মন্ত্রণালয়-বোর্ডে অভিযোগ

মতিঝিল মডেলে শিক্ষার্থী নেমেছে অর্ধেকে, নেপথ্যে সিন্ডিকেট-অনিয়ম

মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ  © ফাইল ছবি

আর্থিক অনিয়ম, নিয়ম বহির্ভূত নিয়োগ-বদলি, শিক্ষকদের হয়রানি, ছুটি না দেওয়াসহ নানা অনিয়মে ডুবছে রাজধানীর অন্যতম নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এর আগে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি আবদুল মতিন ভূঁইয়াসহ কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের নানা অভিযোগ থাকলেও এবার সে তালিকায় যুক্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির নতুন অধ্যক্ষ মাহফুজুর রহমান খানের নাম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধ্যক্ষ এবং সভাপতির নানা নিয়ম বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে ডুবতে বসেছে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম। তারা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় চাচ্ছেন, শিক্ষানুরাগী ও রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে রয়েছেন এমন ব্যক্তিদের।

এসব অভিযোগ স্ব-বিস্তারিত তুলে ধরে মোটাদাগে মোট ১৬টি অভিযোগের বিষয়ে জানিয়ে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে বিচার ও চলমান সমস্যার সমাধান চেয়েছেন শিক্ষকরা। এ নিয়ে গত সপ্তাহে মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকদের পক্ষে লিখিত অভিযোগ জমা দেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক শিক্ষক মো. রুহুল আমিন ও গাজী রফিকুল ইসলাম। আর এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে গঠিত কমিটির প্রতিষ্ঠানটিতে যাওয়ার কথা রয়েছে চলতি সপ্তাহে।

মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতি হিসেবে রয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদকের পদে থাকা আবদুল মতিন ভূঁইয়া। আর বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান খান প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন গত ৩০ মার্চ থেকে। রাজধানীর মতিঝিলে প্রতিষ্ঠানটির মূল ক্যাম্পাস ছাড়াও বর্তমানে বাসাবোতে একটি শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে প্রতিষ্ঠানটিতে ১৫ হাজারের মতো শিক্ষার্থী থাকলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজারের মতো। আর এসব শিক্ষার্থীকে পাঠদানে বর্তমানে দায়িত্বে রয়েছেন ২৫০ জনের মতো শিক্ষাগুরু।

নতুন অধ্যক্ষের যোগদানের এক মাসের মধ্যেই শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডির সভাপতির একটি সিন্ডিকেট, তাতে রয়েছেন একই প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষকও। ইতিমধ্যে কয়েকজন শিক্ষকের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে মিথ্যা অভিযোগও করা হয়েছে। ফলে শিক্ষকরা ক্লাসে মনোযোগী হওয়ার চেয়ে চাকরি টিকিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এতে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদানসহ প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম—জানানো হয়েছে লিখিত অভিযোগে। এতে সাবেক অধ্যক্ষ গাড়ি মেরামত বাবদ ৬০ হাজার টাকার দরপত্রের বিপরীতে একই কাজ বর্তমান অধ্যক্ষের ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকায় খরচসহ নানা অনিয়মের বিষয়ও জানানো হয়েছে।

অভিযোগে বলা হয়েছে, সম্প্রতি শিক্ষক মোজাম্মেল হোসেনকে (ইসলাম শিক্ষা) দিবা থেকে প্রভাতি শাখায়, প্রভাতি শাখার শিক্ষক মাহমুদুল হাসানকে (ইসলাম শিক্ষা) দিবা শাখায় ও শিক্ষক রুহুল আমিনকে (প্রাথমিক) বাসাবো থেকে মূল ক্যাম্পাসে আনা হয়। শিক্ষকরা প্রতিবাদ করলে আরও কয়েকজনকে বদলি করা হয়। মূল শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত শাখা-প্রধান (প্রাথমিক) রমেশচন্দ্র বিশ্বাসকে সরিয়ে ভাউচার মাস্টার হিসেবে পরিচিত আনিসুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। একইভাবে মূল শাখার মাধ্যমিক শাখার ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষিকা আক্তারি বেগমের জায়গায় সভাপতির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ইউসুফ মিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোনো শিক্ষককে মূল ক্যাম্পাস থেকে শাখায় বদলি করা বিধিবহির্ভূত। শাখা ও মূল স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ পৃথকভাবে হয়।

এর আগে গত ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা ভেঙে অনৈতিকভাবে ছাত্রদের নকল সরবরাহের চেষ্টা চালান বর্তমান গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্য। এতে বাধা দেন সাবেক অধ্যক্ষ ড. মুন্সি শরিফুজ্জামানসহ কয়েকজন শিক্ষক। ব্যাপারটি জানাজানি হলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় গভর্নিং বডির একজন সদস্যের সদস্যপদ বাতিল করা হয়। এর জেরে সাবেক অধ্যক্ষকে স্কুল থেকে সরানো হয়েছে বলে তখন জানিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের।

এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান গভর্নিং বডির সদস্য এনামুল হক ও কামরুজ্জামান শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির তালিকা তৈরি করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এখানেই শেষ নয় এ বদলি ঠেকানোর ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে টাকার বিনিময়ে। বর্তমান সভাপতি ও অধ্যক্ষের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় বাসাবো শাখার প্রাথমিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাখা প্রধান মো. কবির আহমেদ এবং মো. দেলোয়ার হোসেনের পদ দুটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। অথচ মূল ক্যাম্পাসে ওই পদ দুটি বহাল রয়েছে। শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক আনিসুল ইসলামকে প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে এখন বন্ধ রয়েছে পাঠদান শুরুর আগে বাধ্যতামূলক জাতীয় সংগীত পরিবেশনসহ নিয়মিত শারীরিক কসরতের মতো কর্মসূচি।

লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, বর্তমান সভাপতি প্রতিটি কথায় একজন মন্ত্রীকে তার কাছের মানুষ হিসেবে পরিচয় দেন। এ প্রতিষ্ঠানে তিনি যাই করেন কিংবা করবেন তার জন্য তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না বলেও জানান। আর বর্তমান অধ্যক্ষ দম্ভের সাথেই বলেন, তিনি বর্তমান সভাপতি মতিন ভূঁইয়ার সহযোগিতায় এ প্রতিষ্ঠানে এসেছেন। এখান থেকে সহসা যাচ্ছেন না; শিক্ষক-কর্মচারীরা তার কথা শুনতে বাধ্য।

এছাড়াও সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির প্রভাতি শাখার শিক্ষক সুলতানা নার্গিস স্কুল চলাকালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে অধ্যক্ষ তাকে ছুটি দেননি। বরং জোর করে পরীক্ষার ডিউটি করাতে বাধ্য করা। ফলশ্রুতিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকালেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন ওই শিক্ষিকা—যুক্ত করা হয়েছে ওই অভিযোগ পত্রে।

মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা গভর্নিং বডির সভাপতি হচ্ছেন। তাদের শিক্ষার সঙ্গে আগে তেমন সংযোগ ছিল না। হঠাৎ করেই তারা বড় প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হয়ে নানাভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছেন। ক্ষমতার দাপট দেখানোর চেষ্টাও আছে। এতে শিক্ষাদানের মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের মতে, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পরিচালনায় রাখলে তারা নানা ধরনের অনিয়মে যুক্ত হয়ে পড়েন। ফলে প্রতিষ্ঠাতে মূল শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। সেজন্য তাদের দাবি, প্রতিষ্ঠানের সুনাম ফিরিয়ে আনা ও স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হরে পরিচালনায় রাখতে হবে শিক্ষানুরাগী ও ভালো ব্যক্তিদের।

এ নিয়ে মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহফুজুর রহমান খানকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ব্যস্ত রয়েছেন বলে জানান। এরপর তার সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এছাড়াও এসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে জানতে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি আবদুল মতিন ভূঁইয়া কোন সাড়া দেননি।

যদিও এর আগে তিনি জানিয়েছিলেন, যেসব অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো মিথ্যা। তবে আমরা নিতান্ত প্রয়োজনে কিছু শিক্ষককে সমন্বয় করেছি। এতে হয়তো তাদের শাখা বা শিফট পরিবর্তন হয়েছে। এটা সাময়িকভাবে করা হয়েছে। সমস্যা মিটে গেলে তাদের আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেওয়া হবে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence