সাক্ষাৎকারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান

শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক থাকলে বাকি উন্নয়ন কার্যক্রমও ঠিক থাকে

প্রফেসর মু. জিয়াউল হক
প্রফেসর মু. জিয়াউল হক  © টিডিসি ফটো

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যান প্রফেসর মু. জিয়াউল হক। এ বছরের ২৫ মার্চ তিনি এ পদে যোগ দেন। তিন দশকের কাছাকাছি সময় তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে অর্থনীতি বিষয়ে শিক্ষকতা করে ২০১৪ সালে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে চেয়ারম্যান পদে যোগদান করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় নানা অগ্রগতি, ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাফল্য ও কর্মপরিকল্পনা বিষয়ে তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইরফান হক

টিডিসি : দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত মতামত কি?
প্রফেসর মু. জিয়াউল হক : শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে এমন একটি বিষয়, এটি যদি সঠিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে না যায় তাহলে কোনো উন্নয়ন টেকসই হবে না। কারণ সব কর্মকান্ডের পেছনের শক্তি হচ্ছে শিক্ষা। তাই শিক্ষাকে আমাদের সঠিক পথে প্রবাহিত করতে হবে এবং শিক্ষা যদি সঠিক জায়গায় থাকে তাহলে আমাদের অন্য উন্নয়ন যে কার্যক্রম রয়েছে সেগুলো সঠিক পথে থাকবে।

টিডিসি : গেল ১০ বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর বিষয়ে বলবেন?
প্রফেসর মু. জিয়াউল হক : বর্তমান সরকারের আমলে অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য অর্জন রয়েছে। প্রথমত শিক্ষায় পরিমাণগত বৃদ্ধি পেয়েছে। গেল ১০ বছরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি একটি বড় বিষয়। একই সঙ্গে গুণগত পরিবর্তনও হয়েছে। শিক্ষার ধরন পাল্টে গেছে। শিখন ও পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষার্থীরা একটি নতুন গুণগত মান অর্জন করেছে। এটি একটি বড় অর্জন। আরেকটি বড় অর্জন হচ্ছে বছরের প্রথম দিন প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে বিনামূল্যে বই দিচ্ছে। এটিও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। এরই ফলে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বেশি পরিমাণ শিক্ষার্থী। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ আধুনিক শিক্ষার জন্য এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানের জন্য যেভাবে একজন শিশুকে তৈরি করতে হয় সেই ধারাগুলোর সঙ্গে আমাদের এ প্রক্রিয়া সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকদের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য আমরা নানা ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছি।

টিডিসি : ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করা এ সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। সেক্ষেত্রে শিক্ষা বোর্ডগুলোতে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া কতটুকু লেগেছে?
প্রফেসর মু. জিয়াউল হক : শিক্ষা বোর্ডগুলোতে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া লেগেছে। একবারে পেপারলেসভাবে আমাদের শিক্ষা বোর্ডগুলোর পরীক্ষার ফল প্রদান করা হয়। শিক্ষার্থীরা বাড়িতে বসে অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষার ফল দেখতে পারেন। একজন শিক্ষার্থীও যদি সনদ হারিয়ে ফেলে কিংবা নতুন সনদের প্রয়োজন হয় তাহলে বাড়িতে বসে সেটি উত্তোলন করতে পারে। যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুমোদন, স্বীকৃতি নবায়নসহ অন্য যে আনুষঙ্গিক কাজগুলো থাকে সেসব অনলাইনে সম্পাদন করে থাকি। অর্থাৎ আমাদের যে ৫০ থেকে ৬০টি সেবা আছে সবগুলো অনলাইনের মাধ্যমে দিয়ে থাকি। এর ফলে যেটা হচ্ছে যে, একজন শিক্ষককে কোনো সেবা নিতে শিক্ষা বোর্ডে বছরে পাঁচ দিন বা পাঁচবার আসতে হতো এখন কিন্তু তার একবারও আসতে হচ্ছে না। এ পাঁচটি কর্মদিবস সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করতে পারছে। অন্যদিকে তার একটি বিরাট পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে। এটি আমাদের জিডিপির সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে।

টিডিসি : ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের মূল কাজ কী?
প্রফেসর মু. জিয়াউল হক : দেশে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। তাছাড়া একটি কারিগরি এবং একটি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। সব বোর্ডের মূল কাজ একই। আমাদের মূল কাজ হচ্ছে, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা থেকে ঐ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সর্বশেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত যতগুলো কাজ আছে সব কাজ আমরা করে থাকি। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা হতে পারবে কি না সেটি আমরা পরিদর্শন করে তার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অনুমোদন দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটি আমরা তৈরি করে দিই। আমরা অনুমোদন দিলে ম্যানেজিং কমিটি হয়, পরে তারা শিক্ষার কার্যক্রম পরিদর্শন করে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী কী কাজ হচ্ছে তা পরিদর্শন করি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা শেষ করে একজন শিক্ষার্থী কতটুকু শিখল তার মেধা যাচাইয়ের জন্য আমরা সর্বশেষ একটি পরীক্ষা নিয়ে থাকি। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় কাজ রয়েছে প্রায় সব কাজই আমাদের সম্পাদন করতে হয়।

টিডিসি : বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর কোন কোন বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছেন?
প্রফেসর মু. জিয়াউল হক : প্রথম যে বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়েছি সেটি হচ্ছে সেবার মান উন্নয়ন করা। আমাদের এখানে যারা সেবা নিতে আসে তাদের মান কীভাবে উন্নয়ন করব সেটির ওপর গুরুত্বারোপ করেছি। সেটির ওপর গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে আমরা আমাদের সব সেবাকে অনলাইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। চলতি বছরের পহেলা আগস্ট থেকে আমাদের সব সেবা অনলাইনের আওতায় চলে এসেছে।


টিডিসি : শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার কথা রয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
প্রফেসর মু. জিয়াউল হক : এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে একটা সময় প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছিল। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের যে অবকাঠামোগুলো তৈরি ছিল তা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। আবার ওখানে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হতো তা পঞ্চম শ্রেণির উপযোগী করে। এখন প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করতে গেলে অবকাঠামোগত পরিবর্তন করার পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন করতে হবে। তাই এসব পরিবর্তন রাতারাতি করা সম্ভব নয়। এসব পর্যায়ক্রমে করতে হবে। আমাদের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়েছে। আগামীতে পর্যায়ক্রমে সবগুলোতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিয়ে আসা হবে।

টিডিসি : কোচিং সেন্টার বন্ধে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা সরকার ভাবছে?
প্রফেসর মু. জিয়াউল হক : কোচিং সেন্টার বন্ধে নীতিমালা আছে কিন্তু আইন নেই। কোচিং সেন্টারগুলো দুষ্টু খতের মতো আমাদের ওপর বসে আছে। এটা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন কাজ। এটা কিন্তু দ্বিপাক্ষিক বিষয়। কোচিং সেন্টারে যারা পড়তে যায় তাদের কিন্তু কেউ জোর করে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে না। এটা একটি সিস্টেমের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। আবার একজন শিক্ষার্থী কেন কোচিংয়ে যাচ্ছে? কারণ সে শিক্ষার্থী যে পরিমাণ শিক্ষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রত্যাশা করছে সেরকম পাচ্ছে না। এটা একটা পারস্পরিক বিষয়। তাই আমরা চেষ্টা করছি, শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করা এবং ক্লাসে শিক্ষার মানটাকে আরও উন্নত করা। এর ফলে তাদের কোচিংয়ে যাওয়ার প্রবণতা কমে যাবে।

টিডিসি : ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন কতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে?

প্রফেসর মু. জিয়াউল হক : ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন সাত হাজারের কাছাকাছি অনুমোদিত স্কুল রয়েছে আর কলেজ রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০০। তাছাড়া অনুমোদনের অপেক্ষায় আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেটি একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়া হয়।

টিডিসি : গত কয়েক বছর যাবৎ এসএসসি ও এইচএসসিতে পাশের হার এবং জিপিএ-৫ কমছে-এটা কি কারণ হতে পারে?
প্রফেসর মু. জিয়াউল হক : এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। আমরা একটা সময় আমাদের শিক্ষার পরিমাণগত পরিমানটি বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমরা চেয়েছিলাম আমাদের সকল শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মধ্যে নিয়ে আসা। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে, যে পরিমাণগত পরিবর্তনটি হচ্ছে এটার গুণগণ পরিবর্তন সাধন করা। যখন গুণগণ পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে তখন আস্তে আস্তে প্রশ্নের ধরণ, পরীক্ষা পদ্বতি, পরীক্ষকদের প্রশিক্ষণ. উত্তরপত্র মূল্যায়নের ধরণ প্রভৃতির পরিবর্তন হচ্ছে। এরই ফলে জিপিএ-৫ এর হার কমছে। এখানে আরেকটা পর্যবেক্ষণ রয়েছে। সেটি হচ্ছে, গ্রামে ও শহরে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। শহরে বেশি এবং গ্রামে তুলনামূলকভাব অনেক কম শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে থাকে।

টিডিসি : চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে-এ বিষয়ে কি ভাবছে বোর্ড?
প্রফেসর মু. জিয়াউল হক: এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে বিষয়টি আমাদের সামনে চলে আসছে তা অধিকাংশই প্রতারণা। এই প্রতারণা এমনভাবে প্রচারণা হয়েছে আমরা অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছি। আপনি খেয়াল করবেন, এবছর এসএসসির পর এইচএসসি পরীক্ষা এবং সর্বশেষ জেএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে কেউ প্রতারণা করতে পরেনি। অর্থাৎ প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে শুরু করে পরীক্ষার কক্ষে বিতরণ পর্যন্ত যে প্রক্রিয়াগুলো রয়েছে সেগুলোতে অনেগুলোর পরিবর্তন নিয়ে এসেছি। প্রশ্নপত্র প্রণয়নের একটা পরিবর্তন আসছে-যে প্যাকেটি ব্যবহার করছি সেটার পরিবর্তন করছি, সিকিউরিটি খাম তৈরি করে সকল প্রশ্ন সেখানে দিয়ে দিচ্ছি। এছাড়াও আমরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছি।

টিডিসি : ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে যোগদানের পূর্বে আর কোথায় কোথায় কর্মরত ছিলেন?
প্রফেসর মু. জিয়াউল হক: আমি মূলত অর্থনীতির শিক্ষক এবং অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ১৯৮৬ বরিশালের সৈয়দ হাতেম আলী কলেজে অর্থনীতি বিষয়ে প্রভাষক পদে যোগদান করি। এরপর বরিশাল সরকারি বিএম কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছি। এক পর্যায়ে আমি ২০১৪ সালের ১৮ জুন বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে চেয়ারম্যান পদে যোগদান করে ২৪ মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করি। সর্বশেষ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।

টিডিসি : আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রফেসর মু. জিয়াউল হক : আপনাকেও ধন্যবাদ।