বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার মেয়েরা

  © বিবিসি

দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন চলছে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার মৌসুম। এক্ষেত্রে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি না থাকায়, শিক্ষার্থীদের একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য একেক জায়গায় গিয়ে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এ কারণে অনেক সময় মেয়ে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ভোগান্তি পোহাতে হয়।

বাংলাদেশে এবছর সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন প্রায় দশ লাখ শিক্ষার্থী। এই ছাত্র-ছাত্রীরা এখন উচ্চ-শিক্ষার্থে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। তাদের প্রায় অর্ধেকের মতো নারী।

নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক অভিভাবক হয়তো মেয়েকে বাড়ি থেকে দূরে যেতে দিতে চান না, যেমন চাননি ফারিহা রহমান অ্যান্থিয়ার মা-বাবা।

ফারিহা রহমান অ্যান্থিয়া বলেন, ‘আমার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গারই ফর্ম তোলা হয়েছিলো। কিন্তু যেদিন রাজশাহী যাবো, টিকেট ঠিক, সাথে আম্মা যাবে তাও ঠিক, সকালে আব্বা বললেন, তোমাকে তো আমি ঢাকার বাইরে পড়াবো না। হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না হয় জাহাঙ্গীরনগর - এই দুই জায়গায় চান্স পাইলে পড়বা, নাহলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়।’

পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করার পর অ্যান্থিয়া এখন ঢাকার একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। কিন্তু এ ধরনের বাধা পেরিয়ে যারা অন্য শহরে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যান তাদের অনেকেরই পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। বিশেষ করে ওই শহরে যদি তাদের কোন আত্মীয় পরিজন না থাকে।

যে কারণে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি-যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার আগে আরেক ধরনের যুদ্ধে নামতে হয় অনেককে, যেমনটি বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবিদা সুলতানা। ‘আমার বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার সময় কুমিল্লার একটি কলেজে আমার সিট পড়েছিল, কিন্তু ওখানে আমাদের কোন আত্মীয় নাই। পরে আব্বু তার একজন পরিচিতর পরিচিত মানুষকে ধরে আমাদের থাকার একটা ব্যবস্থা করেছিল।’

‘এরপর রাজশাহীতে পরীক্ষা দিতে গিয়েও একজন পরিচিত মানুষের ছোটবোনের হলে থাকতে হয়েছিলো, সেটাও খুবই বিব্রতকর অভিজ্ঞতা আমার। সবার তো আর সামর্থ্য থাকে না একটা পরীক্ষার জন্য হোটেল ভাড়া নিয়ে থাকার। তারপর অন্তত দুইদিন থাকতে হলে, হোটেল ভাড়া, গাড়ি ভাড়া এবং খাওয়ার খরচ--যেগুলোও কম নয়। ফলে এসব ম্যানেজ করা খুব কঠিন।’

দূরত্ব, যাতায়াত ব্যবস্থা এবং থাকার জায়গা নিয়ে সমস্যার কারণে অনেক অভিভাবক নিজের মেয়েটিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাও দিতে দেন না। পড়ান জেলা বা থানা শহরের কলেজটিতে।

দেখা যায়, এইচএসসি পাস একটি ছেলেকে তার বাবা-মা বন্ধুদের সঙ্গে অন্য শহরে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যেতে আপত্তি না করলেও, একই বয়সী মেয়েটিকে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ানোর জন্য তারা তাকে সাথে করে নিয়ে যান।

খুলনার সোমা সরকার দেশের সবকটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ানোর জন্য মেয়েকে সাথে করে নিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, ‘সব জায়গায় খুঁজতাম পরিচিত কেউ আছে কিনা, আত্মীয় কেউ আছে কিনা। এরপর খোঁজা শুরু করতাম আমার স্বামীর কলিগ কেউ আছেন কিনা। তাদের বাসায় থেকে পরীক্ষা দেওয়াতাম। কারণ মেয়েকে নিয়ে হোটেলে থাকার কথা আমি ভাবিও নাই কখনো। ভয় ছিলো কেউ যদি ডিস্টার্ব করে!’

‘চট্টগ্রামে আমাদের পরিচিত বা কলিগ কেউ নাই বলে আমরা সেখানকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম তুলি নাই।’ তার মেয়েটি এখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে নারী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর সঙ্গে বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের হারও। ২০১৮ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন দুজন নারী শিক্ষার্থী।

২০১৭ সালে বগুড়া থেকে বাসে ময়মনসিংহে যাবার পথে বাস চালক, সহকারী এবং সুপারভাইজার একজন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রেখে যাবার পর সে ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। এছাড়াও বড় শহরগুলোর আবাসিক হোটেলে উঠতে গিয়েও অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা হয় অনেকের।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের উদাহরণের জন্যও অনেক অভিভাবক পিছিয়ে পড়েন মেয়েকে অন্য শহরে পড়তে পাঠানোর বিষয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা মনে করেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীর নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে, যে কারণে ভর্তি পরীক্ষার সময় নারী শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়ে।’

‘সমাজে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা, যে কারণে একই যোগ্যতা নিয়ে একটি মেয়ে অনেক জায়গায় মেধার প্রতিযোগিতায় নামতেই পারছে না। নারীর জন্য সমাজ যত অনিরাপদ হবে, ততই নারীর জন্য প্রতিবন্ধকতা বাড়তে থাকবে।’

‘এছাড়া আগে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেই সব কোন ঘটনার যদি বিচার হত, তাহলে পরিবেশটার পরিবর্তন হতো, নিরাপত্তা বাড়তো নারীদের। আলোচিত হত্যা এবং ধর্ষণের ঘটনাগুলোর যদি দৃষ্টান্তমূলক বিচার হতে দেখতাম তাহলেও নিরাপত্তাহীনতা কমে আসতো’, বলেন সামিনা লুৎফা। বিবিসি বাংলা।


সর্বশেষ সংবাদ