গুজব বিরোধী পদযাত্রা

‘মানুষ আমাকে ইঁদুর মারার ওষুধ বিক্রেতা মনে করেছে’

  © টিডিসি ফটো

সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন গুজবের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে নিজের পকেটের টাকায় বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার তেঁতুল তলা থেকে গত রবিবার (২১ জুলাই) সকাল ৬ টায় পায়ে হেঁটে টেকনাফের উদ্দেশ্যে পদযাত্রা শুরু করেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শেষবর্ষের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম শান্তি।

দীর্ঘ প্রায় ১০০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে ৩১তম দিনে আজ মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) টেকনাফ জিরো পয়েন্টে এসে পৌঁছান তিনি। সেখানে পৌঁছে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে তিনি এই দীর্ঘ পথ ও দীর্ঘদিনের পদযাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন।

সাইফুল ইসলাম শান্তি জানান, টেকনাফ জিরো পয়েন্টে এসে পৌঁছাতে আমার ১৭টি জেলা পেছনে ফেলে আসতে হয়েছে। আমি ৩০টি জায়গায় রাত্রি যাপন করি। আমি প্রতিদিন গড়ে ৩৫-৪০ কি. মি. পথ হেঁটেছি। আমি এই ত্রিশ দিনে আমার পদযাত্রায় আপামর জনসাধারণের ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। আমার প্রত্যেকটি পথ সভার ক্যাম্পেইনের বক্তব্য জনগণ ভালোভাবে গ্রহণ করেছে।

আমি যখন যে জায়গায় যেই পদযাত্রায় বক্তব্য দিয়েছি সব পদযাত্রায় আপামর জনগণ আমার বক্তব্য উৎসাহ নিয়ে মনোযোগ সহকারে শুনেছে। সবাই আমার এই কাজের প্রশংসা করেছে। অনেকেই রাস্তাঘাটে আমাকে দেখেই বুকে টেনে নিয়েছে। কেউ কেউ আবার এও বলেছে যে দেশে এখন আর কাউকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না। তোমাকে প্রতিবাদ করতে দেখে অনেক ভালো লাগছে। বেশিরভাগ পথচারী আমাকে আমার পদযাত্রার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছে। রাস্তা ঘাটে আমাকে সবাই পথ চলতে সহায়তা করেছে। পদযাত্রার এই ৩১ দিনে আমি দুদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আমি অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছি।

প্ল্যাকার্ড ধরে রাখতে রাখতে আমার হাতে ফোস্কা পড়ে গেছে, পায়ের একটি আঙ্গুলের নখ মরে গেছে। দু’পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিতেও ফোস্কা পড়েছে। পিঠে ব্যাগ রাখতে-রাখতে পিঠ প্রচুর বিষাদে ভরে গেছে। রোদে চোখমুখ কালো হয়ে গেছে। এই ৩১ দিনে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। হাইওয়ে দিয়ে হাটার সময় অনেক পথচারী যারা লেখাপড়া জানে না তারা আমার হাতে হ্যান্ডমাইক, পিঠে ব্যাগ ও হাতে প্ল্যাকার্ড দেখে দূর থেকে আমায় ইঁদুর মারা টিকটিকি মারার ওষুধ বিক্রেতা (হকার) এর সাথে তুলনা করেছে। তখন আমার খুব খারাপ লাগতো যখন দেখতাম দেখতে শুনতে ভালো লোকগুলো কি অন্ধ হয়ে গেছে নাকি? এরা কি পড়তে জানে না! কি লিখা আছে আমার প্ল্যাকার্ডে?

তখন নিমিষেই আমি শান্ত হয়ে যেতাম এবং বুঝতে পারতাম এরা পড়াশোনা জানে না এরা নিরক্ষর। তখন এদের কাছে যেতাম এবং প্ল্যাকার্ডে কি লেখা আছে তাদের কাছে গিয়ে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে আসতাম। তখন এদের ভুল ভেঙে যায় আমার সম্পর্কে। পরক্ষনেই আমি ভাবতাম এরা যে নিরক্ষর দোষটা এদের না আসলে দোষটা আমাদের, গোটা সমাজের, গোটা দেশের। আমরা আজও এদের অক্ষর জ্ঞান শিক্ষা দিতে পারিনি। ৩১ দিনের এই পদযাত্রায় আমার জীবনে অনেক কিছুই ঘটেছে। তারমধ্যে একটি ছিলো অত্যন্ত বেদনা ও ভয়াবহ অবস্থার।

পদযাত্রার ৫ম দিনে বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) আমি যখন দিনাজপুর দশমাইল ত্যাগ করে সৈয়দপুরের উদেশ্যে হাঁটা শুরু করি তখন যেতে যেতে রাত ৯টা বেঁজে যায় কোন শহর সামনে পড়ছে না। আমি হাটতেই থাকি। কারণ শহরে যে আমাকে থাকতে হবে কোন আবাসিক হোটেলে অথবা উপজেলা শহর হলে সরকারি ডাকবাংলোয়। কি ভাগ্য গুগল ম্যাপ দেখবো স্মার্ট ফোনে সে চার্জও নেই, অফ হয়ে গেছে।

সিদ্ধান্ত নিলাম কুলকিনারাহীন ভাবে আর হাঁটবো না। সামনে একটা মসজিদ আর একটা দোকান পেলাম, সেখানে ২০-৩০বিভিন্ন বয়সের মানুষ আড্ডা দিচ্ছে। উনাদের কাছে গিয়ে বললাম আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র। আমি এই জনসচেতনতামূলক প্রচারণায় নেমেছি। আমার কাছে থাকা ৫-৭ টা জাতীয় দৈনিক পত্রিকার নিউজ উনাদের দেখিয়ে বললাম দেখুন কেউ আমাকে যদি এই রাতটুকু থাকার জায়গা করে দেন আপনাদের বাসায় তবে আমার খুব উপকার হবে। আমার একথা শুনে সবাই কানে কানে ফিসফিস করতে লাগলো এবং সাথে সাথে অনেকেই বলে উঠলো না বাবা অপরিচিত অন্যকাউকে রাতে জায়গা দিতে নেই। তাছাড়া দিনকাল আজ ভালো না এখন যেভাবে ছেলেধরা বের হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে লাগলো।

আমি তাদের বুঝানোর চেষ্টা করে বললাম দেখুন আমি ছেলেধরা না আমি ছেলেধরা গুজবের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রচারণায় নেমেছি। প্লিজ কেউ আপনারা আমায় ভুল না বুঝে একটু থাকার জায়গা করে দিন। কেউ আমার সাহায্যে এগিয়ে এলো না।

একজন মধ্যবয়সী লোক দূর থেকে বলে উঠলো তুমি আমার বাসায় থাকবে চিন্তা করো না, আমি তোমায় আশ্রয় দিবো। একথা বলে এই ভদ্র লোক আমায় উনার বাসায় নিয়ে গেলো। আমি গোসল ও খাওয়া দাওয়া করে ঘুমাইলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ঐ বাড়িতে মানুষে ঘুমঘুম করতেছে, কেউ কেউ দরজার ফাঁক ও জানালা দিয়ে আমায় (ছেলেধরাকে) দেখার চেষ্টা করতেছে। ঐ এলাকায় রাতে রটনা বের হয়েছে ঐ ভদ্রলোক নাকি উনার বাসায় রাতে আমাকে (ছেলেধরাকে) আশ্রয় দিয়েছে।

সারারাত ঐ বাড়ির আশেপাশে এলাকার লোকজন আমাকে পাহারা দিয়েছে যে আমি নাকি রাতে ঐ বাড়ির লোকজন কে বেহুশ করে কল্লা কেটে নিয়ে যাবো এবং এলাকার ক্ষতি করবো। মানুষের যন্ত্রণায় ঐ বাড়ির মালিকও ঘুমায়নি। উনি সারারাত আমায় পাহারা দিয়েছে এই ভয়ে যে উৎসুক জনতা যদি সত্যি সত্যি ছেলেধরা সন্দেহ আমার উপর রাতে হামলা করে তাই। আমি যখন ঘুম থেকে উঠে এসব দৃশ্য দেখলাম তখন ভয়ে আমার শরীর শিহরে উঠতে লাগলো। আমি সাহস নিয়ে বিছানা থেকে উঠে ঐ বাড়ির বারান্দায় গেলাম এবং বাড়িতে আগত লোকজন কে বুঝালাম যে আমি ছেলেধরা নয়। আমি ছেলেধরা গুজবের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রচারণা চালাচ্ছি। কেউ আমায় ভুল বুঝবেন না। তখন লোকজন আবার ফিসফিস করতে করতে চলে গেল।

দেখুন: ঈদের দিনেও শান্তির তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ পদযাত্রা

এরপর আমি ঐ বাড়ির পাশেই রাস্তায় হ্যান্ডমাইক নিয়ে জনসচেতনতা মূলক বক্তব্য দিলাম এবং এলাকাবাসী কে এসব গুজবের বিরুদ্ধে সচেতনতা হওয়ার পরামর্শ দিলাম। এরপর ঐ বাড়ির মালিক আমাকে খাইয়ে দাইয়ে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। ঐ বাড়ির মালিক যদি রাতে ঘুমিয়ে যেত আমায় পাহারা না দিত তবে রাতেই এলাকাবাসী আমার ওপর হামলা করতো। আমাকে মেরে ফেলতো। আমার এই ৩০ দিনের পদযাত্রায় সাংবাদিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলার পুলিশ, ডিসি, এসপি, ইউএনও, সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন ও আমার ফেসবুক ফলোয়াররাও আমার খোঁজ খবর নিয়েছে

আজ টেকনাফে পৌঁছে আমার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু আফসোস হচ্ছে এ আন্দোলনটা আমার করার কথা না, এটা যদি কোন উচ্চ শিক্ষিত মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি করতো তবে আরো ভালো লাগতো। এটা করা উচিত ছিলো কোন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ও মানবাধিকার কর্মীর। কিন্তু আজ এরা চুপচাপ! এদেরকে সামাজিক কাজে খুঁজেই পাওয়া যায় না। তাই আমার বড় আফসোস হচ্ছে এদের ভূমিকা নিয়ে। আমি দেশবাসীকে অনুরোধ করছি আপনারা সবাই অন্যায়, অবিচার, জুলুম, দুর্নীতি, প্রশ্নফাঁস, গুজব ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে নিজ নিজ জায়গা থেকে আওয়াজ তুলুন এবং বাংলাদেশকে কলুষমুক্ত করুন।


সর্বশেষ সংবাদ