চ্যাম্পিয়নদের বাড়িতে আনন্দের বন্যা, চলছে বরণের প্রস্তুতি

  © টিডিসি ফটো

অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ জয় করে এনেছে দেশের একদল স্বপ্নবাজ তরুণ। তাঁরা প্রায় সবাই সাধারণ পরিবারের এবং প্রত্যন্ত এলাকায়। তবে স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হবেন। অনেকে মা-বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেটে মেতে ওঠেন। অনেক বাবা-মা ভাবেননি ক্রিকেট খেলে তাঁরা এত বড় হবেন। বিশ্বকাপ জয়ের পর মা-বাবা তো বটেই, গোটা দেশের মানুষ খুশি। আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছেন সবাই।

আকবর আলী: ফাইনালে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চাপের মুখে ঠান্ডা মাথায় ব্যাট করে নজর কেড়েছেন অধিনায়ক আকবর আলী। তাঁর গ্রামের বাড়ি রংপুরের রাস্তাঘাটেও মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে ‘আকবর দ্য গ্রেট’। পরিবারের সবার বিশ্বজয়ের হাসি। ২০১৩ সালে বিকেএসপির আমন্ত্রণ পেয়ে ভর্তি হন আকবর।এরপর খেলেছেন অনূর্ধ্ব ১৬, ১৭, ১৮ দলে।

রংপুরের জুম্মাপাড়ার সাদামাটা একটা পুরোনো বাড়ি। সামনে ঝুলছে ব্যাট হাতে আকবরের বড় ছবি। সেখানে তিনটি কক্ষে বাস করেন আকবর আলীর মা-বাবা, তিন ভাই। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আকবর ছোট। বিশ্বকাপ চলাকালে গত ২২ জানুয়ারি মারা যান একমাত্র বোন।

এরপর থেকে পরিবারে শোকের ছায়া। তবে বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়ে শোকার্ত পরিবারে ফুটেছে হাসি। আকবরের বাবা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, ‘আনন্দের ভাষা নেই।’ আর কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা সাহিদা বেগম বলেন, ‘মেয়ে মারা যাওয়ায় বাড়ি শোকাহত। আমার বাবা (ছেলে) এত ভালো খেলবে, ভাবতেই পারিনি। এই আনন্দ পুরো দেশবাসীর। ওর বোন বেঁচে থাকলে খুশি হতো।’

অভিষেক দাস: আরেক ক্রিকেটার অভিষেক দাস অরণ্যের মা–বাবার মুখেও শুধু হাসি। ভিক্টোরিয়া কলেজ এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন তিনি। তার বাবা অসিত দাস বলছিলেন, ‘অনূর্ধ্ব–১৯ ক্রিকেট দলে আমার ছেলে খেলবে, স্বপ্নেও ভাবিনি। খুলনা স্টেডিয়ামে যখন ট্রায়াল হয়, তখনো ভাবিনি টিকে যাবে। যখন চূড়ান্ত পর্যায়ের অনুশীলনে ঢাকায় যাওয়ার সুযোগ পায়, তখন ভাবতে শুরু করি, ও একটা কিছু করে ফেলবে’

অভিষেকের বাড়ি নড়াইলের বাধাঘাট চত্বরে। অসিত দাস বলেন, ‘ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে মানত করেছি বাংলাদেশ যেন চ্যাম্পিয়ন হয়। অভিষেক বাড়িতে ফিরলে পূজার আয়োজন করব।’ আর মা করুণা দাস বলেন, ‘এত আনন্দ জীবনে আর পাইনি।’

শরিফুল ইসলাম: অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলামের বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার মৌমারীতে। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার বোলার শরিফুল ইসলাম নজর কেড়েছেন বিশ্বকাপে। ফাইনালেও করেছেন দুর্দান্ত বোলিং। তাঁদের বিজয় উৎসবের রেশ ছড়িয়েছে মৌমারি এলাকায়। শরিফুলের বাড়িতে এখন গ্রামবাসী আর স্থানীয় বড় কর্তাদের ভিড়।

একসময় রিকশাভ্যান চালিয়ে সংসার চালানো শরিফুলের বাবাকে ফোন করেন রেলপথমন্ত্রী। তার পরিবারের সবার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক। উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনওসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এসেছেন বাড়িতে।

শরিফুলের মা বুলবুলি বেগম বলেন, ‘খেলাপাগল ছেলে। ওর স্কুল ফাঁকি দেওয়াটা বৃথা যায়নি।’ আর বড় ভাই আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ভাই অনেক কষ্ট করে এই জায়গায় গেছে।’

দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে শরিফুল মেজ। ভিটের বাইরে কোনো জমি নেই। বাবা দুলাল ইসলাম ভ্যান চালাতেন। অভাব ঘোচাতে ২০০১ সালে ঢাকার সাভারে পাড়ি জমান। ২০১০ সালে গ্রামে ফিরে আসেন। প্রিমিয়ার লিগে পাওয়া শরিফুলের টাকায় গ্রামে গরুর খামার করেছেন। ওই আয় দিয়েই চলছে এখন পুরো সংসার।

গ্রামেই স্কুল ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট খেলতেন শরিফুল। ২০১৬ সালে দিনাজপুরের ক্লেমন একাডেমিতে ক্রিকেট কোর্সে ভর্তি হন। পরে জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ধীমান ঘোষের নজরে পড়েন তিনি। সেখান থেকে রাজশাহীতে অনুশীলন ক্লাবে কোর্স করার সুযোগ পান শরিফুল। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ডিপিএল এবং ২০১৯ সালে বিপিএলে খেলেন তিনি। পরে ডাক পান অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলে। শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘নিজের চেষ্টা আর বাবা-মায়ের দোয়ায় উঠে আসতে পেরেছি।’

শাহাদাত হোসেন: নিদারুণ কষ্টের মধ্যে বেড়ে ওঠা আর বুদ্ধি হওয়ার আগেই পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তবুও নিজের শখের ক্রিকেটকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন শাহাদাত হোসেন। বিশ্বকাপ ছোঁয়ার পর ছোট্ট কিশোরটির সেই যুদ্ধ সার্থক হয়েছে।

শাহাদাতের ঘরে আনন্দ ভর করেছে। পাড়া–প্রতিবেশীর মধ্যে আনন্দের সীমা নেই। শাহাদাতের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার চরকানাই গ্রামে। বাবা আবদুস ছবুর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সচালক ছিলেন। 

তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে শাহাদাত ছোট। বাবা আবদুস ছবুর ২০১০ সালে মারা যান। তখন থেকেবড় ভাই আবুল হোসেন পরিবারের হাল ধরেন। শাহাদাত একাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন।

মা ফেরদৌস বেগম বলেন, ‘ফাইনাল খেলার আগের দিন শাহাদত ফোন করে দোয়া করতে বলেন। ছেলে যখন খেলছে, তখন কেমন আনন্দ হচ্ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আজ সে সারা দেশের ছেলে। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটপাগল ছিল। আর্থিক অনটনের কারণে ব্যাট কিনে দিতে না পারায় তাকে কাঠ দিয়ে ব্যাট বানিয়ে দিতাম।’

বড় ভাই আবুল হোসেন ভাড়া অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে সংসার চালান। তিনিও ভাইয়ের কীর্তিতে খুশি। আর খুশি শাহাদাতের মেন্টর ক্রিকেটার সুদীপ্ত দেব।

শামীম পাটোয়ারী ও মাহমুদুল হাসান: যুব বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য শামীম পাটোয়ারী ও মাহমুদুল হাসানের (জয়) জন্য চাঁদপুরজুড়ে আনন্দের বন্যা বইছে। তাঁদের মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজন স্থানীয় ক্রিকেট একাডেমি এবং চাঁদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও খুশিতে আত্মহারা।অপেক্ষায় আছেন দুই কৃতী ক্রিকেটারকে সংবর্ধনা দেওয়ার।

শামীম ও মাহমুদুল ক্লেমন চাঁদপুর ক্রিকেট একাডেমির ছাত্র ছিলেন। স্কুলে পড়ার সময় দুজনেই সেখানে প্রশিক্ষণ নেন। পরে বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। ক্লেমন চাঁদপুর ক্রিকেট একাডেমির কোচ শামীম ফারুকী বলেন, ‘১৪ জনের দলে আমার দুজন ছাত্র অংশ নেওয়ায় আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আমি আশাবাদী, ভবিষ্যতে তারা জাতীয় দলের হয়ে খেলবে।’

চাঁদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘শামীম ও মাহমুদুল বাংলাদেশের জন্য একটা ইতিহাস তৈরি করেছে।’

ফরিদগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া আবদুর রহমান পাটোয়ারী বাড়ির ছেলে শামীম পাটোয়ারী। বাবা আবদুল হামিদ পাটোয়ারী ঠিকাদারি করতেন। আর মাহমুদুল হাসানের বাড়ি ফরিদগঞ্জ উপজেলার রামপুর বাজারে। বাবা আবদুল বারেক চাঁদপুর পূবালী ব্যাংক নতুন বাজার শাখার কর্মকর্তা।

শাহীন আলম: শাহীন আলম ও তাঁর দরিদ্র পরিবারকে এখন সবাই চেনে। বিশ্বকাপ জয়ের পর পুরো গ্রামের মানুষ উচ্ছ্বসিত। সবাই শাহীনকে নিয়ে আলোচনা করছেন। তার বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার যমুনা পাইকপাড়া গ্রামে। দুই শতক জমির ওপর বাড়ি তাদের একমাত্র সম্পদ।

মা সাতিনা বেগম জানান, ‘খেলার আগের দিন রাইতোত রিং করি কয় মা দোয়া করিস। ফাইনাল খেলা দেখছি উয়ার বাপসহ। বারে বারে দোয়া পড়ি। যখন জিতিল, চোখ দিয়া পানি আসিল।’

দিনমজুর বাবা মো. সাহাদাৎ আলী বিকেলে কাজ শেষে বাড়িতে যখন এলেন, তখন হাতে–পায়ে মাটি। তিনি বলেন, ‘রাইতোত খেলা দেখছি। কামোত যাওয়ার সময় শুনি সবাই ছাওয়াক নিয়া কথা কবার নাগছে। অনেকে জিজ্ঞাসা করে শাহীন কুনদিন আসপে।’

রাকিবুল হাসান: জয়ের জন্য দরকার ১ রান। মিড অনে বল ঠেলে দুহাত আকাশে ছড়িয়ে দেন রাকিবুল হাসান। ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার রূপসী বাজারের চায়ের দোকানে নামে উৎসবের হুল্লোড়। স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে সেখানেখেলা দেখছিলেন রাকিবুলের স্বজনেরা। নিজেদের গ্রাম বাশাটিতে বিদ্যুৎ না থাকায় সেখানে জড়ো হন সবাই।

গ্রামের সন্তান রাকিবুলের এমন কীর্তিতে সারাদেশেই নামে উৎসবের আমেজ। তাঁর বাবা শহীদুল ইসলাম ঢাকায় গাড়ি চালান। জন্মের পর থেকে ঢাকাতেই বেড়ে ওঠা রাকিবুলের। তবে সুযোগ পেলেই গ্রামে যান তাঁরা। রাকিবুলের গ্রামে টিনের ছোট্ট পুরোনো বাড়ি।

রাকিবুলের ফুফা কামাল হোসেন পরিবার নিয়ে এখানে বসবাস করেন। গ্রামের আনন্দ বাড়াতে রাকিবুলকে নিয়ে গ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তাঁর বাবা। তিনি বলেন, ‘গ্রামের মানুষের উচ্ছ্বাসের খবর পেয়েছি। তাঁদের সঙ্গে এ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেব।’


সর্বশেষ সংবাদ