৫ টাকা, ১০ টাকা চাঁদায় গড়ে উঠে ‘অপরাজেয় বাংলা’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা  © সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত ক্যাম্পাস। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, ডাক দিয়েছেন মুক্তির। আর সেই মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে। অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। মানচিত্রে নতুন দেশ অঙ্কিত হয়েছে। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা এক জন্মভূমি যার নাম বাংলাদেশ।

স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক ভাস্কর্যের কথা বললেই প্রথমে যে দৃশ্যটি ভেসে উঠে তা হলো তিনটি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তি। নাম ‘অপরাজেয় বাংলা’। কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে বাংলার নারী-পুরুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং বিজয়ের প্রতীক এই ভাস্কর্য। মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ এর নির্মাতা।

ভাস্কর্যটিতে তিনজন তরুণের মূর্তি প্রতীয়মাণ। এদের মধ্যে দু’জন পুরুষ এবং একজন নারী। যে তিনজন মানুষকে দেখা যায় তাদের একজন হলেন ফার্স্টএইড বক্স হাতে একজন সেবিকা। যার মডেল হয়েছিলেন হাসিনা আহমেদ। তারই পাশে দাঁড়ানো সময়ের প্রয়োজনে রাইফেল কাঁধে তুলে নেওয়া গ্রীবা উঁচু করে ঋজু ভঙ্গিমায় গ্রামের টগবগে তরুণ। যার মডেল হয়েছিলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ। তিনি ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সবশেষে দাঁড়ানো দু’হাতে রাইফেল ধরা  আরেক শহুরে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা যার মডেল ছিলেন বদরুল আলম বেনু। তিনি শুধু অপরাজেয় বাংলার মডেলই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আবদুল্লাহ খালিদের একান্ত সহযোদ্ধাও।

জানা যায়, ভাস্কর্যটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও টাকার অভাবে মনের মত করে নির্মাণ করার উপায় তখন ছিল না। কারণ, এই কাজে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাত্র ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। তাই বাধ্য হয়েই টাকা সংগ্রহের জন্য ভিন্ন এক পন্থা বেছে নেওয়া হয় সে সময়। ‘পাঁচ টাকা’ ‘দশ টাকা’ ‘বিশ টাকা’ করে সবমিলিয়ে তোলা হয় ২৫ হাজার টাকা। ডাকসুর উদ্যোগে তোলা এই চাঁদা ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত অনুদানের টাকাতেই গড়া হয় ভালোবাসার ‘অপরাজেয় বাংলা’। যদিও সেই টাকায় লোহা বা ব্রোঞ্জে ভাস্কর্য নির্মাণ সম্ভব ছিল না। আর তাই ভেতরে লোহার কাঠামো আর বাহিরে কংক্রিট ঢালাইয়ে নির্মিত হয় ভাস্কর্য। সবমিলিয়ে চ্যালেঞ্জ, পরিশ্রম ও আবেগের মিশ্রণে তৈরি হয় আমাদের ‘অপরাজেয় বাংলা’।

মাটির মাকেট থেকে কংক্রিট ঢালাইয়ে ভাস্কর্যটি নির্মাণের কারিগরি তত্ত্বাবধান করেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান, তহবিল সংকটের কারণে এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৫ হাজার টাকা দিলেও ডাকসুকে ২৫ হাজার টাকা চাঁদা তুলতে হয়েছিল।

১৯৭৩ সালে ভাস্কর্যটির কাজ শুরু হলেও তা শেষ হতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ। রক্তক্ষয়ী পঁচাত্তরের পর দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ রাখা হয়েছিল ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ। পরবর্তীতে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে পুনরায় ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করা হয়। ছয় ফুট বেদির উপর নির্মিত এ ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১২ ফুট এবং প্রশস্থতা আট ফুট ।

ঐতিহ্যবাহী ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্য নির্মাণেরও রয়েছে ইতিহাস। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য সাধারণ অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) মনোযোগী হয়। এ জন্য বটতলা থেকে একটু দূরে তৎকালীন শিল্পী আব্দুল লতিফের নকশায় নির্মিত হয় একটি ভাস্কর্য। কিন্তু রাতের আঁধারে একটি কুচক্রী মহল ভাস্কর্যটি ভেঙ্গে ফেলে।

পরবর্তীতে সেখানেই আবার নতুন ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ভাস্কর্য নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের উপর। তিনি প্রথমে মাটি দিয়ে ভাস্কর্যের মডেল তৈরি করেন। মডেলটি সবার পছন্দ হলে ১৯৭৩ সালের এপ্রিল থেকে এর আনুষ্ঠানিক নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তখন থেকেই অক্লান্ত পরিশ্রম শুরু করে দেন খালিদ। তার আর দিন-রাত বলে কিছু থাকে না। মানুষটার মগজে তখন একটাই চিন্তা ভাস্কর্য তৈরি। তবে কিছুদিন পরেই ঘটে যায় দেশের ইতিহাসের জঘন্যতম-অন্যতম কালো অধ্যায়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তার কালো ছায়া থেকেও রেহাই পায় না ভাস্কর্য।  বিধ্বংসী একটা ট্যাংকের নল সবসময় অর্ধনিমিত তাক করে রাখা হত ভাস্কর্যের দিকে। তাছাড়া পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে পাকপন্থী এবং স্বাধীনতা বিরোধী চক্রগুলো ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলতে জনমত সৃষ্টির জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাক্ষর গ্রহণ করে। কিন্ত তৎকালীন সব ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের এই পরিকল্পনাকে সমূলে নৎসাত করে দিয়েছিল এবং তারা প্রবল বাধার স্মমুখীন হয়। তবে শেষ পর্যন্ত  স্বাধীনতাবিরোধী স্বৈরাশাসকদের যতই পৃষ্ঠপোষকতা থাকুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অবিনাশী। আর এ কারণেই ভাস্কর্য হয়েছে।

 ফাটল দেখা দেওয়ায় ২০১৪ ভাস্কর্যটি সংস্কার করে কিছুটা সাদা করা হয় (ডানে)।
মূল রং হারিয়ে যাওয়ায় বিষয়টি সে সময় বেশ সমালোচনার জন্ম দেয়।

ভাস্কর্যটির নাম ‘অপরাজেয় বাংলা’ হওয়ার কৃতিত্ব সে সময়ের ‘দৈনিক বাংলার’ সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর। তিনি ভাস্কর্য নিয়ে সেসময় দৈনিক বাংলাতে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল ‘অপরাজেয় বাংলা’। পরবর্তীতে এ নামটিই সর্ব সম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়।

ভাস্কর্যটি নিয়ে মিশুক মনির লিখেছেন- ‘অপরাজেয় বাংলা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছাতে কোন লিফ্লেটের দরকার পড়েনি। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, বিএনপি হোয়াটেভার ইট ইজ, যাদেরই রাজনৈতিক কোন বক্তব্য রাখার প্রয়োজন হত, কোথায় হবে? অপরাজেয় বাংলা। এই যে একটা ইউনিভার্সাল এক্সেপ্টেন্স এটা ৭৮, ৮৫, ৮৮ কনস্ট্যান্টলি হয়েছে। এরকম উদাহরণ হয়তো কমই আছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অ্যাক্রস দা প্লটফর্ম একই ভেন্যু, একই ইমেজ, একই ফিলিংস থেকে রিলেট করছে, গ্রেট এচিভমেন্ট’। মিশুক মনিরের এ বক্তব্যের সত্যতা আমরা আজও দেখতে পাই।

অপরাজেয় বাংলার ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের সাথে একসময় এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শিমুল সালাহউদ্দিন। সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে ‘অপরাজয় বাংলা’ প্রসঙ্গে উঠে আসলে পারস্পরিক যে আলাপ হয় তার কিছুটা এখানে উল্লেখ করা হলো-

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: স্যার, আপনি তো ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, বামপন্থী ছিলেন! এখনো বামপন্থী?
সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ: তুমি জানলা কীভাবে? এখন তো আর এইটা কেউ বলে না। তখন সাম্যবাদে উদ্বুদ্ধ ছিলাম। পরে আর রাজনীতি করি নাই। এসএসসি পরীক্ষার পর এলাকার বড় ভাইরা বললো, ছাত্র ইউনিয়নের সবার সাথে বন্ধুত্ব হলো। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টও ছিলাম কিন্তু! নইলে তো তোমরা চিটাগাং ইউনিভার্সিটি শুনলেই শিবির বলতা!

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: হা হা হা, না স্যার, অপরাজেয় বাংলা যে বানায় সে শিবির হয় কেমনে! এসএসসি পাশ করলেন কত সালে?
সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ: নাইনটিন সিক্সটি ফাইভে মনে হয়।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: অপরাজেয় বাংলার প্রথম নকশাটা করলেন বা ডিজাইন করলেন, এটা কত সালে? প্রস্তাবটা কাদের ছিল?
সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ: ১৯৭৩ সালে মনে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছিল, ডাকসুও ছিল।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার কাছে প্রস্তাবটা স্যার কারা নিয়ে আসে?
সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ: সেলিম ছিল, ঐ যে মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম। আরও কে কে ছিল।

ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে, প্রেরণার বাতিঘর হয়ে আলো ছড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভাস্কর্যও প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। 

জনৈক এক কবি ‘অপারেজয় বাংলা’ নিয়ে লিখেছেন এক অসাধারণ কবিতা-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলা ভবন চত্বর,
প্রবেশের পথে থমকে দাড়াই।
পেছন থেকে মৃদুস্বরে কে যেন ডাকে আমায়।
আমাকে ডেকে বলে ‘পথিক-
শুনবে আমার কথা,একটু সময় হবে তোমার?’
একজন নারী। সাথে আরও দুজন পুরুষ যোদ্ধা।
আমি এগিয়ে গেলে আমায় বলে-মোরা ক্লান্ত,
পঁচাত্তরে খালেদের কীর্তি আমরা তিনজন।
সেই থেকে এখানে আমরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি,
এই বন্ধু বটগাছের পাশে,যার সাথে নিত্য কথা হয়।
মিছিল-স্লোগানে মুখরিত হয় আমাদের চারপাশ,
মাঝে মাঝে আমাদের চোখ বেঁধে দেওয়া হয় কাল কাপড়ে।
ঐ বটগাছ,ও আমায় একাত্তরের গল্প শোনায়,
শোনায়, লাল-সবুজের পতাকা প্রথম মেলে ধরার গল্প।
তবুও আমি,আমরা ক্লান্ত।

আমি বলি ক্লান্ত কেন তুমি?ক্লান্ত কেন তোমরা?
সে আমায় বলে-
আমাকে সৃষ্টির লক্ষ্য এখন শুধু পাথরের কারুকার্য।
আমায় দেখে একাত্তরের কথা হয়না স্মরণ,
তাইতো ক্লান্ত, শ্রান্ত।


সর্বশেষ সংবাদ