আবরার স্টাইলে নির্যাতনের আরেক কাহিনী ভাইরাল

  © প্রতীকি ছবি

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতন চালানোর বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। আবরারের আগে অনেক শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তুচ্ছ ঘটনায় এমনকি সালাম না দেওয়ার অজুহাত তুলেও তাঁদের পেটানো হয়েছে।

আবরার হত্যার দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি নির্যাতনের এমনই একটা বর্ননা স্যোশাল মিডিয়ায় ঘুরছে। নির্যাতনের স্বীকার আহসানউল্লাহ হলের ওই শিক্ষার্থী বলেন, নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ করবেন কি করবেন না- সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতেই তার দীর্ঘসময় লেগেছে। অবশেষে বিষয়টি সামনে এনেছেন তিনি, যা অন্য একটি শিক্ষার্থী ফেসবুকে তুলে ধরেছেন।

‘সেই ছেলেটাও হতে পারতো আবরার ফাহাদ’ শিরোনামে লেখা স্ট্যাটাসটি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

‘ছেলেটা ছিল আহসানউল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র। হলের বিভিন্ন খেলাধুলায়, ক্রিকেট টুর্নামেন্টে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতো সে। খেলাধুলার সুত্র ধরেই হলের পলিটিক্যাল, নন-পলিটিক্যাল প্রায় সবার সাথেই ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। সবার সাথেই হাস্যজ্জ্বল কথা হত দেখা হলেই। এদের অনেকেই অনলাইন-অফলাইনে সুশীলতা দেখাত। উপচে পড়া ভালোবাসা দেখাত। এখনো বুয়েটের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সবাই এদের সুশীল, সভ্য ছাত্রলীগার মনে করে। ছেলেটাও তা-ই মনে করত, ভাবত— এদের মন মানসিকতা, চিন্তা ধারা, নীতি অনেক উর্ধ্বে। সে ভাবত— বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যদি সত্যিকার অর্থে এই জামানায় কেউ ধারণ করে, তাহলে এই উন্নত মানসিকতার বন্ধু, বড় ভাইয়েরাই করে। একজনের তো ফেসবুক প্রোফাইলে তো ঝুলানো আছে ‘বোকাসোকা ধরনের, যুগের সাথে চলে না, মুক্তিযুদ্ধ-মৌলবাদী একজন ছেলে’।

কিন্তু এই বোকাসোকা, যুগের সাথে না চলা, মুক্তিযুদ্ধ মৌলবাদী বন্ধুর রুদ্ররুপ কতটা উত্তাপ ছড়ায় তা ছেলেটার ধারণার বাইরে ছিল।

আর, আরেকজন ছিল খুবই শ্রদ্ধেয় বড় ভাই। যার কাভারে হয়তো এখনো লেখা আছে, ‘রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়ায় উচিত- বঙ্গবন্ধু’। অথচ এই বড় ভাইটার পিশাচ রূপ যে কতটা বিষাক্ত, ছেলেটার কষ্মিনকালেও চিন্তা হ নি।

২০১৮ সালের ৯ বা ১০ এপ্রিল। দেশ তখন কোটা সংস্কার আন্দোলনে অগ্নিকুণ্ডে উত্তপ্ত। ছেলেটা হাতিরপুলে টিউশন করাতে গেছে। ছোট বেলায় একদম গ্রামে বড় হওয়ায় ইলেকশনের আগের মিছিল, জনসভা দেখতে ভাল  লাগত। টিউশনি শেষে ছেলেটা মনস্থির করলো শাহবাগ দিয়ে ঘুরে টিএসসি হয়ে হলে যাবে। টিএসসির এক কাপ গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে ছেলেটা দেখলো, হাতে গোনা পনের-কুড়ি জন মানুষ রাজু ভাস্কর্যের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। শোনা গেল, কোটা আন্দোলনকারীর মূল নেতা যারা— সেই রাশেদ, নূর, তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন নানক সাহেবের সাথে বৈঠকের পর; সম্ভবত এক মাসের জন্য। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বাম নেতা কর্মী আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

যথারীতি মিডিয়ার সামনে একটা ব্রিফিং দেয়। ছেলেটা ওই সময় ভাস্কর্যের সামনেই দাঁড়িয়ে। সংখ্যা কম হওয়ার কারণে আর টিভি-পেপারে সম্প্রচারিত হওয়ার আনন্দে সেও ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল বেশ গম্ভীর মুখে। তখন প্রেস ব্রিফিং চলছিল বাম দলের। পরবর্তীতে সকল টিভি কভারেজ, অনলাইন পোর্টালে নিউজ হয়; সেই ছেলেটাও হয়ে যায় কোটা আন্দোলনকারী নেতা। অথচ, বুয়েটে পড়তে আসা সহজ-সরল ছেলেটা কখনো কোন ধরণের ম্যাস মুভমেন্টে যায়নি, যদিও সে অনেক সাধারণ মানুষের মতো বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করে।

রাত দশটা। ছেলেটা ফিরলো হলে। সাথে সাথেই তার সাবেক রুমমেট, আদরের এক ছোট ভাই, পরবর্তীতে বুয়েট ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা ফোন দিয়ে জানায়, ‘ভাই, আপনাকে ‘বড়’ ভাই ডাকে। গেল সেই ‘বড়’ ভাইয়ের রুমে। রুমে ঢুকা মাত্রই সেই অতি নীতিবান সেই ‘বড়’ ভাই বলে, ‘ফোন-ল্যাপটপ নিয়ে আয়’।

ছেলেটা এই চেহারা দেখে কেপে উঠলো, দ্রুত কাঁপা কাঁপা হাতে ল্যাপটপ আর ফোন ওদের দিয়ে দিল। এরপর, শুরু হয় ইন্টারোগেশন, সেই রাতের কথা ছেলেটা কখনো ভুলতে পারবে কিনা, বিধাতাই জানেন। সেই রাতের কথা মনে পড়লে এখনো ভয়ে শিউরে ওঠে সেই ছেলেটা। বাইরে থেকে হঠাৎ ২০১১ ব্যাচের ‘আহসান’ বাংলা সিনেমার নায়কের মত উড়ে এসেই লাথি, কিল-ঘুষি মারা শুরু করল। সেই সাথে সজোরে কেউ একজন তল পেটে কিল দিল। আর চলছিল অশ্রাব্য সব গালিগালাজ!

ছেলেটার ফোন, ল্যাপটপে ঠিক আবরারের ল্যাপটপ যেভাবে খোঁজা হয়েছিল, সেভাবেই তারা অনুসন্ধান অভিযান শুরু করল। যে করেই হোক তাকে শিবির বানাতে হবে। আর এদিকে ‘আহসান’ ক্লান্ত হলে শুরু হলো সেই প্রথম ‘বড়’ ভাইয়ের পালা। তার সর্বশক্তির কিল ঘুষি, লাথি সেই ক্ষীণকায় ছেলেটা কিভাবে সেদিন সহ্য করেছে তা হয়তো সৃষ্টিকর্তাই ভালো বলতে পারবে। হঠাৎ সেই ‘বড়’ ভাই হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা দিয়ে ছেলে টাকে ছ্যাকা মারতে গিয়ে থেমে গেলো, প্রচন্ড ভয় দেখানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

গেটের বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে, আর রুমের মধ্যে তাদের শিবির প্রমাণের প্রাণান্তকর চেষ্টা। কোনরকম স্বীকারোক্তি পেলেই পুলিশের হাতে তুলে দিবে তারা ছেলেটাকে।

ভয়ে, ব্যাথায় আর অজানা শংকায় দূর্বল সেই ছেলেটাকে হিসহিসিয়ে বলছে, তুই ‘ট্রেইন্ড শিবির’, ‘কোটা আন্দোলনের নেতা’, স্বীকার যা! হলে আর কে কে শিবির এখনি স্বীকার যা! না হলে তোকে এই ঘরে বন্দি করে রাখব। আহসান বলে, ‘এই গুলারে শায়েস্তা করার জন্য আউল্লায় একটা স্পেশাল রুম রাখা লাগবে। যেখানে নিয়ে আরাম করে টর্চার করা যায়’। বারবার মার খাওয়ার পরও ছেলেটা কাঁদছে না, তার সেই বোধটাও অবশ হয়ে গেছে। সে কাঁদে না দেখে আহসান গালি দিয়ে বললো, ‘তুই অবশ্যই ট্রেইন্ড। তোর মধ্যে শিবিরের সব বৈশিষ্ট্য আছে’! তার ব্যাচমেট নিলয় দাস বলে, ‘ভাই, এইটারে জুনিয়রদের হাতে ছেড়ে দেন।’

(ছেলেটার পরনে লুঙ্গি ছিল। এলোপাথাড়ি লাথি আর কিলঘুষিতে কতবার পরনের লুঙ্গি খুলে গিয়েছিল রাত সাড়ে দশটা থেকে ভোর পর্যন্ত সেই রাতে, তার হিসেব নাই।) সেই ‘বড়’ ভাই বা ‘আহসান’ জুনিয়রদের হাতে ছেড়ে দেয় না তাকে। আরো খেলতে চায়।

সিনিয়রগুলো বাইরে গিয়ে শলা পরামর্শ করে। এবার ব্যাচমেটদের পালা। তারই ব্যাচের এক হর্তাকর্তা নেতার সাথে একই ব্যাচের আবির বিন্দু, নিলয় দাস, দিব্য মন্ডল, দীপ্ত আকাশ রয় এর কাছে সেই ছেলেটা। তাদের ব্যাচমেট। এরা প্রত্যেকেই ছেলেটার বেশ ভালো বন্ধু ছিল। তার ব্যাচের সেই নেতা ল্যাপটপ আবার চেক করে। আর বলে উঠে, ‘কিছু পাই নাই’- তার কন্ঠে একটু মায়া ছিলো হয়তো। একটু হয়তো সমবেদনা ছিলো যদিও তার কিছু করার ছিল না এবং পরে সেই ছেলেটা তার সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ করলে সে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায় সেদিনের নির্মম ঘটনার জন্য। (এজন্য তার নাম ডিসক্লোজ করা হয়নি)

এরই মাঝে ‘নিলয় দাস’ ছেলেটার একটা লাইক পায় একটা বিশেষ পোস্টে একটা জনপ্রিয় বুয়েট গ্রুপে। সেই কমেন্টটি ছিলো: ‘বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চাইছিল যেই মতিয়া চৌধুরী সে এখন আওয়ামীলীগের নেতা।’ অমনি সাথে সাথেই আবেগী, নীতিবান আবির বিন্দু কলার চেপে ধরে ছেলেটার আর নিলয় দাস লাথি, ঘুষি চালাতে থাকে। তারা নিষ্ঠুর গলায় গালি দিয়ে বলে উঠে, ‘তুই বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজানোর কথা কস!

অথচ সে শুধুই কমেন্টে লাইক দিয়েছিলো আর কমেন্টটা কি প্রসঙ্গে করা হয়েছিলো সেই ক্ষমতার লোভে অন্ধ ছেলেগুলোর দেখার কথাও না। এরপর চলে আরেক প্রস্থ ইন্টারোগেশন। এর যেনো কোনো শেষ নেই, অনন্তকাল চলতেই থাকবে। ছেলেটা পা ধরে ক্ষমা চায়, আর অসহায় কন্ঠে আর্তি জানায়, ‘আমি শিবির না! আমি কোটা আন্দোলনের নেতা না!’ দীপ্ত আকাশ আর দিব্য মন্ডল বারবার তাকে বলে ‘হারামজাদা! তুই শিবির! স্বীকার যা!’

সময় তখন ভোর পাঁচটা সম্ভবত। বাইরের খোলা আকাশটা একটু একটু ফর্সা হচ্ছে। শারীরিক আর মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত সেই দূর্বল ছেলেটার কাছ থেকে ফোনে ভয়েস রেকর্ড নেয় তারা। তাকে পরিষ্কার গলায় বলতে বলা হয়, ‘আমি কোটা আন্দোলনের নেতা। এই আন্দোলনে সরকার বিরোধীরা ষড়যন্ত্র করছে’।

দুই একটা শব্দ ঠিকভাবে না বলায় আহসান আবার লাথি, ঘুষি মারতে থাকে। এই সময় কানের উপর সে প্রচন্ড জোরে সর্বশক্তি দিয়ে চড় মারে। ছেলেটা প্রানপণ চেষ্টা করছে অজ্ঞান না হতে। এরপর আবার ভয়েস রেকর্ড করা হলো। ফোন, ল্যাপটপ এ শিবির প্রমানের প্রানান্তকর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সে রাতে ছেলেটা ছাড়া পায়।

ব্যাচমেটগুলোর মাধ্যমে রুমে পাঠানো হয় তাকে। শেষে আহসান বলে, ‘কয়দিন এর উপর নজর রাখিস।’ পরের দিন আহসান সকালে ডাকে। ছেলেটাকে নাপা ট্যাবলেট দেয়। বলে, ‘তোরে নিয়ে একদিন খাইতে যাব নে। কালকের ঘটনা ভুইলা যাইস’।

ঘটনার তিন চার দিন পর সেই বড় ভাই ছেলেটাকে আবার তার রুমে ডাকে। ভারী গলায় বলে, ‘আমি জীবনে দুইটা বড় ভুল করেছি। দ্বিতীয়টা গতকাল, তুই আমার ছোট ভাইয়ের মতই। আমাকে মাফ করে দে। আয় তোকে একটু আদর করে দিই।’ বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। যদিও ছেলেটা তাকে মাফ করে দেয় কিন্তু ঘটনাটা কখনোই ভুলতে পারেনা।

আর তার সেই ব্যাচমেট গুলো? কখনোই আর স্যরি বলেনি। কোনো অনুশোচনাও দেখায়নি। কিছুদিন আগে ছেলেটা অনেকের সাথে ওই ঘটনার ব্যাপারে যোগাযোগ করে, কিন্তু সেই দিব্য মণ্ডল বেমালুম ভুলেই গেছে সেই রাতের পৈশাচিক ঘটনা।

ওই ঘটনার সাথে জড়িত দুইজন ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাওয়ায় একজনকে ‘বড়’ ভাই হিসেবে বলা হয়েছে আর অন্যজনের কথা বলা হয়নি। আর বাকি পাঁচ জনের মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা ছিলো না, বরং তারা ঘটনাটা পাশ কাটিয়ে গিয়েছে।

আজ সেই ছেলেটার কারো উপর রাগ নাই। সবাইকে সে মাফ করে দিয়েছে। সে তো মানুষ, অমানুষ না। মানুষ মাফ করে দেয়, ভুলে যায় না। কিন্তু সেই কালো রাতটা ছেলেটাকে এখনো তাড়া করে বেড়ায়। মানসিক ট্রমা থেকে ও এখনো বের হতে পারেনি।

বিষন্নতা কাটানোর জন্য সে এই ঘটনাটা শেয়ার করে। সে এই কুৎসিত পৈশাচিক ঘটনাটা শেয়ার করবে নাকি করবে না এই দ্বিধা কাটতে লেগে গেছে তার একটা দীর্ঘ সময়। সে জানে না, সেই মানুষগুলো ক্ষিপ্ত হবে কিনা। ছেলেটার লাইফ থ্রেট হবে হয়তো। ক্ষতি করতে চাইবে তারা। কিন্তু ছেলেটা বিশ্বাস করে সত্যের জয় হবেই, আর বিপদে অনেককেই সে তার পাশে পাবে।


সর্বশেষ সংবাদ