আবরারের জিনিসপত্র নিতে এসে বুয়েটে মূর্ছা যাচ্ছিলেন ছোট ভাই

ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার হাতে খুন হওয়া বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের হলে থাকা বইপত্র ও জামা-কাপড়সহ সবকিছু বাবার কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। আজ বুধবার সকালে আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ ও তাঁর ছোট আবরার ফাইয়াজ এসব জিনিসপত্র বুঝে নেন। বড় ভাইয়ের বইপত্র ও জামাকাপড় নেওয়ার সময় ফাইয়াজ মূর্ছা যাচ্ছিলেন বলে জানালেন বাবা।

আবরারের জিনিসপত্রগুলো বস্তায় ভরে একটি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে কুষ্টিয়ায় পাঠানো হয়। বৃহস্পতিবার সেগুলো কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কের বাড়িতে পৌঁছাবে এগুলো।

নিহত আবরারের শোকাহত বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ আবরার ফাহাদ প্রথম বুয়েটের শেরে বাংলা হলে ওঠে। আর আজ ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর ছেলেকে ছাড়াই সবকিছু নিয়ে যেতে হচ্ছে। আবরারের ব্যবহৃত ট্যাংক, বইপত্র ও জামাকাপড় নেওয়া হয়। তবে কিছু বই পাওয়া যায়নি। এগুলো পাঠ্যবইয়ের বাইরে আবরার পড়ত। এ ছাড়া ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন পুলিশের কাছে আছে। সেগুলো আদালতের মাধ্যমে নিতে হবে।

গত ৬ অক্টোবর ছেলের লাশ নিতে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে গিয়েছিলেন বরকত উল্লাহ। আজ নিয়ে গেলেন ছেলের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। ফাইয়াজ ভাই মারা যাওয়ার পর আজই প্রথম হলে ভাইয়ের কক্ষে যান। বড় ভাইয়ের বইপত্র ও জামাকাপড় নেওয়ার সময় ফাইয়াজ মূর্ছা যাচ্ছিলেন বলে জানালেন বাবা।

আবরারের মামা আব্দুল কাদের বলেন, বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে বুয়েটে এসেছিল আবরার। আজ শূন্য হাতে ফিরে আসতে হল তার পরিবারকে। একজন বাবাকে তার সন্তানের সব স্মৃতি, বুক ভরা স্বপ্ন এভাবে মাথায় বইতে হচ্ছে। এ পৃথিবীতে বাবার কাঁধে সব থেকে ভারী জিনিস হচ্ছে সন্তানের লাশ। স্বপ্নের পরিবর্তে আবরারের বাবাকে সন্তানের লাশ আর তার জিনিসপত্র বইতে হচ্ছে। যেখানে ছেলের অর্জিত ডিগ্রি সাথে করে মাথা উঁচু করে ফেরার কথা সেখানে সন্তনের লাশের পরে তার ব্যাবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে ফিরতে হল। একজন বাবার কাছে এর থেকে কষ্টের আর কিছু থাকে না।

আবরারের ফুপাতো বোন আফরিদা পারভীন লিজা বলেন, ছোট ভাই ফাইয়াজের জন্য একটি শার্ট কিনেছিল আবরার। শার্টটি তার রুমেই ছিল। ফাইয়াজ শার্টটি দেখেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বার বার শার্টটি ধরে দেখছিল আর তখন ফায়াজের মুখটা বেদনায় ভরে যাচ্ছিল।

ভাইয়ার সাথে বড় হওয়াটা হলো না: আবরার ফাইয়াজের স্ট্যাটাস
‘‘৩১শে মার্চ ২০১৮। প্রথম ক্লাস ছিল সেইদিন আবার সেইদিনই হলে উঠতে হবে। রুম বরাদ্দ ছিল ২০৭, কিন্তু রুমে রাজনৈতিক দলের লোক থাকায় প্রভোস্ট বলেন ভুল করেও ওই দিকে যাবা না, ভাইয়া ক্লাসে ছিল বলে আমাদের বলে- ৫ তলায় জিনিসপত্র রাখতে। এখনো মনে আছে যেই মামা পায়ের ব্যাথায় হাটতে পর্যন্ত পারে না; সে কিনা হাসি মুখে অত ভারি বাক্স নিয়ে উপরে উঠলো; কিন্তু নিচে এসে দেখলাম ভাইয়ার থাকার জায়গা হয়েছে মসজিদে। আবার দুইজন মিলে নামিয়ে আনলাম, দৌড়ে গিয়ে আগে তোষক বিছিয়ে রাখলাম ফ্যানে নিচে; জানালার পাশে যাতে ভাইয়ার সুবিধা হয়।

সেইবার যখন চলে আসি তখন ভাইয়াকে দেখে মনে হয়েছিল অনেক খারাপ লাগছে বাট আমরাও খুশি মনে চলে আসি। মনে আছে বন্ধুরা বলছিল সব ছবি তুলে নিয়ে আসিস; কিন্তু লজ্জায় কিছুই তা হয়নি। কেউ যখন জিজ্ঞেস করত তোমার ভাই কি করে? অনেক গর্ব করে বলতাম বুয়েটে ইইই পড়ে। (এখন অবশ্য লজ্জা আর ঘৃণা লাগে এই ব্যাপারগুলা নিয়ে)

কালের পরিক্রমায় আজ ৩০শে অক্টোবর ২০১৯
আজকে আবার শেষ বারের মত যাবো ভাইয়ার রুমে। আগে অনেকবার গেলেও পার্থক্য এইবার ভাইয়া আর এই পৃথিবীতে নেই। মাত্র ১৯ মাস এর ব্যবধানে আবার আনতে যাচ্ছি যা একদিন রেখে আসছিলাম; কিন্তু এখন সবই ভাইয়ের স্মৃতি হিসেবে। এই হলে একসময় ভাইয়ের সাথে কত ঘুরছি ভাইয়া বলত আমাদের হলের মতো হল বাংলাদেশ এ আর নেই।সারারাত না ঘুমালেও আমি যেতে চাইলে কখনো আসতে নিষেধ করত না। নিজে না থাকলেও বলত চাবি ওইখানে রেখে আসছি।

মাঝে মাঝে ভাইয়া ঘুমিয়ে থাকলে আমি পাশে চেয়ার বসে থাকতাম; হঠাৎ খেয়াল করলে বলত- কিরে তুই কখন আসলি? তখন তো আর জানতাম না মাথার উপরেই আছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কিছু মানুষরূপী জীব, যারা একদিন.....।আজ আর কেউ নেই যে ‘ওই ভাবে’ বলবে কিছু লাগলে আমাকে বলবি আব্বু-আম্মুকে বলার দরকার নেই; আর কেউ ঘাড়ে হাত দিয়ে রাস্তা পার হবে না।

কষ্ট শুধুই এইগুলা ভেবে যে না জানি কতটা কষ্ট পাইছে যখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে আর আমাদের সাথে দেখা হবে না। হয়ত ওদের আঘাত থেকেও বেশি কষ্ট পেয়েছে বাবা-মা’র কথা ভেবে; কিন্তু যদি একবার বলতে পারতাম তুই শান্তিতে থাকলে আমাদের কাছে না থাকলেও আমরা খুশি, আমাদের চিন্তা তোকে করতে হবে না। হয়ত একসময় বলছে আল্লাহ তুমি ওদের দেখে রেখো তাই হয়ত এত কিছুর পরও এতটা স্বাভাবিক থাকতে পেরেছি।

আল্লাহর কাছেও খালি একটাই চাওয়া এখন ও যেন শান্তিতে থাকে। দুনিয়ায় কিছু না পেলেও আখিরাতে যেন সব পায়। সত্যি বলতে নিজের কাছের কেউ যখন যায় তখনই বুঝা যায় এই দুনিয়া কতটা ক্ষণিকের।
*একটা সময় আস্তে আস্তে হয় তো সব ভুলে যাব তাই এগুলা লিখে রাখা; ভাইয়ার সাথে বড় হওয়াটা তো আর হইলো না।। আল্লাহ ভরসা।’’

আবরারের জিনিপত্র নেয়ার এ বিষয়টি জানিয়ে আবরার ফাহাদ ফাউন্ডেশন নামে একটি পেজে লেখা হয়েছে, ‘‘কত স্বপ্ন নিয়ে বুয়েট যায় আবরার। আর তার সব স্বপ্ন কিছু নেই মৃত্যুর মধ্যে সব শেষ। আজ একজন বাবাকে তার সন্তানের সব স্মৃতি, স্বপ্ন এভাবে নিয়ে বয়ে যাইতে হচ্ছে। এ পৃথিবীতে বাবার কাঁধে সব থেকে বড় বোঝা হচ্ছে সন্তানের লাশ কাঁধে নেয়া। আর আবরারের বাবাকে সন্তানের লাশ আর তার জিনিসপএ নিয়ে যাইতে হচ্ছে, যেখানে পড়াশুনা শেষ করে ছেলেকে সাথে করে এসব নিয়ে যাওয়ার কথা ।

একজন বড় ভাই তার ছোট ভাইয়ের কাছে শুধু ভাই না, বাবা, মা বন্ধু বল সব। আজ সে ছোট ভাইকে সে সব থেকে বড় সম্পদ হারাতে হল। আবরার তার ছোট ভাই আর তার জন্য শার্ট কিনেছিল একসাথে পড়বে বলে, ফাইয়াজ ঢাকাতে আসলে। অথচ নিয়তির কি পরিহাস শার্ট আছে শুধু আবরার নেই।

ফাইয়াজকে তার ভাই এর কিনে রাখা শার্ট দেখতে গিয়ে কতটা কষ্ট হজম করতে হয়েছে তা একমাত্র আল্লাহ্‌ জানে।শার্টটা বার বার ধরে দেখছিল আর ওর বুকটা কি ব্যাথায় ভরে যাচ্ছিল, মহান আল্লাহ জানে তা। আবরারের সবকিছু আজ নিরবে শুধু দেখতে হল। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া আবরার (রাব্বি) কে বেহেশত নসিব করে নিন।
ও যেন পরকালে সুখে-শান্তিতে থাকে।’’

আবরার ফাহাদ বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) ছাত্র ছিলেন। বুয়েটের শেরেবাংলা হলের নিচতলায় ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন আবরার। ৬ অক্টোবর রাত আটটার দিকে তাঁকে কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় মামলা করেন।

আবরার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ২১ জনের মধ্যে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আটজন আসামি। তাঁরা হলেন অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ, মেহেদী হাসান ওরফে রবিন, মেফতাহুল ইসলাম, মুজাহিদুল, মনিরুজ্জামান মনির, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ও এস এম নাজমুস সাদাত।


সর্বশেষ সংবাদ