করোনায় লড়ছে ঢাবিসহ দেশের পাঁচ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

করোনাভাইরাস
করোনাভাইরাস  © প্রতীকী ছবি

জাতির সংকট ও দুর্দিনে সব সময় পাশে থেকেছে দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং আশির দশকে স্বৈরাচার পতন আন্দোলন— এসব সংকটে সামনের সারিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা। দেশে চলমান করোনা সংকটেও হাত গুটিয়ে বসে নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গবেষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হতদারিদ্র শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে দেশের অসহায়-দুঃস্থ পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা। ভাইরাস থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে তা বিনামূল্যে বিতরণও করেছে তারা।

তবে এ সংকটে সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করা ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে ইতিমধ্যে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু), যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি)।সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, দেশে এ পর্যন্ত ৪৯টি ল্যাবে এ পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে এ পরীক্ষা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চলমান করোনা সংকটে সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তবে এটা করতে গিয়ে তাদেরকে আর্থিক সংকট, জনবল সংকটসহ নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এজন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছেন তারা।

জানা যায়, গত ৯ এপ্রিল দেশের চার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস সনাক্তকরণের জন্য পিসিআর ল্যাব চালুর অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু), যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)। এরপর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে প্রথম করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার শুরু করা হয়। এরপর ২৫ এপ্রিল সিভাসু, ৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৩ মে নোবিপ্রবিতে এবং ১৮ মে শাবিপ্রবিতে করোনা পরীক্ষা চালু করা হয়। 

গত বুধবার (২৭ মে) করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমতি পেয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। চলতি সপ্তাহে ল্যাব উদ্বোধন করা হতে পারে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও করোনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবের প্রয়োজনীয় সামগ্রী আনার প্রসেস চলছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সরকার অনুমতি দিলে আগামী জুনে তাদের ল্যাবে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা যাবে বলে জানিয়েছে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেয়ে গত ৫ মে করোনার নমুনা পরীক্ষার মধ্যদিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ল্যাবটি চালু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাবির উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র (কারস) ভবনে এই ল্যাব স্থাপন করা হয়। শুরু থেকে করোনা পরীক্ষার কিট, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দিয়ে আসছে। তবে এর বাইরেও বিভিন্ন আনুষাঙ্গিত যে খরচ তা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেই ব্যয় করা হচ্ছে। তবে এই ব্যয় আর বহন করতে পারবে না তারা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, আমরা টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করেছি। আমাদের ল্যাবের কাজ চালানোর জন্য এলামনাই এসোসিয়েশন, শুভাকাঙ্ক্ষী, বিভিন্ন অনুষদ, ডিপার্টমেন্ট আমাদের সহযোগিতা করেছে। সেই অনুপাতে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় করোনাভাইরাস রেসপন্স টেকনিক্যাল কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. শরীফ আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ল্যাব পরিচালনা করতে প্রতিমাসে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার আর্থিক খরচ হচ্ছে, যা বহন করা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কঠিন এবং বাড়তি চাপ।

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি শিক্ষা এবং গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান। এটা কোন মেডিকেল নয়, স্বাস্থ্যসেবামূলক কোন প্রতিষ্ঠান নয়। তার চেয়ে বড় কথা হলো আমাদের ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ল্যাবে যারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং চলমান শিক্ষার্থী। তারা কাজটি সম্পূর্ণ ভলেন্টিয়ারি করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অথবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কোন প্রণোদনা না দেওয়া হয় তাহলে একসময় কাজে অনীহা চলে আসাটা স্বাভাবিক। করোনা টেস্টিং ল্যাব পরিচালনায় কিছু আর্থিক খরচ আছে, যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেয় না। এ কারণে আর্থিক চাপ পুরোপুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর এসে পড়ে। আমরা আপদকালীন সময়ে এই সেবা চালু করেছি ৷

১৩ মে থেকে নোবিপ্রবিতে শুরু হওয়া এই কার্যক্রম বর্তমানে চলছে। প্রতিদিন ৯০টি নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে নোবিপ্রবির ল্যাবে। এখানে গত ১৫ দিন এই অঞ্চলের তিনটি জেলার নমুনা টেষ্ট করা হচ্ছে। এরমধ্যে কিট সঙ্কটে একবার পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেলে পাশের কেন্দ্র আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ থেকে কিছু কিট ধার করে পরীক্ষা চালিয়ে নেওয়া হয়।

পরীক্ষা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, এই কেন্দ্রে নমুনার তুলনায় কিট কম আসে। এজন্যই এই সঙ্কটে পড়তে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। তাছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচের তুলনায় বাজেট কম হওয়ায় এই কার্যক্রম চালাতে গিয়ে কিছুটা আর্থিক সঙ্কটেও রয়েছে বলে সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে নোবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. দিদার-উল-আলম বলেন, নমুনা পরীক্ষা চালুর পর থেকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে স্বল্প বাজেটের এই বিশ্ববিদ্যালয়কে। তারপরও সরকার নিয়মিত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে খরচ করে আসছেন, তার কিঞ্চিৎ ঋণও যদি এতে শোধ হয়। আমাদের সাধ্য মত আমরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবো। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা চলমান সঙ্কটে সরকারকে সম্ভব সব সহযোগিতা করবো।

এছাড়া যবিপ্রবিতে বৃহত্তর যশোরের চার জেলার করোনা পরীক্ষা কার্যক্রম চালছে। এতে দিনে ২০০টি নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব বেল জানা গেছে। শাবিপ্রবিতে প্রতিদিন সিঙ্গেল সাইকেলে ৯৪টি নমুনা এবং ডাবল সাইকেলে ১৮৮ টি নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া সিভাসুতে প্রতিদিন ১০০টি করে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। 

জুলাই থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নমুনা পরীক্ষা সম্ভব: আগামী জুলাই থেকে নভেল করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা শুরু করবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। বৃহস্পতিবার (২৮ মে) গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান।

উপাচার্য বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় করোনার নমুনা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় পিসিআর মেশিন আনা হচ্ছে। ল্যাব প্রস্তুতিরও কাজ চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে জুলাই মাস থেকে টেস্ট শুরু করতে পারব।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এক্সপার্ট আছেন, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ল্যাব ও পিসিআর মেশিনের অভাবে কাজ শুরু করতে পারিনি। সম্প্রতি আমরা আমেরিকান প্রতিষ্ঠান সিডিং ল্যাবের ইনস্ট্রুমেন্টাল অ্যাকসেস অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছি। ওই সিডিং ল্যাব থেকেই দুটি পিসিআর মেশিনসহ প্রয়োজনীয় ল্যাব সরঞ্জাম পাচ্ছি, যা আসছে জুলাই নাগাদ আসার কথা রয়েছে।

অনুমতি পেল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য অনুমতি পেয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। বুধবার (২৭ ) স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ অনুমোদন দেওয়া হয়।

চিঠিতে বলা হয়, কোভিড-১৯ শনাক্তকরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিদফতর থেকে কোভিড-১৯ রোগের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা চালুর অনুমতি প্রদান করা হলো। কোভিড-১৯ পরীক্ষার প্রয়োজনীয় কিটস এবং লজিষ্টিক স্বাস্থ্য অধিদফতর হতে সরবরাহ করা হবে। শনাক্তকরণের পরীক্ষার সমন্বিত ফলাফল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ল্যাব কল সেন্টার এবং ডিএইচআইএস-২-এ প্রেরণ করতে হবে।

জানা যায়, চবি জীববিজ্ঞান অনুষদের সেন্ট্রাল বায়োলজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে এই করোনা টেস্ট করা হবে। এ উপলক্ষে আক্রান্ত ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষার জন্য বায়োসেইফটি লেভেল-২ মানের ল্যাব প্রস্তুত করা হয়েছে। ল্যাবটি চালু হলে দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ নমুনা পরীক্ষা করা যাবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এস এম মনিরুল হাসান  বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে চিঠি পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আজ সভা করেছি। আশা করছি আগামী সোমবার ল্যাব উদ্বোধন করতে পারবো। এতে ভিডিও কনফারেন্সে শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী ও জেলা প্রশাসনক উপস্থিত থাকবেন।


সর্বশেষ সংবাদ