অধ্যাপক ছাড়াই চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়!

  © লোগো

অধ্যাপক ছাড়াই চলছে দেশের দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সংখ্যা দশের নিচে। এর মধ্যে আবার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সংখ্যা মাত্র এক জন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েগুলোতে অধ্যাপক সংকটের এই চিত্র ফুটে উঠেছে। 

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক সংখ্যা ১৪১ জন। এর মধ্যে প্রভাষক ৩০ জন, সহকারী অধ্যাপক ১০০ জন এবং সহযোগী অধ্যাপক ১১ জন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নেই কোন স্থায়ী অধ্যাপক। অন্যদিকে, ২০১৫ সালে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট শিক্ষক সংখ্যা মাত্র ৮ জন। এর মধ্যে ৭ জন প্রভাষক এবং একজন সহকারী অধ্যাপক। কিন্তু নেই কোনো সহযোগী ও স্থায়ী অধ্যাপক।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চশিক্ষার মূল অনুষঙ্গ গবেষণা ও প্রকাশনা ব্যবস্থাপনা। যে কাজগুলো সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাই করে থাকেন। অথচ দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অধ্যাপক শূন্যতা কিংবা অপর্যাপ্ততা উচ্চশিক্ষার মানকে যেমন ক্ষুন্ন করছে, তেমনি করছে প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষাবিদরা বলছেন, নানা সুযোগ-সুবিধার কারণে জেষ্ঠ্য শিক্ষকরা ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেতে চান না। এক্ষেত্রে তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেতে আগ্রহ দেখান। কারণ, ঢাকার বাইরে সরকারি বিশ্ববিদালয়গুলোয় আবাসন, গবেষণা, যাতায়াতসহ নানা সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা রয়েছে। এসব কারণেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেতে চান না অধ্যাপকরা। অন্যদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষকের এমন সংকট দেশের উচ্চ শিক্ষার জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। 

প্রতিষ্ঠার পর পেরিয়ে গেছে ৮ বছর; অথচ একজন অধ্যাপক পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়টি

ইউজিসির ৪৪তম বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের আরো ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সংখ্যা দশেরও নিচে। এর মধ্যে রবিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক সংখ্যা ১৭৩ হলেও অধ্যাপক সংখ্যা মাত্র একজন। সহযোগী অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র একজন শিক্ষক। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও অনেকটা এমনই।  এখানে অধ্যাপক সংখ্যা মাত্র তিনজন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টির মোট শিক্ষক সংখ্যা ১৮০ জন। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক রয়েছেন ৪ জন। আর ১৪০ জন শিক্ষকের মধ্যে পাঁচজন অধ্যাপক রয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংখ্যা ১৯০ জন হলেও অধ্যাপক মাত্র ৭ জন। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আছেন ৮ জন। বিশ্ববিদ্যালয়টির মোট শিক্ষক সংখ্যা ২২৩ জন। 

এর বাইরে ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬৭ জন শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপক আছেন মাত্র ১২ জন। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫২ শিক্ষকের মধ্যে ১০ অধ্যাপক আছেন। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপক সংখ্যা মাত্র ১২।

‘অধ্যাপক তো দূরের কথা, ক্যাম্পাসই নেই রাঙ্গামাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের। একটি স্কুলে চলছে এর শিক্ষাকার্যক্রম। দাফতরিক কাজ চলছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের একটি ভবনে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষে প্রয়োজনীয় উচ্চডিগ্রী সম্পন্ন জনবল তৈরি করাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, শিক্ষকদেরকে বর্তমানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। ফলে উচ্চতর গবেষণা পরিচালনা করার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন তা তারা পাচ্ছেন না। এছাড়া শিক্ষকরা শিক্ষকতা পেশায় ক্রমাগত আগ্রহ হারাচ্ছে উল্লেখ করে তাদের বেতন ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করার সুপারিশ করা হয় ইউজিসি’র এই প্রতিবেদনে।

এর আগে ১৮ অক্টোবর শিক্ষক সংকটের নানা দিক উল্লেখ করে তা সমাধানে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের কাছে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে ইউজিসি। সুপারিশে বলা হয়েছে, নতুন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর পদগুলোতে স্থায়ীভাবে শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিতকরণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। অভিজ্ঞ শিক্ষকরা যেন অপেক্ষাকৃত নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানে আগ্রহী হন, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এখন থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা না গেলে ২০৪১ সালের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, অধ্যাপকরা বিভাগীয় শহর বাদ দিয়ে নতুন ও তুলনামূলক কম প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় যেতে চান না।  জীবন যাত্রার মান এবং সুযোগ সুবিধার অপ্রতুলতা এর মূল কারণ।

তিনি বলেন, অধ্যাপক ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই সংকট যেমন শিক্ষার্থীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তেমনি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকের মাঝেও। সংকট উত্তরণের চেষ্টা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অথবা সহযোগী অধ্যাপককে আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা প্রদান সাপেক্ষে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষাকৃত কম প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেপুটেশনে (প্রেষণ) পাঠানো যেতে পারে।


সর্বশেষ সংবাদ