শেকৃবির গবেষণা

বাড়ির ছাদে চাষ হবে সামুদ্রিক শৈবাল!

ছাদের উপর সামুদ্রিক শৈবাল চাষের প্রযুক্তি
ছাদের উপর সামুদ্রিক শৈবাল চাষের প্রযুক্তি

বর্তমানে শহরের মানুষের কাছে ছাদ বাগান বেশ জনপ্রিয়। সে প্রেক্ষাপটে বাড়ির ছাদে কিংবা বারান্দায় ফুল, ফল বা শাক-সবজির বাগান এখন আর নতুন কিছু নয়। কিন্তু বাড়ির ছাদে কিংবা বারান্দায় সামুদ্রিক শৈবাল ‘স্পিরুলিনা’ চাষ অনেকটাই কাল্পনিক বিষয়। আপনার এই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) একদল গবেষক। শেকৃবি’র উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ফ ম জামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে এক বছরের গবেষণায় পাওয়া গেছে এই সাফল্য। 

স্পিরুলিনা হল নীলাভ সবুজ বর্ণের এককোষীয় সামুদ্রিক শৈবাল। যার বৈজ্ঞানিক নাম Arthrospia maxiama। উচ্চমাত্রার পুষ্টিগুণের কারণে এটি সুপার ফুড নামেও পরিচিত। ফলে সারা পৃথিবী জুড়ে এই খাদ্যেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে কৃত্রিম জলাশয়ে স্পিরুলিনা নামের এই সামুদ্রিক শৈবাল চাষ করা হয়। তবে ছাদে এর চাষ প্রথম শুরু করা হয় থাইল্যান্ডে। যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একেবারেই নতুন। 

শেকৃবির কৃষি অনুষদ ভবনের ছাদে ঢুকে একটু এগোলেই চোখে পড়বে প্রায় ‘শ খানেক সাদা ড্রাম। পাইপের মাধ্যমে এগুলোর একটির সাথে অন্যটি সংযুক্ত। ড্রামের ভেতরের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে নানা উপাদান মিশ্রিত পানির দ্রবণ। যেখানে সমুদ্রের পানির মত ড্রামের ভেতরের পানি চলমান রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ব্লোয়ার মেশিন। আর এর মধ্যেই উৎপাদিত হচ্ছে  স্পিরুলনা। গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড.আ ফ ম জামাল উদ্দিন বলেন, আমরা চার ফুট উচ্চতা ও তিন ফুট ব্যাসসম্পন্ন ৯৬টি ফুডগ্রেডেড ড্রাম ব্যবহার করেছি। প্রতিটি ড্রামে ২৫০ লিটার পানিতে সোডিয়াম বাইকার্বোনেট, ইউরিয়া, মিউরেট অব পটাশ (এমওপি), ম্যাগনেসিয়াম সালফেট নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে দ্রবণ প্রস্তুত করেছি। এই দ্রবণ থেকে স্পিরুলিনা প্রয়োজনীয় সব খাদ্য নিতে পারবে। একবার তৈরীকৃত দ্রবণের মাধ্যমে প্রায় ৬ মাস পর্যন্ত স্পিরুলিনা উৎপাদন করা সম্ভব। তবে ৬ মাস পর পুনরায় নতুন দ্রবণ তৈরী করতে হবে।

ছাদের উপর সামুদ্রিক শৈবাল চাষের সাদা ড্রামগুলো

তিনি বলেন, এদিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহের জন্য নল দিয়ে বাইরে থেকে অক্সিজেন সররাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমুদ্রের মতো পানি চলমান রাখার জন্য ব্যবহার করেছি ব্লোয়ার মেশিন। ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে ড্রামগুলোকে ৭টি ইউনিটে ভাগ করে প্রতিটি ইউনিটকে পাইপ দ্বারা সংযুক্ত করা হয়েছে। তিনি জানান, সূর্যের আলোতে এবং অধিক তাপমাত্রায় স্পিরুলিনা ভালো জন্মে। তাই এটি চাষের জন্য বাড়ির ছাদ উত্তম জায়গা। তবে দৈনিক সাত থেকে আট ঘণ্টা সূর্যের আলো পর্যাপ্ত থাকে বাড়ির এমন জায়গায় এর চাষ করা যাবে। সূর্যের আলো ছাড়া কৃত্রিমভাবে আলো সরবরাহ করে এটি উৎপাদন করা যায় কিনা সে ব্যাপারেও গবেষণা চলছে।

ড. জামাল আরো বলেন, গবেষণার শুরুতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাইল্যান্ড থেকে আনার কারণে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হত। তবে খরচ কমানোর জন্য আমরা পরবর্তীতে দেশি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছি। দেশে তৈরি ফুডগ্রেডেড ড্রাম ব্যবহার করায় উৎপাদন খরচ দশ ভাগের এক ভাগে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে এতে উৎপাদনের পরিমাণের কোন তারতম্য ঘটেনি। বর্তমানে প্রতিটি ড্রাম থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৫ গ্রাম শুষ্ক স্পিরুলিনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। ২৫০ লিটারের দুটি ড্রামে স্পিরুলিনা চাষ করে চারজনের একটি পরিবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব। স্পিরুলিনা বিভিন্নভাবে ব্যবহার উপযোগী হওয়ায় একে শুকিয়ে গুঁড়া করে সালাদ, নুডলস, শাকসবজি, আইসক্রিম, ফালুদা এবং শরবত বা জুসের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া যায়। তবে কাঁচা স্পিরুলিনা স্বাস্থ্যের জন্য বেশী উপকারী।

কৃত্রিম ভাবে ছাদে উৎপন্ন সামুদ্রিক শৈবাল

 

গবেষকদের মতে, ১০০ গ্রাম স্পিরুলিনায় ৩৭৪ কিলোক্যালরি শক্তি রয়েছে। ১০০ গ্রাম স্পিরুলিনার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই প্রোটিন। এ ছাড়া এতে উচ্চমাত্রায় লৌহ, পটাশিয়াম, জিংক ও ক্যালসিয়াম রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের হিসাবে, ১০০ গ্রাম স্পিরুলিনায় ৫৮২ গ্রাম কলিজার সমপরিমাণ লৌহ, তিনটি কলার সমপরিমাণ পটাশিয়াম, ৩৭৭ গ্রাম শাকের সমপরিমাণ জিংক ও ১১০ মিলিলিটার দুধের সমপরিমাণ ক্যালসিয়াম রয়েছে। ফলে বিভিন্ন দেশের পুষ্টিহীনতা দূর করতে জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক প্রতিবেদনেও (২০০৮) স্পিরুলিনা ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। 


সর্বশেষ সংবাদ