুষের ভোগ-লালসার যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় লালসার শিকার যেমন রুচিমার্জিতা নারী হচ্ছে, ঠিক একদল নারী শিকার ধরে দেবার ফাঁদও তৈরি করে পুরুষকে প্রলোভিত করছে। এসব অবস্থা থেকে পরিত্রাণ অতিসত্বর জরুরী। 

আফসানা রাত্রি মিশু, ক্লদিং এন্ড টেক্সটাইল, হোম ইকোনোমিকস ইউনিট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সকল নারীদের প্রতি রইলো আমার ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। তবে একটি দিনকে নির্দিষ্ট করে নারীদের সম্মান করা যায় না। বর্তমানে আমাদের সমাজে নারীরা সবার উর্ধ্বে। সব জায়গাতেই তাদের সম্মান দেয়া হচ্ছে। তবে সম্মান পাওয়াটা নির্ভর করে ব্যক্তিত্বের উপর। আবার যদি আমরা নিজেরাই নিজেদের জায়গাটা নষ্ট করি তাহলে হয়তো আমরা সেই সম্মানও পাবো না। সুতরাং আমাদের তথা নারীদের উচিত নিজেদের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে চলা। নারী দিবসে শুধুমাত্র তাদের সম্মান দেখিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস বা ভিন্ন কিছু আয়োজন করার মানে নেই। বরং বছরের প্রতিটা দিন নারীদের সাথে ভালো ব্যবহার করা উচিত। সামাজিকভাবে মেয়েরা এখন সবদিক থেকেই এগিয়ে। নারীরা তার যথাযথ প্রাপ্য পেলেই হয়তো দেশ আরও সামনে দিকে এগিয়ে যাবে। আর নারীর প্রতি সম্মান নিজেদের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। তাহলে হয়তো কোনো নারীকে আর নির্যাতিত হতে হবে না।

ফাতেমা তুজ জিনিয়া, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

দেশে শিক্ষাসহ বিভিন্ন সেক্টরে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলেও তাদের নিরাপত্তা আজও নিশ্চিত হয়নি। দৈনন্দিন জীবনে তারা এখনো প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। সমাজের এক শ্রেণির মানুষের কাছে নারীরা এখনো শুধুমাত্র ভোগ বিলাসের বস্তু। আর এই শ্রেণির দ্বারা ধর্ষণও হতে হচ্ছে নারীদের। ৩ মাসের শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধা—ধর্ষণের হাত থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছেনা। এমনকি এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচারও হচ্ছে না। ফলে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের হার বেড়েই চলছে। এই পরিস্থিতির দ্রুত অবসান প্রয়োজন। রাষ্ট্র যদি নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে তবে তারা হয়তো নিরাপত্তার জন্য আবারও গৃহবন্দী হয়ে পড়বে। তাই এ দিবসকে কেবল সভা-সেমিনারে সীমাবদ্ধ না রেখে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। ধর্ষকদের, উত্তক্তকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে নারীর জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলা হোক এটাই প্রত্যাশা।