নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- জাতি হিসেবে আমরা নিকৃষ্ট

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছি প্রায় দুই বছর ধরে। এই দুই বছরের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, জাতি হিসেবে আসলেই আমরা খুব নিচু এবং নিকৃষ্ট মানসিকতার ধারক। পৃথিবীতে আর এমন কোন জাতি আছে কিনা আমার জানা নেই যারা নিজেরাই নিজেদেরকে ঠকায়, প্রতারিত করে, বিভ্রান্ত করে এবং মৃত্যূর দিকে ঠেলে দেয়। এমন একটি জায়গা পেলাম না যার সম্পর্কে বলা যায়, এটি শতভাগ সঠিক।

কাঁচাবাজারে যখন যাই দেখা যায় ৯০ শতাংশ দাঁড়ি পাল্লাতেই রয়েছে ফাঁকফোকড়, প্রায় সবকটি পাথরেই ১০-১০০ গ্রাম পর্যন্ত কম। ভাল সবজির মাঝে মাঝে ইচ্ছাকৃতভাবে ঢুকিয়ে রাখা হয় পুরাতন, বিক্রি না হওয়া পঁচাবাসি সবজি, পোকাযুক্ত সবজি। মাপে কম দেয়া, নিম্ন মানের সবজি ভাল বলে চালিয়ে দেয়া ও অযৌক্তিক আর অতিরিক্ত মূল্য রাখা যেন এদেশের কাঁচা বাজারের খুবই সাধারণ বিষয়। অথচ একজন নিম্ন আয়ের দিন মজুর থেকে শুরু করে সংসদসদস্য পর্যন্ত প্রত্যেকটি নাগরিকই এর ভোক্তভোগী হচ্ছে প্রতিদিন। কাঁচা বাজারের পাশেই মাছ বাজার। সেখানে ডাকাতির পরিমানটা আরেকটু বেশি। ওজনে কম দেয়া যেন মাছ বাজারের নিয়মিত বিষয়।

তাছাড়া পৃথিবীর বেশির ভাগ সভ্য দেশেরই সকল মাছের দাম সরকারিভাবে নির্ধারিত থাকলেও এদেশেই শুধু আরজকতার উদাহারণের পরিণত হয়েছে আমাদের মাছের বাজার। ধরেই নেয়া হয়, সকল নাগরিক মাছ ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি। মুলামুলি করে হাতে পায়ে ধরে যে দামে কেনা যায় তাতেই বাঁচি। আর তার উপর যদি শার্টপেন্ট পরিহিত একটু ভদ্রবেশ টাহর করতে পারে তাহলে তো মৎস্য ব্যবসায়ীদের পোয়া বারো। ১০০ টাকার মাছ ১০০০ টাকা দাম হাকাতেও কোন ধরণের বিবেকবোধ কাজ করে না তাদের। এ কেমন অনাচার আমি চিন্তা করে পাই না। এর উপর পঁচামাছকে ভালো মাছ বলে বিক্রি করা তো হরহামেশাই ঘটছে। আমি নিজেও যে কত বার গিন্নির কাছে লজ্জ্বিত হয়েছি তার হিসাব নেই। মাছ বাদ দিয়ে মাংস কিনতে যাবেন, তাও ঠকতে হবে আপনাকে। বার বার ডিজিটাল পরিমাপ মেশিন ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হলেও মাংস ব্যবসায়ীরা খুব কমই মানছেন এসব। বরং চড়া দামের মাংসে যদি ১০০ গ্রামও কম দেয়া যায়, তাতেই যেন কসাই বাবাজিদের সফলতা। আর দামের কথা কি বলবো!

প্রত্যেকটি পৌর অঞ্চলে মাংসের দাম কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দিয়ে থাকলেও আমাদে ব্যবসায়ীরা তোড়াই কেয়ার করে তাদের । মূল্য তালিকা বাধ্যতামূলক থাকলেও তার ব্যবহারের বালাই নেই বললেই চলে, তথাপি দুই একটি দোকানে মূল্য তালিকা ঝুলতে থাকলেও তালিকার দাম ও বিক্রিত দামের মাঝে নেই কোন সম্পর্ক। মাংসের সঙ্গে হড্ডি বাড়িয়ে দিয়েও লাভ করতে ভুলেন না উনারা। পাশাপাশি পঁচা ও নষ্ট মাংস বিক্রিতো মুটোমুটি নিয়মিত চর্চা হয়েই দাড়িয়েছে। বিক্রয় না হওয়া মাংসগুলোকে দিনের পর দিন নিম্ন মানের ফ্রিজে সংরক্ষণ করে পরবর্তিতে ভালো মাংসের সঙ্গে চালিয়ে দিতেও ওস্তাদ তাড়া। আর ছাগলের বদলে ভেড়া, গরুর বদলে মহিষ বিক্রি তো এখন প্রায় ওপেন সিক্রেট। অথচ পৃথিবীর আর কোন দেশে এমন স্বীকৃত জোচ্ছরি চালু আছে মর্মে আমার জানা নেই।

ভাববেন না খাসি-গুরু বাদ দিয়ে মুরগী খাওয়া শুরু করবেন! সেখানেও কিন্তু আপনার জন্য কোন সুখবর নেই। ওজনে কম দেয়া, মূল্য বেশি রাখা, কিংবা মাপের সময় একটি মুরগী দেখিয়ে দেয়ার সময় কম ওজনের আরেকটি মুরগী দিয়ে দেয়াতো আপনাদের জানাই আছে। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না, রাতে যে মুরগটি মারা গেছে তাকেই জবাই করে ড্রামে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। আর ভিড়ের মধ্যে কোন এক ফাকে ওই মরা জবাইকৃত মুরগটিই ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে আপনার বেগে। আর এখন যে ফার্মের মোরগ বাজারে সুলভ তার ফিড নিয়েতো বিতর্ক আছেই।

গবেষনাতেই বলা হচ্ছে, এতে রয়েছে ক্যনসারসহ বিভিন্ন রোগের উপাদান। মাছ মাংসতে মিশে যাচ্ছে উচ্চ মাত্রার এন্টিবায়োটিক যা আমাদের দেহেও প্রবেশ করেছে অনায়াসেই। মাছ –মাংস ছেড়ে শুটকি খাবেন। নাহ! সেখানেও আপনি নিরাপদ না। কেননা আমাদের দেশীয় প্রায় সকল শুটকিতেই সংরক্ষণের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয় ডিটিপির মত পোকা নাশক বিষ যা মানব দেহের জন্য মারাত্বক হুমকি। মাছ- মাংস -সবজি শেষে মুদির দোকানেও কিন্তু আপনাকে ঠকানোর জন্য বসে আছেন আমাদের দোকানিরা। মূল্য তালিকার জন্য শতবারও যদি তাদেরকে বলা হয় তারপরও তারা তা ব্যবহারে অনীহা।

এর কারণ একটাই, ২ টাকার জায়গায় ৫ টাকা রাখা আর বাজারকে অস্থিতিশীল কারার সুযোগ হাতছাড়া করতে না চাওয়া। হামেশাই যে সব প্রতারণা হয়ে থাকে দোকানগুলোতে তার মধ্যে পরে নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত মূল্য আদায়, ওজনে কম দেয়া, নিম্নমানের ও নকল-ভেজাল পন্য বিক্রয় করা, ইঁদুর-তেলাপোকা কাটা-খাওয়া পন্য বিক্রয়, মেয়াদউত্তীর্ণ ও মেয়াদবিহীন পণ্য বিক্রয় ও ক্রেতাদের সঙ্গে চরম দুর্বব্যবহার। বছরের পর বছর ধরে এ চর্চা চলে আসায় দোকানিদের কাছে যেন তা খুবই স্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছে। রাস্তার পাশে বৈধ-অবৈধভাবে গজিয়ে ওঠা ফলের দোকানগুলোও কম যায় না। কাগজের ঠোঙ্গার ওজন ১০০-২০০ গ্রাম দেয়া হচ্ছে, মাপে কম দেয়া হচ্ছে, পঁচা ফল দেয়া হচ্ছে, আর মূল্য! এতো তাদের মর্জি। এর উপর রমজান মাস আসলে তো কলার হালি চল্লিশে গিয়ে ঠেঁকে এদেশে, অন্য ফলের কথা নাইবা বললাম। ফলেতে ইথোফেন থেকে শুরু করে সহজলভ্য সকল ধরণের রাসায়নিক ব্যবহারে একপাও পিছুপা হন না আমাদের ব্যবসায়ীরা।

অথচ এই বিষাক্ত ফল হয়তো প্রতি মূহুর্তেই কেড়ে নিচ্ছে কারো না কারো জীবন। মাছ-মাংস, ফল ফলাদির বাইরে আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আর তা হচ্ছে আমাদের হোটেল-রেস্টুরেন্ট। আমাদের দেশের এই খাতটির এতই খারাপ অবস্থা যে, এ বিষয়ে কথা বলতেও বিবেকে বাধে। একেবারে সচারাচর চিত্র যদি তুলে ধরি তাহলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রায় সকল হোটেলের ঢাকনাবিহীন খাবার যেখানে পোকামাকড়, তেলাপোকা, ইঁদুর অবাধে বিচরণ করতে পারে। কতটুকো বিবেক বর্জিত হলে একজন মানুষ সারারাত ইঁদুর বিড়ালে চাটা খাবার আবার সকালবেলা মানুষের সামনে পরিবেশন করতে পারে তা আমার জানা নেই। মাঝে মাঝে ঘৃণা হয় তাদের প্রতি, মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় গুলি করে মেরে ফেলি তাদের। জেলা পর্যায়ে আজকে পর্যন্ত কোন রেস্টুরেন্টে কোন কর্মচারীকে হাতে গ্লাপস, শরীরে এ্র্রপ্রোন কিংবা মাথায় ক্যাপ ব্যবহার করতে দেখিনি। অথচ খাবারে চুল কিংবা শরীরে ঘাম অবলীলায় মিশছে , সাবান ছাড়াই বাথরুম ব্যবহার করে এসে নোংড়া হাত দিয়ে অবলীলায় খাবার পরিবেশন করছে। আর আমরাও খাচ্ছি। আর হোটেল রেস্টুরেন্টের পরিবেশের কথা কি আরো বলবো!

কেউ যদি একবার ভালো করে দেখে সে আর কয়েকদিন নিজের ঘরেও খাবার খেতে পারবে না। স্যাঁতস্যাতে অন্ধকারের মাঝে রাখা হয় খাবার, অনেকসময় দেখি ড্রেইনের উপরেই চলে খাবার প্রস্তুত। বিশ্রি গন্ধে যেখানে দাড়িয়ে থাকাই কঠিন সেখানেই রাখা হয় খাবারের পাত্র। নোংরা কাপড় পরিহিত রাধুনেরা হয়তো ভাবেন পরিবেশ যত নোংরা হবে খাবারও হয়তো তত বেশি স্বাদ হবে!!!!!। আর রান্নার উপকরণগুলো সম্পর্কে একটু বলি। পোড়াতেলের মাঝে নিম্ন মানের মসলা আর নিকৃষ্ট মানের আয়োডিন বিহীন লবন তো খুবই সাধারণ।

এছাড়াও কৃত্রিমভাবে স্বাদ বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর টেস্টি সল্ট সহ আরো প্রায় ৭-১০ ধরণের উপকরণ ব্যবহার করে থাকেন তারা। জিলাপীতে-মিষ্টিতে হাইডোজ, বিসাক্ত কাপরের রং, সল্টোজ ইত্যাদি ব্যবহার যেন আমাদের কারিগরদর কাছে খুবই সাধারণ ব্যাপার। এদিকে হোটেলের ভিতরে বিশাল স্পেইচ থাকলেও রুটিটা ভাজতে হয় তাদের রাস্তার পাশেই। এটাই বুঝি তাদের বিজ্ঞাপণ! অথচ এর মাধ্যমে যে রাস্তার সকল ধুলাবালি এসে খাবারে মিশছে কে বুঝাবে তাদরে! আর অতিরিক্ত মূল্য রাখা, পঁচাবাসি খাবার পরিবেশন করা কিম্বা কাস্টমারের সঙ্গে দূর্ব্যবহার তো আমাদের রেস্টুরেন্ট সংস্কৃতির অংশ হয়েই দাড়িয়েছে। অথচ যে কোন সভ্য দেশে খাবারে ময়লা, চুল, কিম্বা পোকা পাওয়া বড় অপরাধ হিসাবেই গণ্য হয়ে থাকে। আর মাপে কম দিতে তো আমাদের হোটেল ব্যবসায়ীরা আরো এক ধাপ এগিয়ে।

মিষ্টির প্যাকেটের ওজন ক্ষেত্রভেদে ১৫০-২৫০ গ্রাম পর্যলন্ত হয়ে থাকে। তারা হয়তো ভাবেন কাগজ আর মিষ্টি একই জিনিস! এর উপর দুধের স্বরের বিকল্প হিসেবে টয়েলেট টিস্যূ ভিজিয়ে মিষ্টি তৈরি করা তো এখন তাদের কাছে অনেকটাই আধুনিক আবিস্কার হিসেবেই বিবেচিত। আর এতে লাভের পরিমানটাও যে আকাশচুম্বি। এদিকে দইয়ের কৌটা আমরা কোনদিন মেপে না কিনলেও এখানেও যে শুভঙ্করের ফাঁকি সে খোঁজ আমরা রাখি না। প্রতিটা কৌটায় ৫০-১০০ গ্রাম দই কম দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। দই সাধারণত তিন দিনের বেশি ভালো না থাকলেও প্রায়ই পচা বাসি দই বিক্রি করছেন তারা। অথচ দইয়ের গায়ে উৎপাদনের তারিখ ও মেয়াদ লেখার কথা থাকলেও তার মানছেন না আদৌ। এ তো গেলো মানুষের খাবারের সাতকাহন। ব্যবসায়ীদের এ লালসা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না নিরহ পশুপাখিও। ভেজাল পুশু খাদ্য, মেয়াদউত্তীর্ণ পশু খাদ্য ও ঔষুধ, নিম্ন মানের ভেটিনারি উপকরণে সয়লাভ আমাদের বাজার। ফলে লক্ষ লক্ষ টাকার ক্ষতির সম্মোখীন হচ্ছেন আমাদের খামারিরা। নকল কৃষি বীজ ও সার, নকল কীটনাশক জব্দ করতে করতে আমি অনেকটাই ক্লান্ত। লেখাপড়া না জানা কৃষক ভাইটি হয়তো জানেনই না যে কড়া মূল্যে কি তুলে দেয়া হচ্ছে তার হাতে।

ওহ! মানুষের ঔষুধের কথা তো বলাই হলো না। আমার কর্ম এরিয়ার এমন কোন একটি ফার্মেসি নাই যেটাতে ভোক্তা বিরুধী কার্যুক্রম চলছে না। শর্ট সাপ্লাই বলে অতিরিক্ত মূল্য রাখা, ভেজাল ঔষুধ বিক্রি করা, ফিজিসিয়ান সেম্পল ও সরকারি ঔষুধ বিক্রি করা, ফুড সাপ্লাইয়ের নামে অপ্রয়োজনীয় ঔষুধ বিক্রি করা, ডাক্তারদের সঙ্গে চুক্তিতে রোগীর নিকট অতিরিক্ত ঔষুধ বিক্রি করা, মেয়াদউত্তীর্ন ঔষুধ বিক্রি করাসহ সব ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ডে সিদ্ধহস্ত আমাদের ঔষুধ ব্যবসায়ীরা। এবার আসি কসমেটিকসে। এখানে যে কী পরিমান আরজকতা বিরাজ করছে তা বর্ণনাতীত। জিঞ্জিরার তৈরি কসমেটিকস দখল করে রেখেছে আমাদের বাজার। পাশাপাশি ভারতের সেভেন সিস্টার থেকে অবৈধভাবে আসা নিম্নমানের কসমেটিকস তো আছেই। নকল কসমেটিকস এতই বেশি যে ভালো কসমেটিকস পাওয়া মোটামোটি একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে।

তাছাড়া সাধারণ ক্রেতাদেরতো বোঝার কোন উপায়ই নেই যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল । এর বাইরেতো মেয়াদউত্তীর্ণ আর মেয়াদবিহীণ প্রসাধনী বিক্রি হরহামেশাই ঘটছে আমাদের বাজারে। তাছাড়া, লাগেজ পার্টির সরবরাহকৃত বিদেশি কসমেটিকসে দ্বিগুন তিনগুন মূল্য লাগিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের প্রতরনা করা তো খুবই কমন একটা বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। আসলে আমাদের দেশটাই নকলের দেশ। এখানে খাবার থেকে শুরু করে কাপড়, চশমা, ঘড়ি, জুতা, ব্যাগ, সবকিছুই নকল। বরং আসল নাই বললেই চলে। রেবন কিংবা টাইটান এখানে ফুটপাতে বিক্রি হয। পৃথিবী আরো কোন দেশে এত অবাধে নকল পণ্য বিক্রি হয় কিনা আমার জানা নেই। আর দাম নির্ধারণ! কি আর বলবো! কাপড়ের দাম তো যে যেভাবে পারে নিচ্ছেই পাশাপাশি অন্যান্য কনফেকশনারিতে ভোক্তাদের জবাই করতে একটুও পিছুপা হয়না আমাদের ব্যবসায়ীরা।

মেয়াদউত্তীর্ণ চিপস, চকলেট, বিস্কুট ড্রিংকস যেমন আশেপাশে বিক্রি হচ্ছে ঠিক তেমনি পর্যটন স্পটগুলোতেও বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। হাইওয়ে কিম্বা টোরিস্ট স্পটেতো দ্বিগুন মূল্য রাখাই হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসেই যে শুধ ভোক্তারা মার খাচ্ছে তা কিন্তু নয়। ঘরবাড়ি বানাবেন, তাতেও ছাড় নেই। ইটের মাপে কম, নিম্ন মানের ইট দেয়া, মিস্ত্রির সঙ্গে যোগসাজশ করে এক মাপের রড বলে আরেক মাপের রড দিয়ে দেয়া, সিমেন্টের বস্তায় ওজনের কম দেয়া, টিনের কারচুপিসহ নিম্নমানের ও নকল ভেজাল ইলেকট্রিক ওয়ার সরবরাহ তো আছেই। সিলিন্ডার গ্যাসের ক্ষেত্রে হচ্ছে আরো বড় জালিয়াতি। একটি সিলিন্ডারের গ্যাস আরেকটিতে ট্রান্সফার করে তৈরি করা হচ্ছে দুটি। কেনই বা করবে না, আমরা তো আর সিলিন্ডিার নেয়ার সময় মেপে নেই না।

রিম কাগজ কিনবেন, সেখানেও আছে কম। চকলেট বক্স কিনবেন, গুনে নিবেন কেননা এতেও প্রায়ই কম দেয়ার অভিযোগ আসছে। কাপড় কিনবেন, তিন গজ বলে যে আড়াই গজ তো দিবেই। আর টেইলারের দোকানে গিয়ে দেখবেন কাপরের শর্ট। এদিকে টেইলার কিম্বা লন্ড্রী ওয়ালারাও কম না। বাংলাদেশে বোধহয় এমন কোন হাতের কাজের কারিগর নেই যে কিনা নির্ধারিত তারিখে আপনার জিনিসটি সরবরাহ করবে। এটি আপনি টেইলারই বলেন কিম্বা মেকানিকই বলেন। এখানেই আপানেকে ঘুরানোটাই যেন রেওয়াজ হয়ে ওঠেছে। নাপিতের কাছে যাবেন, চুল কাটার পর যখন ৫০ টাকার জায়গায় ১০০ চায় তখন অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আরো কিছুই থাকে না। এখানে শুধু নিম্ন আয়ের ব্যবসায়ীরাই না উচ্চ আয়ের ভদ্রবেশের ব্যবসায়ীরাও ভোক্তাদের এক ইঞ্চি ছাড় দেয় না। স্কুল কলেজ- কোচিং সেন্টারগুলোতো ক্রমেই বাড়িয়ে চলছে তাদের ফি। দেখার কেউ নাই, বলার কেউ নাই।

আর শোরেুমগুলোর প্রতারণা তো সবারই জানা। লিখে দিচ্ছে ৫০% ছাড়। পাশেই ছোট করে অদৃশ্যমানভাবে লিখে দিচ্ছে ”আপটু”। কিনতে গিয়ে তো বোকা হওয়া ছাড়া কোন উপায়ই নেই। আবার ছাড়ের পণ্য কিনে বিব্রতকর অবস্থায়ও পড়তে হচ্ছে অনককে। দুই দিন যেতে না যেতেই নষ্ট কিংবা ব্যবহার অনউপযোগী হয়ে পড়ছে তা। এর বাইরেও আছে ওয়ারেন্টি গেরান্টি নিয়ে প্রতারাণা। ঠিকমত প্রতিশ্রুতি পালন না করাটা যেন অভ্যাসেই পরিণিত হয়েছে তাদের।

মোবাইল কোম্পানীগুলোর প্রতারণা আমি নাইবা বললাম। কেননা এর ভুক্তভোগী আমি নিজেও। তবে নুতন রুপে আসা অনলাইন বিজনেসের ফাদের কথা একটু না বললেই না। অর্ডার নিয়ে টাকা হতিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া কিম্বা প্রতিশ্রুত বা প্রদর্শিত পণ্য যথাযথভাবে না সরবরাহ করা তো প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনলাইন বিজনেস নিয়ে কোনো নীতিমালা না থাকায় লাগামহীন হয়ে পড়েছে তারা। আসলে এদেশের ভোক্তাদের অবস্থা এতটাই নাজুক যে, এ নিয়ে মহাভারত কিংম্বা রামায়নের মত বৃহৎ গ্রন্থও তৈরি করা কঠিন হবে না। এখানে সবাই ঠকায়, সবাই ঠকে। ডাক্তার, কবিরাজ, ইঞ্জিনিয়ার, মাস্টার, সরকারি অফিস, বাড়িওয়ালা, বিদেশের দালাল, কাজের বুয়া আর ব্যবসায়ী সবাই সবাইকে ঠকাচ্ছে। প্রতারাণা যেন আমাদের সংস্কৃতি, প্রতারণাই যেন আমাদের আনন্দ। আসলেই জাতি হিসেবে আমরা নিকৃষ্ট।


সর্বশেষ সংবাদ