নাকফুলের খোঁজে ভর্তি হয়েছিলাম বুয়েটে

হুমায়ূন আহমেদের সাথে ২০০৯ সালে, সুন্দরবনে শাকুর মজিদ
হুমায়ূন আহমেদের সাথে ২০০৯ সালে, সুন্দরবনে শাকুর মজিদ

আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম এক বন্ধুকে পরীক্ষার হলে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখি বুয়েটের লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ে আমাদের সিট পড়েছে, যথারীতি রোল নাম্বার অনুসারে পর পরই, কিন্তু সেটা পাশাপাশি নয়, সামনে পিছে। একটা ডেস্কে দুইজনের জায়গা, পাশাপাশি দুই চেয়ারে। আমার সামনে আমার বন্ধু আর পাশে গোলগাল চেহারার এক শ্যামলা বর্ণের সুকেশিনী। সুকেশিনী বলছি এ কারণে যে, মেয়েটি আসন্ন পরীক্ষার টেনশনকে অতিক্রম করতে না পেরেই কি না মুখটা সারাক্ষণই প্রায় নিচু করে রেখেছিল। তার প্রোফাইলের যা কিছু আমার দেখা—তাতে নাক বরাবর মাথা থেকে ঝুলে থাকা চুলের আশের ফাঁক দিয়ে, তার দৃষ্টিকে আড়াল করে, প্রায় লুকিয়ে যতক্ষণ দেখা যায়, সে এক বা দুই সেকেন্ড কাল বা তারচেয়েও কম সময়। মেয়েটির দীর্ঘ চুল, তার বেশি অংশ পিঠের ওপর ছড়ানো, কিছু অংশ তার ঝুঁকে থাকা মাথার কারণে কানের ওপর দিয়ে লেপ্টে নাকের অর্ধেকটা ঢেকে রেখেছে। পাখার কারণে খানিক বাতাস পেয়ে কিছু চুল সরে গেলে দেখা যায় তার নাকে একটা চমৎকার নাকফুলও আছে। তার চুল থেকে যে গন্ধ আসছে তা কোনো বিশেষ শ্যাম্পুর, বুঝতে পারি না। তবে আমলকি জাতীয় একটা ফলের গন্ধ সেখানে পাই। পরীক্ষায় আসার আগেই সে গোসল করেছে। পুরো চুল শুকায়নি বলেই হয়তো এভাবে মেলে ধরার চেষ্টা।

৩০ নভেম্বর, ১৯৮৪। যথা সময়ে পরীক্ষা শুরু হলে আমি বেশ দ্রুতই লিখিত অংশগুলো শেষ করে ফেলি। শেষে আঁকি ফ্রিহ্যান্ড ড্রইং। আমার ইচ্ছা হয় তাড়াতাড়ি খাতা জমা দিয়ে বলাকায় একটা সিনেমা মারি। সময় শেষ হবার আগে খাতা জমা দিয়ে দেবার পুরানো ফুটানি আমি এখানেও দেখাতে চাই, কিন্তু মন বলে, মেয়েটাকে আরো এক-দুবার দেখি। আমি বসে থাকার কাজ খুঁজি।

তাকালাম তার খাতার দিকে। সে ছবিটা আঁকছে। একজন মালি বাগানে পানি ঢালছে—এটা আমাদের সবার আঁকার বিষয়, এর জন্য নম্বর ২০। আমি যে এবার তার চুলের দিকে না তাকিয়ে আঁকা ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখছি সে টের পেয়েছে বলেই কি না জানি না, দেখি সে হাতটা যথেষ্ট সরিয়ে পেন্সিলের রিটাচিং থামিয়ে বেশ জায়গা করে আমাকে ছবিটা দেখতে দেয়।

আমি দেখি—সে চমৎকার একটা মালির ছবি এঁকেছে। রবীন্দ্রনাথের নাটকে জমিদারদের বাগানবাড়ির মালিরা যেমন থাকে, খালি গা, খালি পা, ধূতি পরা, টিনের কৌটা থেকে পানি ঢালার দৃশ্য। আমার সাথে খানিক চোখোচোখি হতেই আমি চোখের ভাষায় যেন তাকে বললাম—সুন্দর হয়েছে। জবাবে সে হাসল। আমি বুঝলাম, সে বলছে—ধন্যবাদ।

এবার মাথাটা ঘুরিয়ে চোখটা নাড়িয়ে সে আমার খাতার দিকে তাকায়। আমি বুঝলাম, সে বলছে— তোমারটা দেখি ? আমার শেষ হওয়া খাতার যে পাতাটিতে ছবি আঁকা আছে তা বাম পাশে উল্টে রেখে, যেন আমি আমারই অন্য পাতার লেখা চেক করছি এমন একটা ভাবের অভিনয় করতে থাকি, এই ভেবে যেন—সে এটা ভালো করে দেখে। মিনিট খানেক পরে যখন তার দিকে তাকাই, দেখি আমার খাতায় তার চোখ নেই, নিজের খাতায় আঁকাআঁকিতে সে ব্যস্ত।

আমার হাতে এখন কুড়ি মিনিটের মতো সময়। আমার ইচ্ছা, আরো কিছুক্ষণ বসি। আমার মনে হলো, আমার মালিটার চেয়ে ওই মেয়েটার মালি বেশি সুন্দর। আমি এঁকেছি আমাদের ক্যাডেট কলেজের হাউজ গার্ডেনের মালির ছবি। পায়ে কালো বুট, কালো মোজা, খাকির হাফ প্যান্ট, হাতে ভাঁজ করা খাকি শার্ট। আমি রাবার হাতে নেই। আমার মিলিটারি মালিকে বদলে ফেলি। রবীন্দ্রনাথের মালি বানিয়ে ফেলি, বাকি সব কিছু ঠিক থাকে।

সময় প্রায় শেষ। পাঁচ মিনিট আর আছে। দু-একজন খাতা জমা দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি কলম, পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স গুটাই। আমার খাতা ভাঁজ করে হাতে নিয়ে দাঁড়াবার আগে আরেকবার মেয়েটার দিকে তাকাই। সে বুঝে ফেলে, আমি তাকিয়েছি। তারও সব কাজ শেষ। পেন্সিল বক্স গোছানোর আগে তার খাতার সেই পাতাটি তার ডেস্কে এমনি মেলে রাখে যেন আমি দেখতে পাই।

আমি দেখি, সেই পাতায় বাগানে পানি দেয়া যে মালির ছবি সেটা এখন আর রবীন্দ্রনাথের নয়, খোদ কোনো ক্যান্টনমেন্টের সামরিক বড় কর্তার বাগানের মালি, পিটি সু, ফুল প্যান্ট, খাকি শার্ট, প্লাস্টিক পাইপের নল। আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে উঠে পড়ি এবং খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে যাই। টের পাই, মেয়েটি আমার পিছু পিছু আসছে।

লাইব্রেরির বাইরে আমি এসে দাঁড়াই। দেখি মেয়েটি বেরিয়ে আসতেই তার বাবার (বাবাই হবে) পাঞ্জাবীর হাত ধরে ডানে বামে কোথাও না তাকিয়ে লোকটার সাথে হাঁটতে হাঁটতে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।

পরীক্ষা শেষে আমার বন্ধু চলে এসেছে আমার পাশে। বলে—চল।
আমি আরো দাঁড়াই।
সে বলে—কার জন্য অপেক্ষা করিস ?
আমি বলি—কিছু না।
সে বলে, পরীক্ষা খুব ভালো হয় নি, ম্যাথ্স্ অনেকগুলো ছেড়ে দিসি। মেজাজ ভালো না, এখন কী করবি?
আমি বলি, চল—বলাকা ধরি, সিনেমা দেখব।
পনের দিন পর আর্কিটেকচারে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আমি গ্রামের বাড়ি চলে যাই। এর মধ্যে মেডিকেলের রেজাল্ট হয়েছে। আমি সলিমুল্লায় চান্স পেয়েছি। কিন্তু পজিশন ৭। ঢাকা মেডিকেলে হয়ে যাবে। আমি ডাক্তার হবার প্রস্তুতি নিতে থাকি। এক বিকেলে গ্রামের বাজারে ডাকপিয়ন আমাকে একটা চিঠি দেয়। লিখেছে আমারই ক্যাডেট কলেজের আরেক বন্ধু—নাভিদ সামাদ। তিন লাইনের চিঠি—‘শাকুর, তুই আর্কিতে চান্স পেয়েছিস। কংগ্রেটস। ৮ তারিখ ভর্তির লাস্ট ডেট। তাড়াতাড়ি আয়। নাভিদ।’

আমি বুয়েটে এসে নোটিশ বোর্ডে আমার নামও দেখি। আমি বাকি সবার নাম পড়ি। ১৪টা মেয়েও আমাদের সাথে আছে।
সে কি আছে? আমি তো তার নাম জিজ্ঞাসা করিনি। নাম জানি না। আছে তো বটেই!
আমি আমাদের সাথে ভর্তি হতে আসা কাউকেই দেখি না, কাউকে তো চিনিও না। সবাইকে কবে দেখব?
আমি জিজ্ঞেস করি অফিসের একজনকে। তিনি বলেন, আরও ১৩-১৪ মাস পর, ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি নাগাদ ক্লাস শুরু হবে। বাড়ি চলে যান, পেপারে নিউজ পাবেন, চিঠিও যাবে বাড়ির ঠিকানায়।

আমি আমার সতীর্থদের সাথে মিলিত হবার জন্য আরো ১৪ মাস অপেক্ষা করতে থাকি।
১৪ মাস পর ৪৯ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ১৯৮৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আমাদের ক্লাস শুরু হয় বুয়েটে। ১৪ জন মেয়ে, বাকিরা সবাই ছেলে। আমি প্রথম দিনেই সবগুলো মেয়ের দিকে তাকাই। লম্বা চুলের শ্যামলা মেয়ে আছে, কিন্তু গোলগাল চেহারার ছোটমোট কোনো মেয়ে নাই, যার নাকে একটা নাকফুলও ছিল।

(আমার 'বুয়েটকাল' এর প্রথম চ্যাপ্টার থেকে সংকলিত ও সংক্ষেপিত)
লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেওয়া


সর্বশেষ সংবাদ