ইউরিয়া ছাড়াই বাড়বে ফলন, সাশ্রয় কোটি টাকা

প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত থাকায় কৃষি উন্নয়নের জন্য এ সম্পদকে সঠিকভাবে সারে রূপান্তর করতে বাংলাদেশ সক্ষম হয়েছে। দেশে ইউরিয়া ধান চাষের জন্য সার হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। দেশে ব্যবহৃত মোট পুষ্টির মধ্যে নাইট্রোজেন সার একাই প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যবহার হয়ে থাকে।

ইতিহাস পড়ে যতটুকু জানা যায়, ১৮২৮ সালের পরে অ্যামোনিয়া ও সায়ানিক অ্যাসিড থেকে ইউরিয়ার কৃত্রিম গঠন আবিষ্কার করা হয়েছিল। সত্তেরর দশকের মাঝামাঝি ইউরিয়া বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নাইট্রোজেন সারে পরিণত হয়েছিল।

বিশেষত তিন ধরনের সার রয়েছে—১. রাসায়নিক সার, ২. জৈব সার এবং ৩. বায়োফার্টিলাইজার। এ সারগুলোই হলো বিশ্বজুড়ে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কৃষি ইনপুট। উদ্ভিদ এবং প্রাণিজ উৎসের যে উপাদানগুলো ফসলের ফলন বৃদ্ধির জন্য মাটিতে প্রয়োগ করা হয়, তাদের জৈব সার বলা হয়। এগুলো সাধারণত কাঁচা বা প্রক্রিয়াজাত অবস্থায় ব্যবহৃত প্রচুর পরিমাণ পদার্থে তৈরি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের জৈব সার প্রয়োগ করা হয়। অতীতে জৈব সার মূলত বাংলাদেশে ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হতো। রাসায়নিক সারের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে জৈব সারগুলোর ব্যবহার ধীরে ধীরে এবং তারপর মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। তবে বাংলাদেশে ব্যবহৃত জৈব সারগুলোর মধ্যে প্রাণীর সার, কম্পোস্ট, সবুজ সার এবং বায়োফার্টিলাইজার অন্যতম। রাসায়নিক (অজৈব) সার উদ্ভিদের পুষ্টির পরিপূরক উৎস হিসেবে ১৯৫০ দশকের গোড়ার দিকে এ দেশে চালু হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক জাতগুলোর প্রবর্তন এবং সম্প্রসারণ এবং সেচ সুবিধা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ব্যবহার ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে অবিচ্ছিন্নভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। সার ব্যবহারের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, বিশেষত ইউরিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে। অন্য সারগুলোর মধ্যে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ কম হওয়ায় এবং ফসলের বর্ধনে নাইট্রোজেনীয় সারগুলোর দ্রুত কার্যকর হওয়ার কারণে এটি প্রধান অবস্থান দখল করে, কৃষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। অন্যান্য সার কম সাড়া দেওয়ার কারণে কৃষকের কম মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল, যদিও তাদের প্রয়োজনটিকে এড়ানো যায় না।


দেশে ছয়টি ইউরিয়া সার কারখানা চালু রয়েছে। এগুলো হলো এনজিএফএফ (ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি) ফেঞ্চুগঞ্জ; ইউএফএফএল (ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড) ঘোড়াশাল; জেডএফসিএল (জিয়া ফার্টিলাইজার কো. লি.) আশুগঞ্জ; (ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লি.) পলাশ, ঘোড়াশাল; সিইউএফএল (চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড), চট্টগ্রাম এবং যমুনা ফার্টিলাইজার কো. লি., সরিষাবাড়ি, জামালপুর। এই কারখানাগুলো ১৯৯৬-৯৭ সালে প্রায় ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন টন ইউরিয়া উৎপাদন করেছিল, যা চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশ সরবরাহ করেছিল। যমুনা সার কারখানাটি ভালো মানের মোটর আকারের দানাদার ইউরিয়া উৎপাদন করে। এই ইউরিয়া ধান চাষের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। চট্টগ্রামের পতেঙ্গার কাছে কর্ণফুলী নদীর তীরে কাফকো (কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড) নামের একটি বেসরকারি খাতের সার কারখানাও এখন চালু রয়েছে।

মাটিতে বিভিন্ন জাতের জৈব সার প্রয়োগ করা হয়, যেমন: গরু-ছাগলের প্রস্রাব-পায়খানা, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, ফার্মইয়াম্যানুয়ুর, কম্পোস্ট, শুকনো রক্ত, হাড়ের গুঁড়া, মাছের খাবার, চিনা বাদামের কেক, তেলের কেক, ধইঞ্চা, চাল এবং গমের খড়, আখের পাতা, আগাছা, ছাই ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে কম্পোস্ট সার, সবুজ সার এবং তেলের কেক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এগুলোর ব্যবহার এখনো কৃষকের কাছে তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।

ফিরে আসি ইউরিয়া সারের ব্যবহার নিয়ে। গত কয়েক বছরের হিসাবে বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতে বছরে ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয় ২৭ লাখ মেট্রিক টন (পরিমাণ কমবেশি হতে পারে) (উৎস: ডিপার্টমেন্ট অব রিচার্স, ইমার্জিনিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড)। ২০১২-১৩ সালে ইউরিয়া কনসাম্পশন হয়ে ছিল ২২ দশমিক ৪৭ মেট্রিক টন এবং উৎপাদন হয়েছিল ১০ লাখ মেট্রিক টন (উৎস্য: ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ)। যদিও আমাদের প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি প্রায় ৩৫ লাখ মেট্রিক টনের মতো (উৎস: শাফি আহমেদ, বুয়েট, জার্নাল অব কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, আইইবি ভলিউম সিএইচই. ২৬. নং. ১, ডিসেম্বর ২০১১ )।

এবার আসি কীভাবে ইউরিয়া সার ছাড়া সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ বেশি ফসল উৎপাদন করা যায়। রাইজোবিয়াম অণুজীব ও অন্যান্য বাহক পদার্থ দ্বারা অণুজীব সার তৈরি হয়, যাকে বায়োফার্টিলাইজার বা ইনোকুলাম বলে। ইনোকুলান্ট পাউডার, দানাদার ও তরল হতে পারে। সঠিক রাইজোবিয়ামকে ডাল ও তৈল জাতীয় ফসলের বীজ বা মূলের কাছাকাছি আনাকে ইনোকুলেশন বলে। বিভিন্ন ফসলের জন্য বিভিন্ন অণুজীব আছে, যেমন: সয়াবিনের জন্য Bradyrhizobium japonicum, মসুরের জন্য Rhizobium leguminosarum bv. Viciae এবং বাদামের জন্য Bradyrhizobium sps. অণুজীব সারের প্রয়োজন হয়। বারির (BARI) মৃত্তিকা অণুজীবতত্ত্ব গবেষণাগারে বিভিন্ন ডাল ও তৈল জাতীয় ফসলের জন্য রাইজোবিয়ামের বাছাইকৃত ও ব্যবহার উপযোগী বিভিন্ন স্ট্রেইনসমূহ আছে। রাইজোবিয়াম অণুজীবের সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো এ অণুজীব বায়বীয় নাইট্রোজেনকে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী নাইট্রোজেনে রূপান্তরিত করে। আমরা জানি, বাতাসে প্রায় ৭৯ শতাংশ নাইট্রোজেন আছে, যেটাকে আমরা সহজে গাছের গ্রহণ উপযোগী নাইট্রোজেনে রূপান্তরিত করাতে পারি এবং সেই সঙ্গে কৃষকের ডাল ও তৈল–জাতীয় ফসলের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ফলন বাড়াতে পারি। যেমন মসুর ডাল হেক্টরে ১১৫ কেজি নাইট্রোজেন সংযোজন করতে পারে, যা প্রায় ২৫০ কেজি/হেক্টর সমমানের ইউরিয়ার সারের সমান। মুগ ডালে হেক্টরে ১০৫ কেজি, চিনাবাদামে ১০৫ হেক্টরে ১৫০ কেজি নাইট্রোজেন সংযোজন করতে পারে, যা যথাক্রমে ২২৪ ও ৩২৬ কেজি/হেক্টর সমমানের ইউরিয়ার সারের সমান। এই অণুজীব ব্যবহার করলে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কৃষকের ফলন বাড়ে কোনো ধরনের ইউরিয়া সার ব্যবহার ছাড়া (উৎস: মৃত্তিকাবিজ্ঞান গবেষণাগার ও গবেষণা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর)। এসব নতুন কৃষিপ্রযুক্তি যদি কৃষকের দোর গোড়ায় পৌঁছানো যায়, তাহলে কৃষকের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রযুক্তিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, সেই সঙ্গে সরকারের কোটি কোটি টাকার ইউরিয়া সার আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। এ ছাড়া গত এক দশকে সারা বিশ্বে জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে কৃষকেরা নানা ধরনের নতুন নতুন রোগবালাইয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন, এ কারণে কৃষকের দিন দিন উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাই সময় এসেছে কৃষি বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিজ্ঞানী, সচেতন সমাজ, কৃষিবিষয়ক সাংবাদিক, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ, কৃষক ও কোম্পানি প্রতিনিধি এবং সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যাঁরা আছেন, তাঁদের নিয়ে রাইজো অণুজীব প্রযুক্তি সমন্ধে আওয়াজ তোলা, তবে একদিকে সরকারের লাখ লাখ কোটি টাকার ইউরিয়া সার আমদানি করতে হবে না, অন্যদিকে বাংলাদেশের অসহায় কৃষক ইউরিয়া সার ব্যবহার ছাড়াই ডাল ও তৈল–জাতীয় শস্যে ৪০ শতাংশ অধিক ফলন উৎপাদন করতে পারবে। আমাদের একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, এসব রাইজো অণুজীব সার মাটির কোনো ক্ষতি করে না এবং পরিবেশবান্ধব। সরকারের ও কৃষকের অর্থ সাশ্রয়কারী, পরিবেশবান্ধব এবং কৃষকের জন্য অত্যন্ত উপকারী যাঁরা এসব প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। এ ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়টি সবার দৃষ্টিগোচর করতে হবে। কৃষকের কাছেও এর গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। কৃষককে বোঝাতে হবে, যদি রাইজো অণুজীব ব্যবহার করা হয়, তাহলে ইউরিয়া সার তো লাগবেই না সেই সঙ্গে মুসরে ৩৩ কেজি, মুগে ৩০ কেজি এবং বাদামে ৪৩ কেজি বাড়তি ইউরিয়া সার মাটিতে যোগ হবে এবং ৪০ শতাংশ ফলন বেশি বাড়বে।


সর্বশেষ সংবাদ