এইচএসসি পরীক্ষার খোঁজ নেই, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং বাণিজ্য রমরমা

  © টিডিসি ফটো

দেশে মহামারি করোনা প্রাদুর্ভাবে স্থগিত রয়েছে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা। সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় ঘরবন্দি রয়েছে পরীক্ষার্থীরাও। আর এই সুযোগটা হাত ছাড়া করছে না বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল ভর্তি কোচিংগুলো। ভর্তির জন্য প্রস্তুতি কোচিং নামে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। জুম অ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অনলাইনেই এসব কোচিং চলছে।

বিগত বছরগুলোতে ফল প্রকাশের প্রায় দুই মাস পর শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি প্রক্রিয়া। করোনাভাইরাসের কারণে এইচএসসি পরীক্ষা কবে অনুষ্ঠিত হবে এ ব্যাপারে কোনো খবর না থাকলেও কোচিং ব্যবসায়ীদের কোচিং বাণিজ্য থেমে নেই। ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার অনেক আগেই তাদের নিয়ে ব্যবসায় মেতে উঠেছে তারা। ফলে শিক্ষার্থীরা দু’টানায় পড়ে বিপর্যয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, কোচিং বাণিজ্য অনলাইনে হচ্ছে, এটি দুঃখজনক। শিক্ষার্থীরা এইচএসসি পরীক্ষায় বসার আগেই অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির কোচিং কার্যক্রম চালু রেখেছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের দুই পরীক্ষার প্রস্তুতি একসঙ্গে নিতে গিয়ে বেশ সমস্যায় পড়বে। এমনকি মানসিক সমস্যাও হতে পারে। ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করা এ কোচিং সেন্টারগুলো এই অমানবিক কাজ করতে পারে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনলাইনে কোচিংয়ে ভর্তির নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ ভর্তি কোচিং সেন্টারগুলো। ফার্মগেট, শান্তিনগর, মৌচাক, নিউমার্কেট, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী ও মিরপুরসহ দেশের সবগুলো শাখাতেই চলছে অনলাইনে কোচিং বাণিজ্য।

এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে ইউসিসি, উদ্ভাস-উন্মেষ, মেডিকো, ফোকাস, রেটিনা, ওমেকা, আইকন, প্যারাগন ও ক্লাইমেক্সসহ দু’ডজন কোচিং সেন্টার। সারা দেশেই এদের শাখা রয়েছে। তবে করোনাকালীন দুঃসময়ে অনলাইনে কোচিং-বাণিজ্যে বিভাগীয় শহরের শাখাগুলো চাঙ্গা রয়েছে বলে জানা গেছে।

আর বেশিরভাগ কোচিং সেন্টারগুলোতে পর্বে পর্বে অনলাইন কোচিং করার নামে আলাদা ফি নেওয়া হচ্ছে। কোচিং সেন্টার ভেদে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করে বিকাশে আগাম পেমেন্ট নেওয়া হয়েছে। আবার অনেকেই বলছে, এখন ১০ হাজার টাকা দিলেই হবে, বাকি টাকা স্বাভাবিক পরিবেশে যখন কোচিং ক্লাস শুরু হবে তখন নেওয়া হবে। তবে সবাই টাকা দিয়ে ভর্তি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু অনলাইনে সবাই কোচিং-এ অংশ নিতে পারছে না।

আবার বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করতে অনলাইনে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন দিচ্ছে কোচিং সেন্টারগুলো। বিজ্ঞাপনে তারা বলছে, ‘ভর্তি হওয়া এখন মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার... পেমেন্ট কর ১০ হাজার টাকা রকেট কিংবা বিকাশে। ১ ঘণ্টার মধ্যেই পেয়ে যাবে কনফারমেশন। পরবর্তীতে অনলাইনে ক্লাস করতে এবং পরীক্ষা দিতে অবশ্যই ক্লাস শুরুর পর ৭ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। আগে টাকা পাঠাও পরে ট্রানজেকশন আইডিসহ মেসেজ পাবা।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষাব্যবস্থার দুর্গতির প্রতিফলন হচ্ছে এসব বাণিজ্যিক কোচিং ব্যবস্থা। এইচএসসি পরীক্ষা না দিয়েই যদি ছাত্র-ছাত্রীরা কোচিং শুরু করে তবে এটি হবে দুঃখজনক। কোচিংকে বৈধতা দিয়ে এটিকে সমান্তরাল শিক্ষা মনে করা হচ্ছে, এটি আরও দুঃখজনক। এসব কোচিংব্যবসা নিষিদ্ধ করে শিক্ষা আইন করতে হবে। কোচিং থাকতে পারে অনগ্রসর ও বিশেষ শিক্ষার্থীদের জন্য। এটি স্কুলের শিক্ষকরাই বিশেষ দিনে করতে পারবেন। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে কেউ ব্যবসা করতে পারবেন না, এটি সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।

এদিকে এইচএসসি পরীক্ষার আগেই কেন ভর্তি কোচিং শুরু হয়েছে এ ব্যাপারে কোচিং মালিকরা শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির বক্তব্যের প্রতি ইংগিত করছেন। এর আগে ঘরবন্দি শিক্ষার্থীদের ছুটির সময়গুলো কাজে লাগাতে অনলাইনে দক্ষতা বৃদ্ধি ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যস্ত থাকতে বলেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। আর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি জন্য অন্যান্য বছরের মতো এবার তোমরা অতিরিক্ত সময় না পেতে পার। এজন্য এইচএসসি পরীক্ষার পাশাপশি ভর্তির জন্যও প্রস্তুতি নিয়ে রাখ।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের নিয়মিত আয়োজন ‘ক্যাম্পাস টক’ এর ফেসবুক লাইভে এসব কথা জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। এখন এইচএসসি পরীক্ষার আগে অনলাইনে কোচিং চালুর বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর এ বক্তব্যকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন কোচিং মালিকরা। অথচ সে বক্তব্যে তিনি পরীক্ষার আগে পুরোদমে কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে প্রস্তুতি নেয়া এবং অনলাইনে ভর্তি কোচিং চালুর কোন বক্তব্য বা ইংগিত দেননি। বরং তিনি ঘরে বসে এইচএসসি ও সমমানের পাশাপাশি ভর্তির প্রস্তুতিও সেরে ফেলতে বলেছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিং সেন্টারগুলোর মালিকরা অ্যাসোসিয়েশন অব শ্যাডো অ্যাডুকেশন বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন করেছে। যার কোনো অনুমোদন এখনও পায়নি। সেই সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুব আরেফিন বলেন, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এইচএসসি পরীক্ষার বিষয় ও সিলেবাস কমানো হবে। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। তার এই বক্তব্যের পরই আমরা পুরোদমে অনলাইন ভর্তি কোচিং শুরু করে দিয়েছি।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি একসঙ্গে চলতে পারে না। এতে শিক্ষার্থীরা এইচএসসির প্রস্তুতি থেকে সরে আসবে। এতে এইচএসসির প্রস্তুতি ও ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং অভাবে কোচিং ব্যবসায়ীরা এ সুযোগ নিচ্ছেন। এদিকে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে কোচিংকে বৈধতা দিয়ে এটিকে সমান্তরাল শিক্ষা চালু করার চেষ্টা চলছে। এসব কোচিং ব্যবসা নিষিদ্ধ করে একটি যুগোপযোগী শিক্ষা আইন প্রণয়নের উপর তাগিদ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।

বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রস্তুতির জন্য কোচিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে দেশে। সরকারি ও বেসরকারি চাকরির জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য রয়েছে প্রস্তুতিমূলক কোচিং। কিন্তু এসব কোচিং সেন্টারের জন্য কোনো নীতিমালাই নেই সরকারের।


সর্বশেষ সংবাদ