আল-আজহার: মসজিদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় (ভিডিও)

বিহার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারলে মসজিদ থেকে কেন নয়। নালন্দা বিহার যেমন বৌদ্ধদের উপাসানালয় থেকে শিক্ষালয়ে রূপান্তর হয়েছিল তেমনি মুসলমানদের মসজিদ সমূহ ছিল একসময় প্রশাসনিক ও শিক্ষাকেন্দ্র। এক্ষেত্রে আল আজাহার মুসলিম ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। এখান থেকেই সর্বপ্রথম মুসলমানদের একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। এটা ছিল মুসলিম শাসনের স্বর্ণযুগ ফাতেমী বংশের আমলে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। কারণ তখনো ইউরোপে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেনি। ফাতেমী বংশের খলীফা ময়েয-লি-দিনিল্লাহ্ একটি মসজিদ নির্মাণের ইচ্ছাপ্রকাশ করেন।

যার ফলশ্রুতিতে ৯৭২ সালে একটি মসজিদের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। ৯৮৯ সালে এখানে ৩৫ জন আলেমকে নিয়োগ দিয়ে এই মসজিদের নামকরণ করা হয় রাসূল (সা.) এর কন্যা হযরত ফাতেমা আল-জাহরা (রা.) এর নামে আল আজহার। এছাড়াও ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন মসজিদটিকে কেন্দ্র করে তৎকালীন শহরটি প্রতিষ্ঠা হওয়ায় মসজিদটিকে আল আজহার বলে অভিহিত করা হয়েছে। হাজার বছর ধরে মুসলমানদের চিন্তার জগতে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলেও প্রতিষ্ঠানটি শুরুর দিকে বাগদাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় সেরকম গুরুত্ব পায়নি। আল আজাহার বর্তমানে সুন্নি মতাদর্শের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। এখান থেকেই মুসলিম বিশ্বের যেকোন বৃহত্তর সমস্যার ফতোয়া প্রদান করা হয়ে থাকে। আরবি সাহিত্য, ইসলামিক স্টাডিজ, কুরআনিক সাইসেন্স, হাদিস, ইসলামী আইন শিক্ষা, যুক্তি বিদ্যা, ব্যাকরণ, অলংকার শাস্ত্র সহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক ডিসিপ্লিন দ্বারা সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়টি মিশরের প্রথম ডিগ্রি গ্র্যান্টিং ইউনিভার্সিটি। মূলত ইসলাম ধর্মের আদর্শ প্রচার এবং ইসলামী সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানোর উদ্দেশ্যে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

আল-আজাহারের বিবর্ণ সময়: ফাতেমীয় শাসনামলে (৯৭২-১১৭১) বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আল আজহারের তেমন নামডাক করতে পারেনি। শুধু শিয়া মতবাদ ভিত্তিক শিক্ষা প্রদানের কারণে তখন অন্যান্য মুসলমানরা এখানে শিক্ষা অর্জনে অনাগ্রহী ছিল। এছাড়াও তৎকালীন রাজধানী বাগদাদের প্রবল প্রভাব আল আজহারকে ম্লান করে রাখে। তাছাড়া ফাতেমীয় শাসকদের অধিকাংশ মুসলমানরা শাসক হিসেবে গ্রহণ করেননি। ফলে ফাতেমীয়দের শাসনে আল আজহার ইসলামী বিশ্বের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী অবস্থানে যেতে সক্ষম হয়নি। আইয়ুবী শাসকরা যখন বাগদাদের আব্বাসীয় খলীফাদের অধীনে মিসরের ক্ষমতা অধিকার করেন, তখন তারা আল আজহারের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্মুক্ত করে দেন। তবে তখনো আল আজহার প্রভাব বিস্তারকারী অবস্থানে যেতে পারেনি। মিসর, ‍সিরিয়া, ইরাক ও আন্দালুসিয়ার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো এটিকেও একটি সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হতো।

আল আজাহারের জাগরণ: মামলুক সুলতান বাইবার্সের আমলে তার প্রধানমন্ত্রী ইজ্জুদ্দীন আয়দেমীরের হাতে আল আজহার পুর্নজন্ম লাভ করে। তার পরিকল্পনা অনুসারে সুলতান আল আজহারের সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করেন। তার হাত ধরেই আল আজহার তার স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। ১২৫৮ সালে মঙ্গলদের হাতে বাগদাদের পতনের পর অসংখ্য মুসলিম পণ্ডিত ও বিদ্বান ব্যক্তি মিসরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১২৬০ সালে আইন জালুতের যুদ্ধে মঙ্গলদের পরাস্থ করার পর বাইবার্স ছিন্নভিন্ন আব্বাসীয়দের কায়রোতে আমন্ত্রণ করেন এবং আব্বাসীয় খেলাফতকে পুনর্জীবিত করেন। এর ফলে মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্র বাগদাদের পরিবর্তে কায়রোতে স্থানান্তরিত হয়। ফলশ্রুতিতে মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্রভূমি হিসেবে কায়রোর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। বাগদাদ থেকে কায়রোতে মুসলিম পণ্ডিতদের অভিবাসনের পাশাপাশি এসময় আন্দালুসিয়া থেকেও একইরূপ অভিবাসনের ঢল আসে।

১২৩৬ থেকে ১২৬১ সালের মধ্যে আন্দালুসিয়ার কর্ডোভা, সেভিল, ভ্যালেন্সিয়া সহ বিভিন্ন বড় বড় শহরের খ্রিস্টান ক্যাসেলিয় বাহিনীর হাতে পতন হওয়ায় সেখানকার সাধারণ মানুষের পাশাপাশি পণ্ডিতরাও বাস্তুহারা হয়ে পড়েন। তৎকালীন মামলুক সালতানাত মুসলিম বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ায় সকলেই মিসরে আশ্রয় গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ হন। বাগদাদ ও আন্দালুসিয়ার এই পণ্ডিতদের সহায়তায় আল আজহার তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। মামলুক শাসনামলে বিশ্বের সমসাময়িক প্রখ্যাত মুসলিম পণ্ডিতগণ প্রায় সকলেই আল আজহারে শিক্ষকতা করতেন অথবা কোনো এক সময়ে আল আজহারে স্বল্প সময়ের জন্য এসেছিলেন।

মামলুক শাসকদের প্রখর তত্ত্বাবধানে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। মামলুক শাসনামলে আল আজহারে শিক্ষকতা করা বিখ্যাত পন্ডিতদের মধ্যে রয়েছেন, আবুল আব্বাস আল-কালকাসান্দি, তাকি উদ্দীন আহমদ আল-মাকরিজি, ইবনে হিজর আল-আসকালানি, বদর উদ্দীন আল-আইনি, সিরাজ উদ্দীন আল-বালকিনি, জালাল উদ্দীন আল-সূয়তি, আবদুর রহমান ইবনে খালদুন প্রমুখ। ১৫১৭ সালে মামলুকদের পতনের পর ওসমানীয় শাসনামলেও আল আজহার তার প্রভাব বজায় রাখে। মিসরের পাশাপাশি সমগ্র মুসলিম বিশ্বে এটি একটি শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।

বর্তমানের আল আজাহার: আধুনিক যুগে মিসরের আলোচিত প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের ১৯৬১ সালে আল আজহারকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেছেন এবং এসময় অনেক সেক্যুলার বিষয়ও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেমন— ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, ফার্মেসি, মেডিসিন, প্রকৌশল, কৃষি ইত্যাদি। মিসরের বাইরে গাজা এবং কাতারের দোহায় আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা রয়েছে। বতর্মানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৯টি ফ্যাকাল্টি রয়েছে, যা এক কথায় অনন্য। ৫৪ হাজার শিক্ষার্থী এবং পাঁচ হাজারের বেশি শিক্ষক ও স্টাফ। মহিলাদের জন্য রয়েছে বিশেষ আটটি অনুষদ। এটি এখন সুন্নি মুসলমান ও আরব বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র হলেও ভ্যাটিক্যানের মতো নয়। আল আজহারের সূচনা থেকে যেসকল বিষয়ে পাঠদানের জন্য পরিচিত, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, উলুমুল কুরআন, উলুমুল হাদীস, ইলমুল কালাম (ধর্মতত্ত্ব), ফিকাহ (আইন), উসুল, নাহু-সরফ (ব্যকরণ), বালাগাহ (অলঙ্কার শাস্ত্র), আদাব (সাহিত্য), তারিখ (ইতিহাস), তিব (চিকিৎসা শাস্ত্র), ফালসাফা (দর্শন) এবং মানতিক (যুক্তিবিজ্ঞান)।

আল আজহার বর্তমানে যেসকল অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত তা হলো—আল আজহার সুপ্রিম কাউন্সিল, সংস্কৃতি ও ইসলামী গবেষণা বিভাগ, আজহার ইন্সটিটিউটসমূহ, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, আজহার গ্রন্থাগার, ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র , ফতোয়া কমিটি।

বিতর্কিত ঘটনা: আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রোর আল আজহার মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি সারাবিশ্বে ইসলামী শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবুও এখানে কিছু বিতর্কিত ঘটনার ইতিহাস রয়েছে। 

তিউনিসিয়ায় বিপ্লবের সফল পরিণতি উজ্জীবিত করে হোসনি মোবারকের স্বৈরশাসনে নিষ্পেষিত মিসরের সাধারণ মানুষকে। ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি সে দেশেও বিপ্লবের গণজাগরণ সৃষ্টি করে। ১৮ দিনের টানা বিক্ষোভে সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন মোবারক।

পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ইসলামপন্থী ব্রাদারহুড ক্ষমতায় এলেও তা বেশি দিন টেকসই হয়নি। ২০১৩ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি ক্ষমতা কেড়ে নেন মুরসির কাছ থেকে। মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে কারাগারে পাঠালে লক্ষ লক্ষ মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী অবস্থান নেয় এর মসজিদ চত্ত্বরে। ওই সময় রমজান মাসে সিসি বিরোধী বিক্ষোভ ও অবস্থান প্রায় ৪৫দিন ধরে চলতে থাকে। অবশেষে কমান্ডো অভিযান ও বিপুল জানমালের ক্ষয় ক্ষতির মাধ্যমে এ বিক্ষোভ অপসারণ করা হয়। এরপর থেকে মসজিদটিতে তালা ঝুলছে এবং তথায় নামাযও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসের ডানেই মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এর নিহত হয়েছিলেন। এখানে রয়েছে তার পিরামিড আকৃতির বিশাল সমাধিক্ষেত্র। রাজনৈতিক বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি ঘটনা দিয়ে আল আজাহারের বিশাল অবদানকে কখনো অস্বীকার করা যাবে না। ইতিহাসে বাগদাদ, কর্ডোভা, মালাগা, মাদায়েনে যখন পতনের অতল গহীনে ডুবে যায় কায়রোতে তখনো মসুলমানদের জ্ঞান চর্চার পাদপ্রদীপ হয়ে আল আজাহার তার পথে বলীয়ান ছিল।


সর্বশেষ সংবাদ