রুয়েটে দেশের প্রথম হাইব্রিড গাড়ি উদ্ভাবন

নতুন উদ্ভাবিত গাড়ি
নতুন উদ্ভাবিত গাড়ি  © টিডিসি ফটো

প্রতিদিন বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। জ্বালানি ছাড়া সে গাড়ি তো খুবই স্বার্থপর, হিসেবের বাইরে এক-কদমও আগাবে না। এখন পর্যন্ত মোটাদাগে এসব জ্বালানির উৎস ওই তেল খনি। কিন্তু খনি তো আর অসীম নয়। সেখানে থাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মজুত, যা একটা সময় এই ফুরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেইৃ যায়। তবে ডিজিটালের এমন সময়ে এসব গতানুগতিক প্রক্রিয়ার বাহিরে ভিন্নকিছু দেখিয়েছেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক। আবিষ্কার করেছেন দেশের প্রথম হাইব্রিড প্রযুক্তির গাড়ি।

গতানুগতিক ধারায় প্রচলিত গাড়ির ব্যবহারে দেশের সড়ক গুলোতে বাড়ছে যানজট সমস্যা। যার কারণে গাড়ির গতিবেগ গড়ে ঘণ্টায় গিয়ে দাঁড়ায় ৬ কিলোমিটার। এতে করে জ্বালানির অপচয় হচ্ছে। সড়কে যেসব ব্যক্তিগত গাড়ি চলছে সেগুলো প্রতি লিটার অকটেন পুড়িয়ে ৫ থেকে ৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। অকটেন বা পেট্রলের মূল্য অনুযায়ী প্রতি কিলোমিটার পাড়ি দিতে ব্যয় হচ্ছে কমবেশি ১১ টাকা।

কিন্তু এতোসব জটিলতার ভিড়ে সমস্যার একটা নগদ সমাধান হতে পারে যদি আপনার গাড়িটা হয় হাইব্রিড। এর ধারাবাহিকতায় মাত্র দুই বছরের চেষ্টায় দেশের প্রথম হাইব্রিড গাড়ি উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছেন রুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক।

ড. এমদাদুল হক বলেন, আমরা এমন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা করেছি যা জ্বালানি নির্ভরতা কমাবে। আমাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। কারণ এই গাড়ির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো জ্বালানি কম খরচ হবে। একইসঙ্গে একটি পরিত্যক্ত গাড়িকে সহজেই ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হবে। উদ্ভাবিত এই গাড়িটির জ্বালানি খরচ খুবই কম হবে।

উদ্ভাবিত হাইব্রিড গাড়ির সুবিধাগুলো হচ্ছে: একইসঙ্গে ইলেকট্রিক্যাল প্লাগ ইন, ইঞ্জিনসেবা ও সোলার চার্জিং সিস্টেম। এর ফলে জ্বালানি শেষ হলেও চলবে গাড়ি। সোলার সিস্টেম থাকায় যানজটে আটকে থাকলেও ব্যাটারি চার্জ হবে। তাই শক্তি বা জ্বালানির অপচয় হওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া আছে প্লাগ চার্জিং সিস্টেমও। বিদ্যুতের সাহায্য নিয়ে চার্জ দেয়া যাবে।

শিক্ষার্থীরা জানান, পোর্টেবল ডিভাইসের মতো এই প্রযুক্তিটি এখন যেকোনো গাড়ির সঙ্গে ব্যবহার করা যাবে। ব্যাটারি ব্যবহার করেও ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতি পাওয়া সম্ভব হবে। তাছাড়া একবার চার্জ হলে জ্বালানি ব্যবহার ছাড়াই একটানা ২৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলা সম্ভব। একটি পরিত্যক্ত গাড়ি থেকে হাইব্রিড গাড়ি রূপান্তর করে ব্যবহার উপযোগী করতে খরচ পড়বে মাত্র ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা।

কীভাবে চলে এই হাইব্রিড গাড়ি?

হাইব্রিড গাড়ি চলার জন্য প্রাথমিক শক্তি হিসেবে হাইব্রিড ব্যাটারি এবং দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়। ব্যাটারির চার্জ যদি শেষ হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইঞ্জিন চালু হয়। ব্যাটারির শক্তি গাড়ির জন্য যথেষ্ট না হলে হাইব্রিড ব্যাটারি এবং ইঞ্জিন যৌথভাবে শক্তি উৎপাদন করে আর গাড়ির চাকাকে রাখে গতিশীল। ব্যাটারি চাকার ঘূর্ণন গতি এবং ইঞ্জিনের পরিত্যক্ত কর্মশক্তি থেকে চার্জ সংগ্রহ করে। এভাবেই হাইব্রিড গাড়ি পরিচালিত হয়। এতে আপনি পেতে পারেন দ্বিগুণ মাইলেজ। এই গাড়িতে জ্বালানি এবং ব্যাটারি শক্তি যৌথভাবে ব্যবহৃত হয়। তাই ইঞ্জিন যখন জ্বালানিতে চলে তখন ব্যাটারি ইঞ্জিনের পরিত্যক্ত শক্তি সংগ্রহ করে। আবার চাকা ঘুরলে যে ঘূর্ণন শক্তি উৎপাদন হয় তা থেকেও ব্যাটারি শক্তি পায়। আর যখনি ব্যাটারি পরিপূর্ণ বা আংশিক চার্জ হচ্ছে তখন ইঞ্জিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে ব্যাটারির শক্তিতে গাড়ি চলতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, এই পরিবর্তন গাড়ি নিজে থেকেই করে। এ জন্য আলাদা কোনো সুইচ চাপতে হয় না। গাড়ি নিজের প্রয়োজনে ব্যাটারি বা ফুয়েলকে জ্বালানি শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে।

অন্যদিকে কার্বনমুক্ত বিকল্প জ্বালানির কথা বহু বছর ধরেই ভাবছে মানুষ। কিন্তু এই খোঁজাখুঁজির কারণ হিসেবে পরিবেশ ও প্রকৃতির সুরক্ষার কথা বললেও শুরুতে কারণটি ছিল সম্পদের সীমা। এখন পর্যন্ত মোটাদাগে শক্তির উৎস ওই খনি। কিন্তু খনি তো আর অসীম নয়। সেখানে থাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মজুত, যা টিপে টিপে খরচ করতে হয়। তাই একটা সময় এই মজুত ফুরিয়ে যাবে। এসব বিবেচনাতেই প্রথম নবায়নযোগ্য বিকল্প জ্বালানি উৎসের সন্ধানে নামে মানুষ। এ ক্ষেত্রে মানুষ বরাবরই তাকিয়ে ছিল ওই সূর্যের দিকে, যাকে আদি থেকেই মানুষ বিবেচনা করে এসেছে শক্তির এক অফুরান উৎস হিসেবে। এই সূর্যই অবশ্য শক্তির একটি বড় উৎসের সন্ধান দেয় মানুষকে।

রুয়েট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে এই প্রকল্পটি পান রুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের এ অধ্যাপক । এরপর ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে প্রকল্পটির মূল কাজ শুরু করেন। যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এমদাদুল হকের সঙ্গে এই উদ্ভাবন কাজে অংশগ্রহণ করেন বিভাগের শিক্ষক ফজলুর রশীদ ।

এছাড়া এ উদ্ভাবনের সঙ্গে রয়েছে বিভাগের ২০১৩-১৪ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহবুবুর রহমান, ওবায়দুল হাসান, তানভির রহমান, তরিকুল ইসলাম ও ২০১৪-১৫ বর্ষের শিক্ষার্থী ইসমাইল হক ফরিদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। গবেষকদের ব্যাটারি দিয়ে সহযোগিতা করেছে ‘গেস্টন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। উদ্ভাবন টিমের পক্ষ থেকে গেস্টনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে।