২৯ জুন ২০২০, ২৩:০৬

প্রচন্ড পিপাসা সত্ত্বেও পানি খেতে পারছিনা, কারণ মাস্ক খোলা যাবে না

প্রতীকী

আব্বা কোভিড পজিটিভ হয়েছে আজকে পনের দিন হলো। ময়মনসিংহ মেডিকেলের আইসিইউ কাম অবজারভেশন ইউনিটে আছি আজকে দিয়ে পাঁচদিনের মতো। দিন তারিখের হিসাব তেমন নাই। তবে যতদূর মনে পড়ে এখানে আসছি ১৪ জুন মাঝরাতে। আজকে খুব সম্ভবত ১৮ তারিখ।

আইসিইউ কাম অবজারভেশন বলার কারণ হচ্ছে মহামারীর ছয় মাস পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশের অন্যতম সেরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিট এবং কোভিড আইসিইউ এখনও পর্যন্ত প্রস্তুত হয় নাই। ৯ তলা একটা বহির্বিভাগ বিল্ডিং সম্পূর্ণ ফাকা পড়ে আছে।

ভর দুপুরে যার জনশূণ্য তৃতীয় তলা থেকে মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটে সেখানে পুরো বিল্ডিংয়ে সব মিমিয়ে কতজন লোকের যাতায়াত তা খুব সহজেই অনুমেয়। ইনফ্যাক্ট প্রথম তলা বাদ দিলে পুরো বিল্ডিংই গড়ের মাঠ। একটা কাক পক্ষীও নাই।

যারা কোভিড সাস্পেক্টেড হাইলি ক্রিটিকাল পেশেন্ট, অক্সিজেন সাপোর্ট ছাড়া বাঁচানো সম্ভব না তাদের এখানকার ১৪ বেডের অবজারভেশন ইউনিটে রাখা হয়। সমগ্র বৃহত্তর ময়মনসিংহ বিভাগ এবং তার আশেপাশের সব অঞ্চলের সকল মৃত্যুশয্যায় থাকা করোনা রোগীদের জন্য সব মিলায়ে একটা ইউনিট। তাও মাত্র ১৪বেডের! যার মধ্যে আবার দুইটা স্টাফদের জন্য রিজার্ভড!

বেশির ভাগ রোগীই প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে মাঝরাতের দিকে এখানে আসে আর সকালে নিথর হয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকে। ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যায়, রোগীর আত্মীয়স্বজন পাগলের মতো দৌড়ায়, কিন্তু লাশের রিলিজ হয় না। কখনো আবার লাশ হয়ে যায় বেওয়ারিশ। লাশ নেয়ার কোনো লোকই থাকেনা। ধবধবে সাদা চাদরে মোড়া বিছানাটা স্থির হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে আরেকটি মুমূর্ষু রোগীর। আরেকটি নিস্তেজ মৃত্যুর। আর যারা ভাগ্যক্রমে একটু সুস্থ হয়েও যায় তাদেরকে শিফট করা হয় পার্শবর্তী এস কে হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে।

মজার ব্যাপার হলো সেখানেও একটা আইসিইউ আছে এবং এই আইসিইউ আমার চব্বিশ বছরের জীবনের এমন এক অধ্যায় যা হয়তো আমার পক্ষে কখনোই ভুলা সম্ভব হবেনা।

১৫ তারিখ যখন আব্বার অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে গেল তখন সবার হাতে পায়ে ধরা শুরু করলাম একটা আইসিইউর জন্য। কিন্তু কোনো আইসিইউ নাই। বাংলাদেশের কোথাও না। টাঙ্গাইলে স্যাম্পল দেয়া হইছে ৮ দিন আগে। আট দিন পরেও এখন পর্যন্ত টেস্টের রেজাল্ট আসে নাই! চেস্ট এক্সরেতে দেখা গেল লাংস ঝাঝরা হয়ে গেছে। কিচ্ছু নাই। সিআরপি থাকার কথা শূণ্য থেকে ৬ এর মধ্যে। সিআরপি হয়ে গেছে ২৪! (সিআরপি দিয়ে ইনফেকশন আর ইনফ্লেমেশন মেজার করা হয় লাংস এর)।

শুধু যে সে কোভিড পজিটিভ তাই না, সে মোটামুটি লাস্ট স্টেজে আছে। তার মধ্যে আবার কো-মরবিড পেশেন্ট।ডায়বেটিস, এজমা, হাই প্রেশার তিনটাই আছে। খালি সাথে নাই কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট! এর জন্য কোনো কোভিড হসপিটাল তারে নিবেনা, নন কোভিড হসপিটালও তারে নিবেনা! সমগ্র দুনিয়ায় তারে নেয়ার মতো কাধ মোটে দুইজোড়া। আমি আর আমার বড় বোন সুলতান জহুরা আফরিনের।

ভাগ্যক্রমে তিনি নিজেও একজন ডাক্তার এবং কোনো একভাবে তিনি কোভিড ডেডিকেটেড এস কে হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়ার ব্যবস্থা করতে পারলেন। তখনকার ডিউটি ডাক্তার আর ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ও অনেক সহযোগীতা করছেন এ ব্যাপারে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

আইসিইউর গেটে যখন আসলাম তখন ঘোর সন্ধ্যা। এম্বুলেন্স থেকে নেমে প্রায় কোলে করেই আব্বাকে আইসিইউতে নিয়ে ডুকাইলাম। সেখানে ঢুকে প্রথমেই আমার ঢাকার মহাখালী বাস স্ট্যান্ডে এনা বাসের কাউন্টারের পাশে যে পাবলিক টয়লেট আছে সেটার কথা মনে পড়ল। ঐ পাবলিক টয়লেটের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থাও এই আইসিইউর থেকে ভালো। এটাই বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র আইসিইউ যেখানে না আছে কোনো ফ্যান, না আছে এসি, না আছে কোনো দরজা জানলা, না আছে কোনো সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই! আর ডাক্তার? থাক সে কথা!

উপরওয়ালার অশেষ কৃপায় সেখানে একটা বেড পেলেও অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সেখানে কোনো ডাক্তার আসেনা! রাত আড়াইটায় যখন সম্পূর্ণ অক্সিজেন ডিপেন্ডেড আমার আব্বার অক্সিজেন সিলিন্ডার ফুরিয়ে গেল তখন আমি শার্ট, গ্লাভস আর ফেস শিল্ড খুলে তার ফুল বডি মাসাজ আর হসপিটালের ফাইল দিয়ে বাতাস করা শুরু করলাম।কারণ ফ্যান ও নাই, এসি ও নাই, জানালাও নাই! এর সাথে এখন অক্সিজেন ও নাই।

ভয়ে, গরমে আর ক্লান্তিতে আমার স্যাচুরেশন হয়ে গেল ৮৬/৮৭। এদিকে আব্বার স্যাচুরেশন এক দুই করে কমতে কমতে ৭৮,৭৭,৭৬ হতে লাগলো। আশপাশে আর একটা মানুষও নাই যে দৌড়ে গিয়ে কাউকে জানাবে যে অক্সিজেন শেষ। আমি এক হাত দিয়ে বাতাস করি আরেক হাত দিয়ে তার বডি মাসাজ করি। এদিকে যত সময় যায় চারপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ জোরালো হয়। আশপাশের ঘর্মাক্ত গরম বাতাস ক্রমেই ভারী হয়ে আসে। আমি বুঝতে শুরু করি আমার প্রেশার ফল করছে। আর আব্বা হাত পা ছেড়ে দিচ্ছে বারবার।

হায় সেই ভীতি! হায় সেই অসহ্য যন্ত্রণা! মৃত্যুও বোধহয় এতো ভীতিকর না। সে সময় সেই অসুস্থ পরিবেশে দাড়িয়ে মৃত্যুটাকে মনে হচ্ছিল স্বাধীনতা। এই ভীতি ও ক্লান্তির একমাত্র শীতল অবসান। আর কিচ্ছু না। আমার সমগ্র জীবনে এরকম ভীতি আমাকে পায় নাই কখনো। কখনোই না।

আমার মনে হচ্ছিল আমি মারা যাচ্ছি। দুই পাশে করোনা আক্রান্ত লাশ। আব্বার অবস্থা জঘন্য। প্রস্রাব করাচ্ছি পলিথিনে। আমার পুরা শরীর ভাসায় দিছে প্রস্রাব করে। আইসিইউয়ে মোট ৭টা বেডের মধ্যে দুই বেডে দুইটা পজিটিভ লাশ। এর মধ্যে একটা লাশ আব্বার পাশের বেডে সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। কোভিড পজিটিভ শুনে আত্মীয় সজন লাশ ফেলে পালায় গেছে।

উল্টাপাশের বেডে স্কুল শিক্ষক এক বাবা অক্সিজেনের অভাবে দাপায়ে দাপায়ে মরতেছে। স্যাচুরেশন হয়ে গেছে ৫১/৫২। ছেলেটা তার পাগলের মতো এদিক সেদিক দৌড়াইতেছে। সে নিজেও জানে আর কিছু করার নাই। কিন্তু সে বিশ্বাস করতে চাচ্ছেনা। একটা মিরাকেলের অপেক্ষা করছে। কিন্তু লাভ হল না শেষ পর্যন্ত। টিকল না মানুষটা। ঐ মুহূর্তে ছেলেটার চোখের দিকে তাকানোর মতো এতো তীব্র শক্তি আমার ছিল না, আমার মনে হয় সমগ্র পৃথিবীর কারোই ছিল না। কি নির্মম নিয়তি! আহারে!

আমার হ্যালুসিনেশন শুরু হলো। মনে হচ্ছিল আইসিইউর একমাত্র ফাকা বেডটাতে ইয়া বিশাল কোনো একটা জন্তু বসে আছে। যার ছায়া পড়ছে মেঝেতে। বড় বড় লোমে তার গা ঢাকা। সে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় আছে।তার চোখ দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়তেছে। আমি লিটারেলি শার্ট খুলে ঘামে ভেজা কর্দমাক্ত ফ্লোরে বসে পড়লাম। আর মনে মনে বলতেছিলাম আল্লাহ আলো দাও, রাতটা শেষ কর। বার বার শুধু মনে হচ্ছিল আজকের রাতটা যদি পার হয়। যদি বেচে থাকি। ইশ!

আলহামদুলিল্লাহ এখনো বেচে আছি। পরেরদিন ১৬ তারিখ সন্ধ্যায়ই সেই মৃত্যুকূপ থেকে আবার এখানে শিফট করি। ইনফ্যাক্ট সবাই শিফট করে। কারণ ব্যবস্থাপনার দূর্বলতার কারণে সেই আইসিইউ বন্ধ করে সেটা ময়মনসিংহ মেডিকেলে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এরপর আরো তিনদিন চলে গেছে। গত পাঁচ রাত যাবত ঘুমাই না। দিনেও ঘুমাইনা আসলে। ১৬ তারিখ দুপুরে আপুর বাসায় গিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই শুধু ঐ ছায়াটা চোখে ভাসে। আর চারপাশে শুধু লাশ দেখি। এখানে যে পনের ষোলজন পেশেন্ট আছে তারাও সবাই ক্রিটিকালি পজিটিভ। ফুল টাইম অক্সিজেন সাপোর্টে আছে। কয়েকজনের সাথে একজন করে যে আত্মীয় আসছে তারাও পজিটিভ।

একটু আগেই এখানে বাচ্চা একটা মেয়ে মারা গেল। তার বাবা-মা সাথেই আছে কিন্তু কাছে গিয়ে ধরার সাহস পাচ্ছেনা। মা’টা একবারের জন্যেও কাঁদে নাই। সে পাথরের মতো বসে আছে। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরিও তার বুকের যন্ত্রনার সামনে শীতল হয়ে নিস্তেজ হয়ে যাবে নিমিষেই। মৃত্যু এখানে এতোটাই নির্লিপ্ত যে মেয়েটা মারা গেল তাতে কারো বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ও হলোনা।

পাশের বেডের রোগী অক্সিজেন মাস্ক মুখে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আরেকজন রোগীর আত্মীয় নিরস মুখে বারবার হাই তুলছে আর চুপচাপ বিস্কুট খাচ্ছে। আমি এখানে নার্সের চেয়ারে বসে টুকটাক লিখছি আর মনিটরে আব্বার স্যাচুরেশন দেখতেছি। ৮৮,৮৯,৮৭,৯০ চলছে, চলবে।

সারারাত আমার এই একটাই কাজ। তার অক্সিজেন মাস্ক ঠিক করে দেয়া আর স্যাচুরেশন দেখা। প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু এখানে এখন মাস্ক খুলে পানি খাওয়ার উপায় নাই। পুরো জায়গাটাই বিষাক্ত। এখনো সুস্থ আছি, আব্বার পাশেও কেউ একজন আছে। একটুও অসুস্থ হওয়া যাবেনা। কোনোভাবেই না। তাহলেই সব শেষ।

কোনো এক দৈব শক্তি আমাকে শক্ত থাকার রসদ যোগাচ্ছে। কী সেই শক্তি আমি জানিনা। মেডিকেল টার্মে অনেক সময় একে এ্যাড্রেনালিন রাশ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু আমার মনে হয় অন্য কিছু। জাগতিক সকল মেডিকেল টার্ম আর সজ্ঞায়নের থেকেও এটা অনেক বৃহৎ কিছু। কিন্তু কী সেটা? আম্মার দোয়া? হয়তোবা!

ঘড়িতে এখন রাত ৩ টা ২০। পিপাসা বেড়েই চলেছে। সামনেই পানির বোতল, কিন্তু খেতে পারছিনা। আব্বাকে রেখে কোথাও যাওয়াও যাচ্ছেনা। অপেক্ষা করছি আমি। অপেক্ষা করতে হবে কাল সকাল ১১টা পর্যন্ত। হয়তো আরো বেশি। একটু পানির জন্য! একটু মুক্ত বাতাসের জন্য!

লেখক: শিক্ষার্থী, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়