আমেরিকা যেভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধ্বস নামিয়েছিল

অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বেকারত্ম বেড়ে যাওয়ায় জনরোষ বাড়তে থাকে।
অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বেকারত্ম বেড়ে যাওয়ায় জনরোষ বাড়তে থাকে।   © ফাইল ফটো

২০০৭-৮ সালের দিকে আমেরিকার অর্থনীতিতে বিশাল মন্দার সৃষ্টি হয়। যার ফলে থেমে যায় দেশটির উন্নয়নের গতি এবং যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো পৃথিবীতেই। আজকে এ নিয়ে বিস্তারিতভাবে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসে লিখছেন তরুণ অর্থনীতিবিদ মোহাইমিন পাটোয়ারি। 

‘‘এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দা হয়েছিল ২০০৭-৮ সালে। আমেরিকা থেকে শুরু হয়ে এই মন্দার প্রভাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সে অর্থ বছরে উন্নত বিশ্বের দেশ গুলোতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক, কিন্তু তার আগের বছর গুলোতেই প্রবৃদ্ধির হার ছিল সর্বোচ্চ। হঠাৎ করে কিভাবে উন্নয়নের ডালা উলটে গেল তা হয়তো আপনাদের অনেকেরই অজানা। চলুন আজকে সেই অজানাকে জেনে নেই।

২০০৭ সালের পূর্বে আমেরিকাতে চলছিল উন্নয়নের ঘোড়া দৌড়। উন্নয়নের জোয়ারে সেই দেশের সকল সম্পত্তি, বিশেষত ঘর-বাড়ির দাম ছিল উর্ধ্বমূখী। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংকগুলো ঋণ দেবার মহোৎসব শুরু করে, এমনকি ঋণ নেবার একেবারে অনুপযোগী ব্যক্তিদেরও তারা গৃহ ঋণ দিতে থাকে। কেউ দেউলিয়া হয়ে যাবে এই নিয়ে ব্যাংক কোন চিন্তিত ছিল না। কারণ, ঋণের বিপরীতে নতুন বাড়ি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা ছিল, তাই কেউ দেউলিয়া হয়ে পড়লে ব্যাংক বাড়ির মালিকানা অর্জন করে ফেলত।

এদিকে বছর বছর যেহেতু বাড়ির দাম কেবল বৃদ্ধিই পাচ্ছিল কেউ দেউলিয়া হলে সব মিলিয়ে ব্যাংকেরই লাভ হবে। অর্থাৎ, একজন গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করুক কি না করুক উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাংকের লাভ। এই হিসেব করে যেই ব্যক্তিই ঋণের আবেদন করেছেন ব্যাংক কাউকে ফেরায়নি। এক পর্যায়ে যার ঋণ পরিশোধ করার মত সামর্থ্য ছিল না তাদেরকেও ব্যাংক সেধে সেধে বাড়ি কেনার ঋণ ধরিয়ে দিল। এই সিস্টেমে সব মিলিয়ে ব্যাংক খুব খুশি ছিল, কারণ এমন ব্যবসায় কোন লোকসান নেই। আবার গ্রাহকও খুব খুশি ছিল, কারণ যার কোনদিন নতুন বাড়ি করবার সামর্থ্য ছিল না সেও একেবারে সহজ শর্তে নতুন একটি বাড়ি পেয়ে গেল।

আর এদিকে ফাইনান্সিয়াল ইঞ্জিনিয়াররা ঋণ গুলোর বিপরীতে জটিল জটিল সব ডেরাইভেটিভ তৈরি করে বাজারে বিক্রয় করতে থাকল। ইনভেস্টররাও খুশি মনে এই ডেরাইভেটিভ কিনতে লাগলো। সব মিলিয়ে ঝড়ের পূর্ব প্রস্তুতি চলছিল।এভাবে একসময় এই ধারা সীমা অতিক্রম করে ফেলে। ফলে অতিরিক্ত পরিমাণ গ্রাহক দেউলিয়া হওয়া শুরু করে। এক পর্যায়ে এত বেশী বাড়ির মালিক দেউলিয়া হয়ে পড়ে যে বিক্রির লিস্টে জমা পড়া বাড়ির সংখ্যা ক্রয়ের লিস্টের ক্রেতার সংখ্যার চেয়ে বড় হয়ে যায়।

ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতার সংখ্যা বেশী হলে ইতিহাসে সবসময় যা হয়েছিল পরবর্তিতে তা-ই হয়। বাড়ির দাম কমে যেতে শুরু করে। এতদিন পর্যন্ত যেখানে বাড়ি দাম কেবল বৃদ্ধিই পেয়েছিল, এখন সেখানে শুরু হল বাড়ির দাম কমা। এর ফলে ব্যাংক গুলো লোকসান গুনতে শুরু করল। এদিকে ব্যাংকের পাশাপাশি লোকসান শুরু হয় বীমা কোম্পানিরও। কারণ ব্যাংক ঋণগুলো বীমা করা ছিল।

এত বিশাল দেউলিয়ার ধাক্কা সামলাতে গিয়ে বীমা কোম্পানিও খাদের কিনারায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তির পাশাপাশি একের পর এক ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হতে থাকলো। আর যে সকল প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়েছিল তাদের কর্মী বেকার হয়ে পড়ল, যার ফলে বৃদ্ধি পায় জাতীয় বেকারত্ব। বেকারত্বের কারণে আরও বেশী দেউলিয়াপনা বৃদ্ধি পেল। ঠিক এমন সময়, আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ একটি ব্যাংক- লেহম্যান ব্রাদারস দেউলিয়া হয়ে যায়।

লেহম্যান ব্রাদারসের দেউলিয়াপণা ছিল সারা বিশ্বের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। ঐ দিনেই শেয়ার বাজারে নামে ব্যপক ধ্বস এবং বিভিন্ন ফিনান্সিয়াল ডেরাইভেটিভের কারণে এই লস ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। এভাবে সাড়া বিশ্বেই মন্দার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে এবং স্বীকৃত ভাবে শুরু হয়ে যায় এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দা।’’

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক


সর্বশেষ সংবাদ