অবশেষে লাশটি আড়াই কিলোমিটার দূরে দাফন হলো

সকাল থেকেই নানা বাধা-বিপত্তি আর নানা নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে রাত পৌনে ৮টার দিকে বগুড়ার শিবগঞ্জের সেই লাশের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে জ্বর ও সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত ওই ব্যক্তিকে বাঁচানোর জন্য তাঁর স্ত্রী রাতভর আকুতি জানালেও কেউ এগিয়ে আসেনি। পরে শনিবার দুপরে তার মৃত্যু নিশ্চিত হয়। মৃত্যুর পর দীর্ঘক্ষণ চেষ্টার পর নির্জন জঙ্গলে তার লাশ দাফন করা হয়।

জানা যায়, উপজেলা প্রশাসন প্রথমে ওই ব্যক্তিকে একই এলাকায় দাফনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু এলাকাবাসী তাতে বাধা দেন। এ অবস্থায় খানিকটা দূরে সরকারি মালিকানাধীন পীরের মাজারের পাশে দাফনের চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু তাতেও বাধা দিচ্ছেন স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মেজবাউল হোসেন এবং ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি–সমর্থিত সাবেক ইউপি সদস্য সুজাউদ্দোলা।

ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এস এম রূপম বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসন খাস শ্রেণিভুক্ত একটি মাজারের পাশে ওই ব্যক্তিকে দাফনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সেখানে কবর খোঁড়ার কাজে বাধা আসায় আমরা এখন লাশ নিয়ে বিপাকে পড়েছি।’

একজন স্থানীয় সাংবাদিক যিনি লাশ দাফনের সময় উপস্থিত ছিলেন, তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখছেন, ‘‘উপজেলা প্রশাসন প্রথমে ওই ব্যক্তিকে দাফনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এলাকাবাসী তাতে বাধা দেন। এ অবস্থায় খানিকটা দূরে সরকারি মালিকানাধীন পীরের মাজারের পাশে দাফনের চেষ্টা করা হচ্ছিল। তাতেও বাধা দেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মেজবাউল হোসেন এবং বিএনপি সমর্থিত সাবেক ইউপি সদস্য সুজাউদ্দোলাসহ তাদের সমর্থকরা। একপর্যায়ে তারা রাস্তা অবরোধ করে রাখে। পরে বগুড়া থেকে অতিরিক্ত ২ প্লাটুন পুলিশ নিয়ে তাদের হটিয়ে কড়া নিরাপত্তায় লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে পুলিশ।”

জানা যায়, লাশ দাফনে বাঁধা দিতে কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়েছিল। দুপুর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা বাঁধা দিচ্ছিল। পুলিশ তাদেরকে সরিয়ে দেবার পর কবর খোড়ার লোক পায়নি। শেষ পর্যন্ত শিবগঞ্জ থানার সেকেন্ড অফিসার এস আই মোস্তাফিজ আর এস আই আহসান আরো দুই জনকে সাথে নিয়ে লোকালয় থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে একটি নির্জন জায়গায় কবর খোড়েন। এত দূরে দাফন করতেও আপত্তি করেছিল ওই এলাকার লোকজন। শেষ পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের সর্বাত্মক ভূমিকায় একটি লাশ পেলো তার অবশিষ্ট মর্যাদা। লাশ কবরস্থ করার পর ওখানকার ‍উপজেলা চেয়ারম্যান কবর থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মোনাজাত ধরেন। সেই মোনাজাতে অংশগ্রহণ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কিছু পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় কিছু সাংবাদিক।

আওয়ামী লীগের সভাপতি মেজবাউল হোসেন লাশ দাফনে বাধা দেওয়ার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, যে বাড়িতে ওই ব্যক্তি মারা গেছেন, তার আশপাশে অনেক কবরস্থান রয়েছে। পাশেই করতোয়া নদীপাড় রয়েছে। কিন্তু ইউপি চেয়ারম্যান ইচ্ছা করেই প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পীরের মাজারে কবর দিতে চাইছেন। এতে এলাকাবাসীর মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এলাকাবাসীর দাবি, কোনোভাবেই তাঁরা অন্য এলাকার মানুষকে এখানে কবর দিতে দেবেন না। এলাকাবাসীর দাবির মুখে তাঁরা এখানে কবর খুঁড়তে নিষেধ করেছেন।

শিবগঞ্জ ইউএনও আলমগীর কবির বলেন, করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগ ইতিমধ্যে ওই ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠিয়েছে। পরিবারকে কোয়ারেন্টিনে রাখার পাশাপাশি আশপাশে ১০টি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। এরপর দাফনের উদ্যোগ নেওয়া হলে কেউ করোনা আতঙ্কে লাশ স্পর্শ করতে রাজি হয়নি। অনেক অনুরোধের পর অন্য এলাকার দুজন ব্যক্তিকে রাজি করানো হয়। কিন্তু লাশ দাফনের জন্য কবর খুঁড়তে গেলে প্রথমে স্থানীয় লোকজন বাধা দেন। শেষে বাধ্য হয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পর খানিকটা দূরে খাস সম্পত্তির একটি কবরস্থান নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সেখানেও এলাকাবাসী কবর খুঁড়তে বাধা দিচ্ছেন। ওই ব্যক্তির বাড়ি অন্য উপজেলায় হওয়ায় সেখানেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার স্ত্রী ছাড়া তাঁর পরিবারের অন্য কেউ যোগাযোগও করছেন না।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ওই ব্যক্তির বাড়ি বগুড়ার কাহালু উপজেলায়। একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত তাঁর স্ত্রী। তাঁর কর্মস্থলের সুবাদে তিনি গাজীপুরে থাকতেন। সেখান থেকে শিবগঞ্জ উপজেলায় এসেছিলেন। প্রচণ্ড জ্বরে অচেতন, হাসপাতালে নেওয়ার ডাকে প্রতিবেশীদের সাড়া না দেওয়া, অ্যাম্বুলেন্সের জন্য রাতভর স্ত্রীর চেষ্টা, একের পর এক হটলাইনে ফোন করে বিফল—সবকিছুকে পেছনে ফেলে তিনি আজ শনিবার সকালে মারা যান।


সর্বশেষ সংবাদ