মায়ের সীমাহীন কষ্টের ফসল বাংলাদেশের ‘লেখনের’ নোবেল মনোনয়ন

  © সংগৃহীত

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন চিকিৎসক ডা. রুহুল আবিদ এবং তার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ফর অল (হায়েফা) চলতি বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে। রুহুল আবিদ যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটি আলপার্ট মেডিকেল স্কুলে অধ্যাপনা করছেন।

রুহুল আবিদের পরিবারের স্বাধীনতার আগে থেকেই ঢাকার কলাবাগান এলাকায় বসবাস করে আসছেন। তবে যুদ্ধোত্তরকালে তাদের আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না, কঠিন সংগ্রাম আর অমসৃণ পথে এগিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। অভাব-অনটনের মধ্যে তার মা রাজিয়া বেগম ছোট চাকরি করে সীমাহীন কষ্ট আর সংগ্রাম করে বড় করেছেন আজকের রুহুল আবিদকে। তাঁর ডাক নাম লেখন।

চলতি বছরের নোবেল পুরস্কারের জন্য যে ২১১ জনকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তার মধ্যে আবিদ অন্যতম। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ডিএমসি) থেকে এমবিবিএস শেষ করেন। পরে জাপানের নাগোয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন। এছাড়া ২০১১ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল থেকে ফেলোশিপ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ব্রাউন গ্লোবাল হেলথ ইনিশিয়েটিভের একজন নির্বাহী ফ্যাকাল্টি সদস্যও।

তার ও মা রাজিয়া বেগমের জীবন সংগ্রাম নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছে লাজ ফার্মার প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক লুৎফর রহমান। লেখনদের প্রতিবেশিও তিনি। একসাথেই জীবন সংগ্রাম চালিয়েছেন তারা। তিনি লিখেছেন, ‘কলাবাগানের ছেলে লেখনের নোবেল পাওয়ার খবরে বিজয় আনন্দে স্বাধীনতা উত্তর কলাবাগান দুলে উঠল চোখের সামনে। ১৯৭২ সাল। নতুন দেশে নতুন জীবনের সন্ধানে দিশেহারা আমাদের জীবন।’

তিনি বলেন, ‘লাজ ফার্মা শুরুর আগে মাস দু’য়েকের জন্য একটা চাকরিতে ঢুকেছিলাম। একটা দেশি কোম্পানির উৎপাদিত মালামাল মার্কেটিংয়ের কাজ। বিক্রয় প্রতিনিধি। আমি দলনেতা। সঙ্গী দু’জন। একজন আমার স্ত্রী, অন্যজন রাজিয়া আপা। বিক্রির অর্ডারের পার্সেন্টেজ যা পাই, তিনভাগে ভাগ করে নেই। দিনশেষে খাটা-খাটনিতে যা পাই তাতে আমাদের দুই পাতেরই ভাত জোটে না; সেখানে চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে রাজিয়া আপার সংসার কেমন চলে বুঝতেই পারি।’

তিনি লিখেছেন, লেকসার্কাস রোড দিয়ে কলাবাগানে ঢুকতেই বাড়ির নিচতলায় রাজিয়া আপার স্বামী দুলাভাইয়ের একটা ট্রেনিং কোচিং ছিল। সেটারও তেমন আয়-ইনকাম ছিল না। কিন্তু তাতে কি? রাজিয়া আপার ছিল অদম্য ইচ্ছাশক্তি, ধৈর্য, মনোবল আর অল্পতেই সংসার গুছিয়ে চলার অসীম দক্ষতা। অভাবই আমাদের দুই পরিবারকে নিকট থেকে নিকটতর করেছিল।

সেই স্মৃতি স্মরণ করে লুৎফর রহমান বলেন, সে সব দু:সময়ের কথা স্মরণে এনে দেখা-সাক্ষাতে আজও আমরা আনন্দে আন্দোলিত হই। দু:খ-দারিদ্রকে পায়ে চেপে অর্জিত বিজয়ের কাছে অতীতের মুখপোড়া স্মৃতি মুহূর্তে ম্লান হয়ে স্মরণে জ্বলজ্বল করে ওঠে। অভাবকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কীভাবে রাজিয়া আপা পিঠেপিঠি তিনটা ছেলেকে মানুষ করেছেন তিনি, তা সমসাময়িক সময়ের উদাহরণ হয়ে থাকবে আমাদের মধ্যে চিরকাল। নোবেল মনোনয়নপ্রাপ্ত ডা. রুহুল আবিদ আর কেউ নয়, আমার অন্যতম সংগ্রামী কর্মসঙ্গী, জীবনযোদ্ধা, সততা আর একনিষ্ঠতার প্রতীক রাজিয়া আপার ছেলে লেখন।

এ খবর শুনে রাজিয়া বেগমের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময়কার কথা বলার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, আবেগাপ্লুত কন্ঠে জানান দিলেন, তাঁর বিজয় গাঁথার খবর- লেখন নোবেল মনোনয়ন পেয়েছে। বললেন, লেখন আমাকে আমেরিকায় এনেছে। এতকাল বোস্টনে লেখনের ওখানেই ছিলাম। এখন নিউজার্সিতে ছোট ছেলের কাছে। মেঝোটাও ইঞ্জিনিয়ার, থাকে টেক্সাসে।

তিনি বলেন, ‘পাশ থেকে আমি বললাম- সব মনে আছে আপা। সেসব দিনের কথা কেউ কী কোনোদিন ভোলে? বললাম- আপনি পাঁচ বছরের বড় সাক্ষাৎ বড়বোন। সদরঘাট থেকে মুড়িরটিন বাসে উঠবার সময় ফুটপাথ থেকে কেনা ডালঘুটনি দিয়ে পিটিয়েছিলেন একজনকে, ঠেলাঠেলির মধ্যে মহিলাদের অগ্রাধিকার না দেবার কারণে।’

‘উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন রাজিয়া আপা। বললেন- সেই কথাটা সবসময় আমার মনে হয়। তখন সদরঘাটের মুড়িরটিন ছিল বাহন, এখন গ্যারেজে গাড়ীর বহর। মনটা ভালো হয়ে গেল। তিনদিন হলো আমাদের আর এক কন্যা ডা. রশিদের মেয়ে দিয়া ফেসবুকের বাংলাদেশ অংশের মনোনয়ন পেয়েছে।’ যোগ করেন লুৎফর রহমান।

ডা. আবিদের প্রতিষ্ঠিত হায়েফা বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছে। বিগত তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৩০ হাজার গার্মেন্ট কর্মী ছাড়াও ৯ হাজার আরএমজি কর্মী ও সুবিধাবঞ্চিত নারী এবং দেড় লাখ রোহিঙ্গা ও আটকে পড়া জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা দিয়েছে।

এখন তারা কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। মূলত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাতে করোনাভাইরাস না ছড়ায় সে বিষয়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। ২০১৩ সালে রানা প্লাজায় ধসের পর দেশব্যাপী এ খাতের কর্মীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করে হায়েফা। এছাড়া ঢাকা, গাজীপুর ও শ্রীপুরেও গার্মেন্ট কর্মীদের চিকিৎসা দিচ্ছে আবিদের সংগঠনটি।

হায়েফা মূলত উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তস্বল্পতা, যক্ষ্মা ও প্রসবজনিক ঝুঁকি নিরসনে কাজ করে আসছে। ২০১৬ সালে এইচএইএফএ’র ডিজিটাল উদ্ভাবন ছিল ‘নিরোগ’ ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। দুটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই ব্যবস্থা দিয়ে সেবা দিচ্ছে তারা। এর মাধ্যমে সংগৃহীত রোগীর তথ্য স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিনিময় করায় তাদের সঠিক সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

আর সর্বশেষ ছয় মাসে মহামারি মোকাবিলায় কাজ করছে হায়েফা। এছাড়া ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে ডা. আবিদের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পিপিই ও ১০ হাজার কেএন-৯৫ মাস্কের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেন। ডা. আবিদ এবং তার প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালে কানাডায় ‘স্টার ইন গ্লোবাল হেলথ’ খেতাবে ভূষিত হন। তিনি হায়েফাতে কাজ করার জন্য কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা বা সম্মানী গ্রহণ করেন না।


সর্বশেষ সংবাদ