করোনায় কীভাবে চলছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সংসার?

  © প্রতিকী ছবি

প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে লকডাউন অবস্থা বিরাজ করছে সারা বিশ্বে। এই ভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে নিষ্কৃতি পায়নি বাংলাদেশও। দিন দিন বেড়েই চলেছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে সরকার। ফলে দেশের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আয়র সুযোগও এখন বন্ধ।

বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বন্ধ মেস। কিন্তু ভাড়া আদায় চলছেই। বাকি পড়েছে টিউশন (প্রাইভেট) ফি এবং বেতনও। এমন অবস্থায় অনেকটাই অসহায় প্রাইভেট শিক্ষকরা। অনেকেই মানবতর জীবন-যাপন করছেন। সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন, যাদের প্রাইভেট পড়ানো টাকায় নিজে ও পরিবারকে চালাতে হয়।

ঘরবন্দি অবস্থায় প্রাইভেট শিক্ষকদের এই দিনগুলো কেমন কাটছে- এ নিয়ে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস’র প্রতিনিধি আবদুর রহমান।

ঢাকার সবুজবাগ থানার মাদারটেকে অবস্থিত আর কে স্কুল এন্ড কলেজ এর শিক্ষক দুলাল। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং টিউশনি বন্ধ থাকায় কীভাবে চলছে আপনার পরিবার। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যখন সারা দেশে লকডাউন তখন একজন শিক্ষকের কান্না দেখার কেউ নাই। আমি সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে অনার্স শেষ করে কোন চাকরি না পেয়ে ঢাকার একটি কিন্ডার গার্টেনে সামান্য বেতনে চাকরি করি।’

তিনি বলেন, ‘সরকারি আদেশ অনুযায়ী ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাই স্কুল থেকে কোন বেতন দিচ্ছে না। বাসায় টিউশনি করাতাম সেগুলোও বন্ধ। মার্চ এর ২০ তারিখ পর্যন্ত টিউশনি চালিয়ে যাই। কিন্তু মানবিক দিক বিবেচনা করেও কোন অভিভাবক টিউশনি ফি পরিশোধ করেনি। এদিকে বাসাভাড়া না দিতে পেরে বাড়িওয়ালার কাছে বার বার লজ্জিত হচ্ছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল গ্যাস বিলসহ মোটা অঙ্কের টাকা জমে গেছে। আমার পরিবারের সদস্য ছয় জন। চার ভাই-বোনের মধ্যে আমাকেই সব দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই কষ্টের কথা না পারি কাউকে বলতে না পারি সইতে। কতদিন আর এভাবে চলবে আমাদের মত মধ্যবিত্ত শিক্ষকদের সংসার।

এসময় প্রধানমন্ত্রীর নিকট এই মধ্যবিত্ত শিক্ষকদের প্রতি সদয় হওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যদি আপনি সদয় না হন তাহলে হয়তো আমাদের মত হাজারো শিক্ষকের পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে। যেহেতু শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, তাই শিক্ষকদের বাঁচতে সহায়তা করুন।’

ঈদের বোনাস তো দূরের কথা দীর্ঘ তিন মাস বেতন না পেয়ে নিজের আর্তনাদের কথা জানালেন, ঢাকার মোহাম্মদপুরের আরেকটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল মডেল ইনিস্টিউটের অধ্যক্ষ মো. ইলিয়াস মিয়া। কেমন আছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে? জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমাদের অর্থনীতির চাকা প্রায় বন্ধ।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ আমাদের কোন শিক্ষকের বেতন দেয়নি। এই অবস্থায় সবকিছু বন্ধ হলেও পরিবারের খরচ এবং বাসা ভাড়া গ্যাস বিদ্যুৎ বিল বন্ধ হয়নি। সব কিছুর খরচ মিটাতে খুব হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই প্রাইভেট শিক্ষক সমাজের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করছি।’

ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি কলেজের আরেকজন শিক্ষক শাহজাহান স্বপন সংকটকালীন সময়ে জানালেন তার কষ্টের দিনগুলোর কথা। তিনি বলেন, দুই বছর আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন নবসৃষ্ট অনার্স শাখার জন‍্য নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে আজও বেতনের মুখ দেখলাম না। আর করোনার জন‍্য সেই বেতনের আশা অর্নিদিষ্টকালের জন‍্য আটকে গেল।’

তিনি আরো বলেন, ‘সামনে ঈদ। তাই খরচের বিষয় আছে। সবমিলিয়ে কি করবো কিছুই বঝতে পারছি না। তারপরেও আবার মেস ভাড়া। মেস মালিক কয়েকদিন আগে ফোন দিয়েছিল। বলেছি, কিছু দিন দেরি হবে টাকা দিতে। এর উপর সাংসারিক খরচ চালাতে হয় আমাকে। পরিবারের ভার বহন করতে হিমশিম খাচ্ছি এখন।’

এই তো গেলো রাজধানীর চিত্র। এর বাইরের রূপও একই। লক্ষ্মীপুর চন্দ্রগঞ্জ ক্লাস্টারের অধীনে বকুল বেগম আইডিয়াল স্কুল এন্ড মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মীর মনির হোসেন। তিনি জানালেন, দীর্ঘ দিন বেতন না পেয়ে তার পরিবারের অবস্থা।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস’র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘আমার মতো বেশির ভাগ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বেতন এবং টিউশনির টাকায় পরিবারের সকলের ভরন পোষনের দায়িত্ব পালন করে থাকে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সেটা এখন প্রায় বন্ধ। এ অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি ছাড়াও চন্দ্রগঞ্জ ক্লাস্টারের আওতায় ৩০টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে। খোঁজ নিয়ে দেখলাম গত মার্চ মাস থেকেই কোন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাই বেতন পাননি। স্কুল কমিটির সভাপতি বা সেক্রেটারী হিসেবে যারাই দায়িত্ব পালন করেন, সকলের কথা প্রায়ই একরকম। ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবক বেতন দিলে বা আদায় হলেই কেবল আপনাদের বেতন দিতে পারবো। এর আগে নয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘নিজের চাকরি বাঁচাতে কথা বলতে রাজি হয়নি অনেক শিক্ষক। যারা দীর্ঘ দিন বেতন বোনাস না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আর ভাবছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশাটি তাদের জন্য অভিশাপ।’

এই মানুষগুলোই দীর্ঘদিন বেতন পেয়ে নানান দুঃখ কষ্টে নিজের পরিবার নিয়ে থাকার পরও এই দু্র্যোগের মধ্যেও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে একইসাথে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক অনলাইনভিত্তিক ক্লাস চালিয়ে নিচ্ছে সাধ্যমত। শিক্ষার্থীরা যেন পড়াশোনা বিমুখ না হয় সেজন্য শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখছেন নিয়মিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামনে ঈদের হাসিটুকু অন্তত এই মানুষগুলো পরিবারে ফুটিয়ে তোলার জন্য তাদের বেতন-বোনাস দেওয়া জরুরি। না হয় এটা নিতান্তই অমানবিক এবং কষ্টদায়ক হবে তাদের জন্য। তাই যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদেরকে বিষয়টি মানবিক ও দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনায় নেওয়ার অনুরোধ করছেন শিক্ষাবিদরা।


সর্বশেষ সংবাদ