রক্ত দিয়ে জীবন বাঁচানোর অনুভূতি বোঝানো যাবে না

হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন

স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধন একটি অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সাধারণত দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক জোন ও ইউনিটভিত্তিক রক্ত সংগ্রহ ও সরবরাহ করে থাকে সংগঠনটি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সারাদেশে সংগঠনটির নয়টি জোনের অধীন ও স্বতন্ত্র মোট ১২৭ ইউনিট রয়েছে। এছাড়া ইউনিটের প্রাথমিক পর্যায় ১৩ পরিবার রয়েছে।

বর্তমানে দেশের ৬৩ জেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর ভয়াবহতার চিত্র দেখে দেশবাসী আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ফিরোজ কবির স্বাধীন মৃত্যুবরণ করেন। এতে পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে ডেঙ্গু আতঙ্ক বিরাজ করছে শিক্ষার্থীদের মনে।

ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদসহ (ডাকসু) বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কার্যক্রম পালন ও দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু সবকিছুর আড়ালে নীরবে নিভৃতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য রক্ত সংগ্রহ ও সরবরাহ করে যাচ্ছেন বাঁধন কর্মীরা।

বাঁধনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জোন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত এক সপ্তাহে ২১ কর্মঘন্টায় (সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত নয়টা) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জোনের টিএসসি কার্যালয়ে ৮৫ ব্যাগ রক্তের চাহিদা পড়ে। এর মধ্যে ৬৭ ব্যাগ রক্ত তারা ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ভিত্তিক ১৯ ইউনিট থেকে আরও প্রায় ৬৫০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে দেওয়া হয়েছে। রক্তের চাহিদা সম্পন্ন এই লোকদের সিংহভাগই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বলে জানা যায়।

ক্লাস-পরীক্ষা, চাকরির পড়াশোনারসহ বিভিন্ন ব্যস্ততার মধ্যে বাঁধনের কর্মঘন্টা ও এর বাইরে বিভিন্ন সময় রক্ত সংগ্রহ ও সরবরাহ করার বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলেছেন বাঁধনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাবি প্রতিনিধি সোহানুর রহমান

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কেমন আছেন?
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন: ভালো আছি। তবে বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় রক্ত সংগ্রহ ও সরবরাহ নিয়ে একটু বেশি ব্যস্ত আছি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি কখন থেকে বাঁধনের সঙ্গে যুক্ত আছেন?
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন: আমি ২০১৫ সাল থেকেই বাঁধনের সঙ্গে যুক্ত আছি। এবছরের এপ্রিল মাস থেকে আমি বাঁধনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বরত আছি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সম্প্রতি ডেঙ্গুর প্রকোপে ব্যস্ততা কেমন?
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন: ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি ব্যস্ত আছি। কারণ বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ায় আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ রক্ত সংগ্রহ করতে হয়। সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে একটু ব্যস্ত সময় পার করছি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বর্তমানে রক্তের চাহিদা কেমন?
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন: আগের চেয়ে বর্তমান সময়ে রক্তের চাহিদা অনেক বেশি। যেখানে আগে এক সপ্তাহে আমাদের এখানে ৫০ ব্যাগের মতো রক্তের চাহিদা হতো। গত এক সপ্তাহে ২১ কর্মঘন্টায় ৮৫ ব্যাগ রক্তের চাহিদা হয়েছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সম্প্রতি কী ধরনের রোগীর জন্য রক্ত বেশি লাগে?
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন: সম্প্রতি যত রক্তই আমরা সংগ্রহ ও সরবরাহ করছি তার সব না হলেও বেশিরভাগ রক্তই ডেঙ্গু রোগীর জন্য।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সম্প্রতি রক্ত সংগ্রহ করতে কী ধরণের সমস্যা বা সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হচ্ছেন?
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন: আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রক্তদাতার স্বল্পতা। বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় চারদিকে রক্তের প্রয়োজন হওয়ায় রক্ত দাতা পাওয়া কষ্টকর।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য তো প্লাটিলেট ব্লাড লাগে। এ ধরণের রক্ত সংগ্রহে কী ধরণের সুবিধা ও অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন?
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন: ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য যে প্লাটিলেট ব্লাড লাগে এর জন্য কয়েকটি অসুবিধা হচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা ডোনার স্বল্পতা। কেননা প্লাটিলেট ব্লাড দেওয়ার জন্য সাধারণত ছেলেদের প্রয়োজন হয়। আর ডোনারের ওজন ৬০ কেজির বেশি হতে হয়। এছাড়া এই ব্লাড ট্রান্সমিউটেশনে হাসপাতাল ভেদে রোগীকে ১৪ থেকে ৩০ হাজারের মতো টাকা খরচ করতে হয়। তবে সুবিধা হলো এই ধরণের ব্লাড ১৪/১৫ দিন পর পর দেওয়া যায়। যদিও চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী এক সপ্তাহ পর পর দেওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও শরীর-স্বাস্থ্য বিবেচনা করে চিকিৎসকরা ১৪/১৫ দিন পর পর দেওয়ার কথা বলেন।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রক্তদানের আগ্রহ সম্বন্ধে আপনার মতামত?
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রক্ত দানে খুবই আন্তরিক ও আগ্রহী। আমি শিক্ষার্থীদের রক্তদানের আন্তরিকতায় সন্তুষ্ট।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কিছু শিক্ষার্থী রক্ত দিতে সঙ্কোচ বোধ করেন। এর কারণ কী মনে করেন?
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন: আসলে সবার মধ্যেই ভালো কাজ করার সদিচ্ছা সুপ্ত থাকে। কেউ স্বেচ্ছায় আবার কেউ পরিস্থিতি অনুযায়ী সেটা করে। তবে কিছু শিক্ষার্থী রক্ত দিতে মানসিক জড়তায় ভোগেন। এর কারণ তারা কোনোদিন রক্ত দেননি। এজন্য অজানা এক দ্বিধা ও মানসিক জড়তা তাদের মধ্যে কাজ করে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: রক্তদানে যারা সংকোচ বোধ করেন তাদের প্রতি পরামর্শ কী?
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন: যারা রক্ত দানে সঙ্কোচ বোধ করেন তাদেরকে আমরা অন্য কেউ যখন রক্ত দেন তার সঙ্গে নিয়ে যাই৷ তখন ওই শিক্ষার্থীর রক্ত দেওয়া দেখে তারা অনুপ্রাণিত ও সঙ্কোচ মুক্ত হন। আর যারা এখনো কোনোদিন রক্ত দেননি অথবা রক্ত দিতে মানসিক জড়তায় ভোগেন তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে, আপনারা যদি রক্ত দেওয়ায় সামর্থ্যবান হন, তাহলে একবার অন্তত রক্ত দেন। এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করবে এবং সব সব সঙ্কোচ কেটে যাবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে কোনো নতুন পরিকল্পনা আছে আপনাদের?
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন: আমরা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের রক্ত সংগ্রহের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা, রক্তের সন্ধান সহ রক্ত সংগ্রহ ও সরবরাহ করছি। আর আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা ডেঙ্গু নিয়ে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করবো।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সাম্প্রতিক পরিস্তিতে প্রশাসনের কাছে আপনাদের কোনো চাওয়া আছে কী?
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন: প্রশাসনের কাছে আমাদের কোনো চাওয়া নেই। আমাদের এই সংগঠন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আমরা নিজেরা মিলেই এটি পরিচালনা করছি। তবে বিশেষ প্রয়োজন হলে হয়তো প্রশাসনের সহযোগিতা চাইবো।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: প্রায় চার বছর ধরে আপনি বাঁধনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। আপনার অনুভূতিটা কেমন?
হুসাইন মুহাম্মদ সিদ্দিকিন: বাঁধনের সঙ্গে প্রথম বর্ষ থেকেই যুক্ত আছি। নিঃসন্দেহে অসাধারণ একটা অনুভূতি কাজ করে। অনেক ব্যস্ততা, অনেক জামেলা পোহাতে হয়। এতো এতো কিছুর পরও এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। সবকিছুর পরও কোনো রোগী যখন কল দিয়ে বলে ‘ভাই’ আপনাদের রক্ত ব্যবস্থা করে দেওয়ায় আমার ‘অমুক’ সুস্থ হয়েছে। তখন অসাধারণ একটা ভালা লাগা কাজ করে। মনে হয়, একটা লোকের জীবন বাঁচানোর জন্য আমি কিছু একটা করতে পেরেছি। এই অনুভূতিটা একেবারেই অন্যরকম; আসলে বলে প্রকাশ করার মতো নয়।