এক দশকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুই ডজন লাশ

  © টিডিসি ফটো

উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে জীবনকে আলোকিত করার স্বপ্ন নিয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ছাত্ররাজনীতির করাল গ্রাসে বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছে বদ্ধভূমিতে। দিনকে দিন দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল। প্রায় প্রতি বছরই প্রাণ হারাচ্ছেন কোনো না কোনো শিক্ষার্থী। সর্বশেষ রবিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

গত ১০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ (চবি) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে রাজনৈতিক সহিংসতায় লাশ হয়েছেন দুই ডজন শিক্ষার্থী। লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি মূলত এসব হত্যাকান্ডের প্রধান কারণ।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তবে সম্প্রতি সরকার দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তাতে বুয়েটের মতো নৃশংস ঘটনার সঠিক বিচার পাব বলে আশা করতে পারি।

চবিতে ৮ হত্যাকান্ড: ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের ষোল শহর রেলস্টেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মহিউদ্দিন কায়সারকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরে তাকে নিজেদের কর্মী দাবি করে ছাত্রলীগ ও শিবির হত্যার জন্য একে অপরকে দায়ী করে।

এর প্রায় দেড় মাস পর ২৮ মার্চ রাতে শাটল ট্রেনে করে চট্টগ্রাম শহর হতে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে চবি মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র হারুন অর রশীদকে গলাকেটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় নগরীর চৌধুরীহাট এলাকায়। একই বছরের ১৫ এপ্রিল চবি ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে অ্যাকাউন্টিং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী আসাদুজ্জামান নিহত হন।

২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও শিবিরের মধ্যে দফায় দফায় গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় মুজাহিদ ও মাসুদ বিন হাবিব নামের দুই শিবির কর্মী নিহত হয়েছেন। মাসুদ সোহরাওয়ার্দী হলের শিবির সেক্রেটারি ছিলেন।

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ বছরের ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে শাহ আমানত হল ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক মামুন হোসেন নিহত হয়েছেন। ২০১৪ সারে ১৪ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ছাত্রলীগ কর্মী তাপস। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২নং গেইট সংলগ্ন নিজ বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের ঝুলন্ত লাশ। পরে ২৪ নভেম্বর দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরি বাদী হয়ে আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তাতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক ১০ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়।

রাবিতে ৫ হত্যাকান্ড: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পর বেশি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রলীগ-শিবির এবং ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছয় বছরে খুন হয়েছেন পাঁচ শিক্ষার্থী। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানী।

২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল দখলকে কেন্দ্র করে শিবির-ছাত্রলীগের সংঘর্ষে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ কর্মী ও গণিত বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী ফারুক হোসেন।

একই বছর ১৫ আগস্ট শোক দিবসের টোকেন ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে শাহ মখদুম হলের দোতলার ছাদ থেকে ছাত্রলীগ কর্মী নাসিরুল্লাহ নাসিমকে ফেলে হত্যা করে ছাত্রলীগ সভাপতি গ্রুপের কর্মীরা।

পদ্মা সেতুর চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালের ১৫ জুলাই রাতে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আহাম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইন গ্রুপের নেতাকর্মীদের মাঝে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান ওরফে সোহেল।

দলীয় কোন্দলকে কেন্দ্র করে ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী আকন্দ নিজ কক্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

বাকৃবিতে ২ খুন: ২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় ১০ বছরের শিশু রাব্বি।

পূর্বশত্রুতার জের ধরে ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ বাকৃবি আশরাফুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী সায়াদ ইবনে মমাজকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই হত্যা করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলায় কারও নাম উল্লেখ করেনি।

জবিতে বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ড: ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচির দিনে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাসকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় আটজনের মৃত্যুদন্ড ও ১৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত দুজন ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১১ জনই ‘পলাতক’ রয়েছেন।

জাবিতে জুবায়ের হত্যাকান্ড: ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তর্কলহের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় গুরুতরভাবে আহত হন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পর দিন তিনি মারা যান। তার হত্যার পর ক্যাম্পাসে এ নিয়ে যে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। তাতে সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০১৫ সালে পাঁচ জন আসামির মৃত্যুদন্ড এবং ছয় আসামির যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ দেন আদালত। আসামিদের মধ্যে একটি বড় অংশ মামলার শুরু থেকেই পলাতক রয়েছে।

ঢাবিতে আবু বকর হত্যাকান্ড: ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নির্মমভাবে খুন হন মেধাবী ছাত্র আবু বকর। ঘটনার পর একই হলের আবাসিক ছাত্র ওমর ফারুক বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত শেষে এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুকসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় শাহবাগ থানার পুলিশ।

পরে বাদীর নারাজি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে সিআইডি মামলাটির অধিকতর তদন্ত করে এবং ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর অভিযোগপত্র দেয়। তাতে আগের আটজনসহ আরও দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়। আসামিদের সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। কিন্তু এই হত্যা মামলার রায়ে ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতাকর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পান। রায় হওয়ার আট মাস পর গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ পায়। রায়ের বিষয়ে আবু বকরের বাবা-মা, এমনকি বাদীকে রায় সম্পর্কে জানানো হয়নি।

হাবিপ্রবিতে ৩ খুন: ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাংশের সঙ্গে ছাত্রলীগের অন্য অংশের সংঘর্ষে বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জাকারিয়া ও কৃষি বিভাগের ছাত্র মাহমুদুল হাসান মিল্টন নিহত হন। ঘটনার চার বছর পরও খুনিদের বিচারের আওতায় আনতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ১৫ বার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের পরও কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি কোতোয়ালি থানা পুলিশ। অবশেষে এ বছরের মার্চে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডিতে) স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে এখনো কোনো আসামি গ্রেপ্তার করতে পারেনি সিআইডি। এর আগে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে ২০১২ সালের ৯ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি ফাহিম মাহফুজ বিপুল নিহত হন।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ হত্যাকান্ড: ২০১২ সালের ১২ মার্চ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল আজিজ খান সজীব খুন হন। ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নাইমুল ইসলাম রিয়াদ খুন হন। একই বছর ২০ নভেম্বর শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারান ছাত্রলীগ কর্মী ও সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সুমন দাস।

বিশিষ্ট অপরাধ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, যেই সরকার ক্ষমতায় আসে তার দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা মূলত এসব ঘটনায় জড়িত থাকে। লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি এটার মূল কারণ। আবার দেখা যায়, এসব হত্যাকান্ডের অধিকাংশের বিচার হয় না। ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন হয়, পরে সেই কমিটি আর আলোর মুখ দেখে না।

তিনি বলেন, আমাদের আশার আলো হচ্ছে যে, বুয়েটের ঘটনার পর ছাত্রলীগেরও অনেক নেতাও এ ঘটনার বিচার চেয়েছেন। হত্যাকান্ডের বিচারের দাবিতে তারাও সোচ্চার হচ্ছেন। আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনটাই দেখছি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তাতে আমরা এসব ঘটনার সঠিক বিচার পাব বলে আশা করছি।


সর্বশেষ সংবাদ