বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অভিন্ন নীতিমালা, চূড়ান্ত হচ্ছে আজ

দীর্ঘ দেড় যুগ পর আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অভিন্ন নীতিমালা। এর ফলে শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব কমবে। পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ন্ত্রণে আসবে শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্য। অভিন্ন এ নীতিমালার লক্ষ্যেই আজ রবিবার শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে বৈঠকে বসছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। সেখানে অভিন্ন শিক্ষক নীতিমালা চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। 

সূত্র বলছে, খসড়া অভিন্ন নীতিমালায় প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য কমিটির পক্ষ থেকে নতুন একটি ধারা সংযোজনের প্রস্তাব তোলা হবে। সেখানে প্রভাষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে ভাইভার আগে ১০০ নম্বরের একটি লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি প্রেজেন্টেশন নেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও মস্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ ধারাটি নীতিমালায় যোগ করার প্রস্তাব দেয়া হবে। 

এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. আব্দুল্লাহ আল হাসান চৌধুরী বলেন, এটা গত বছরই অনুমোদন হওয়ার কথা ছিল। জাতীয় নির্বাচনসহ নানা ইসু্যতে পিছিয়েছে। আজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অভিন্ন নীতিমালা চূড়ান্ত করার বৈঠক রয়েছে। সেখানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সভাপতিত্ব করবেন। আশা করেন এই বৈঠকেই এটি চূড়ান্ত হবে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও ভিসিদের আপত্তির মুখেই দীর্ঘদিন আটকে আছে নীতিমালাটি। এটি বাস্তবায়িত হলে শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দৌরাত্ম্য কমবে। একই সঙ্গে পদোন্নতিতে জটিলতা কমার পাশাপাশি লেজুড়ভিত্তিক শিক্ষক রাজনীতিরও লাগাম টানা যাবে।

ইউজিসির কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের সমন্বিত কোনো নীতিমালা নেই। ফলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানও সমান নয় এবং ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বৈষম্য রয়েছে। এ বৈষম্য দূর করতে ২০০২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে একটি অভিন্ন নীতিমালা করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়। তার আগে ১৯৯৩ সালে প্রথম এই উদ্যোগ নেয়া হলেও নানা জটিলতা তা আটকে থাকে। ২০০৪ সালে প্রথম অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালার একটি খসড়া চূড়ান্ত হয়। সেটিও আলোর মুখ দেখেনি। ওয়ান ইলেভেনের পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার একবার সেই নীতিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। এর মাঝখানে কখনো নতুন শিক্ষামন্ত্রী অথবা ইউজিসি উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনার এবং বিভিন্ন মহলের মতামত নিয়ে কমিটি করে দেন। কমিটি নতুন নতুন প্রস্তাব দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

সর্বশেষ ২০১৫ সালে ৮ম পে-স্কেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গড়ায়। প্রধানমন্ত্রী জানতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও বেতন স্কেল নিয়ে নানা ধরনের বৈষম্য বিদ্যামান। সে বৈষম্য দূর করে একটি আমব্রেলা বা অভিন্ন নীতিমালা করা দরকার। শিক্ষক সংগঠনগুলো তখন সেটি মেনে আন্দোলন প্রত্যাহার করে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এটি দ্রম্নত বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগ নেয়। প্রস্তাবিত খসড়ার ওপর কয়েক দফায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক, শিক্ষক সমিতি নেতৃবৃন্দ এবং সর্বশেষ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের মতামত নেন। সেই মতামতের ওপর ভিত্তি করেই চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে অভিন্ন নীতিমালা। 

অভিন্ন নীতিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়। আবার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ১০ থেকে ১১ বছরেই অধ্যাপক হয়ে যান। কোথাও প্রভাষক পদে যোগ দিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে প্রথম শ্রেণি বাধ্যতামূলক। আবার কোথাও যে কোনো একটিতে প্রথম শ্রেণি থাকলেই চলে। এই অভিন্ন নীতিমালা হলে তা বন্ধ হবে। 

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর এ বিষয়ে একটি মানসম্মত অভিন্ন নীতিমালা করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসিকে দায়িত্ব দেয়। ইউজিসির তৎকালীন সদস্য অধ্যাপক ড. ইউসুফ আলী মোল্লাকে প্রধান করে গঠিত কমিটি কয়েকটি সভা করে একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেন। খসড়ায় বলা হয়েছে, যেসব শিক্ষকের পিএইচডি বা সমমানের উচ্চতর ডিগ্রি থাকবে, তারা প্রভাষক থেকে সহযোগী অধ্যাপক এবং স্বীকৃত জার্নালে ১৪টি প্রকাশনা থাকলে চাকরির ১৬ বছরে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবেন। এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রি না থাকলে ১৮ বছরে একজন শিক্ষক অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবেন। পদ থাকলে সরাসরি ১৬ বছরে নিয়োগ পাবেন অধ্যাপক হিসেবে। আর পদশূন্য না থাকলে পদোন্নয়নের মাধ্যমে ১৮ বছরে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবেন।

নতুন খসড়া নীতিমালায় বলা হয়, প্রভাষক পদ থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে একজন শিক্ষককে কমপক্ষে তিন বছরের ক্লাসরুম শিক্ষকতা এবং স্বীকৃত জার্নালে কমপক্ষে দুটি গবেষণা প্রবন্ধ থাকতে হবে। একইভাবে, সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে একজন শিক্ষককে কমপক্ষে সাত বছরের ক্লাসরুম শিক্ষকতা এবং স্বীকৃত জার্নালে কমপক্ষে তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে সাত বছরে, আর না থাকলে চাকরির নয় বছরে একজন শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির যোগ্য হবেন। এরপর পরবর্তী পদোন্নতি অর্থাৎ অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে একজন শিক্ষককে কমপক্ষে আরও আট বছর চাকরি করতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ